আমার লক্ষ্য দেশবাসীর ভাগ্য পরিবর্তন করা : প্রধানমন্ত্রী
প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘আমার লক্ষ্য বাংলাদেশের মানুষের ভাগ্য পরিবর্তন করা।’ গতকাল রোববার (২ জুলাই) টুঙ্গিপাড়া উপজেলা আওয়ামী লীগ কার্যালয়ে আয়োজিত ঈদুল আজহা উপলক্ষে সর্বস্তরের মানুষের সঙ্গে শুভেচ্ছা ও মতবিনিময় অনুষ্ঠানে এ কথা বলেন তিনি।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে দেশের স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছে। বঙ্গবন্ধু দেশবাসীর মুখে হাসি ফোটাতে চেয়েছিলেন, যার জন্য তিনি দ্বিতীয় বিপ্লবের কর্মসূচি ঘোষণা করেছিলেন।’
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতাকে তার পরিবারের বেশির ভাগ সদস্যসহ হত্যা এবং একই বছরের ৩ নভেম্বর ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের ভেতরে জাতীয় চার নেতাকে হত্যার ঘটনায় ক্ষোভ প্রকাশ করে শেখ হাসিনা বলেন, ‘দেশের অগ্রগতি থামিয়ে দেওয়ার জন্যই এই হত্যাকাণ্ড চালানো হয়েছিল। বঙ্গবন্ধুকে এমন সময়ে হত্যা করা হয়েছিল, যখন দেশ অর্থনৈতিক মুক্তির দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, “সরকার ‘আমার বাড়ি, আমার খামার’, কমিউনিটি ক্লিনিক, ডিজিটাল বাংলাদেশ, ‘আমার গ্রাম, আমার শহর’ বাস্তবায়ন করে এবং শতভাগ বিদ্যুৎ দিয়ে দেশের ব্যাপক উন্নয়ন করেছে।’
টুঙ্গিপাড়া-কোটালীপাড়া আসনের সংসদ সদস্য শেখ হাসিনা তার নির্বাচনি এলাকার জনগণকে কৃতিত্ব দিয়ে বলেন, ‘সাধারণত, অন্যান্য সংসদ সদস্যরা শুধু তাদের নিজ নিজ নির্বাচনি এলাকার দেখাশোনা করেন। কিন্তু, আমাকে ৩০০টি নির্বাচনি এলাকায় উন্নয়নের জন্য কাজ করতে হয়। কোটালীপাড়া ও টুঙ্গিপাড়ার বাসিন্দারা আমার নির্বাচনি এলাকার দায়িত্ব নেওয়ায় আমি তা করতে পেরেছি।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, দেশবাসীর ভাগ্য পরিবর্তনের লক্ষ্যে ছয় বছরের নির্বাসন থেকে দেশে ফেরার পর তিনি দেশের বিভিন্ন স্থানে ঘুরেছেন। তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের এমন কোনো অঞ্চল নেই, যেখানে আমি যাইনি। আমি নৌকা, সাম্পান, লঞ্চ ও রিকশা-ভ্যানে চড়ে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে গিয়েছি। আমি এমনভাবেই সারা দেশ ভ্রমণ করেছি এবং সারা দেশে ঘুরে বেড়ানোর অভিজ্ঞতা ব্যবহার করে বাংলাদেশকে এমন একটি মর্যাদাপূর্ণ অবস্থানে নিয়ে এসেছি।’
শেখ হাসিনা বলেন, তার সরকারের সময়োপযোগী পদক্ষেপের কারণে ২০২৬ সালে বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে যাত্রা শুরু করবে। তিনি বলেন, ‘বিএনপি-জামায়াত আবার ক্ষমতায় এলে এদেশের মানুষের ভাগ্য নিয়ে ছিনিমিনি খেলবে এবং এদেশের ক্ষতি করবে। তাই সবাইকে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে হবে, যাতে তারা তা করতে না পারে।’
আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনা বলেন, ‘আওয়ামী লীগ মাটি ও মানুষের দল এবং জনগণই দলের শক্তি। আওয়ামী লীগ যখনই ক্ষমতায় আসে তখনই দেশবাসীর ভাগ্যের পরিবর্তন হয়।’
আওয়ামী লীগের সভাপতি বলেন, তার দলের সাংগঠনিক শক্তি আরও বাড়াতে হবে।
বিএনপির সন্ত্রাসীদের হাতে আওয়ামী লীগের ২১ হাজার নেতাকর্মীসহ বহু মানুষ নিহত হয়েছেন উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, ‘কানাডার ফেডারেল আদালত বিএনপিকে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে ঘোষণা করেছে।’
দেশের পররাষ্ট্রনীতির কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি হলো—সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারো সঙ্গে বিদ্বেষ নয়। আমরা এই নীতি অনুসরণ করি। তবে, আমরা চাই না কেউ আমাদের উন্নয়ন অগ্রযাত্রায় বা আমাদের অগ্রগতিতে বাধা সৃষ্টি করুক। আমরা তা হতে দেব না।’
যারা দেশের বিরুদ্ধে বিদেশিদের কাছে অভিযোগ করে, তাদের কঠোর সমালোচনা করে সরকারপ্রধান বলেন, ‘যাদের নিজের মাটিতে শক্তি নেই, নিজের দেশের মানুষের প্রতি আস্থা ও বিশ্বাস নেই, তারা দেশবাসীর কল্যাণ করতে পারে না। তারা বিদেশে গিয়ে (বিদেশিদের কাছে) অভিযোগ এবং বিভিন্ন মিথ্যা তথ্য ছড়িয়ে জনগণকে বিভ্রান্ত করতে পারে।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, জনগণের ভাগ্য নিয়ে কেউ যাতে কেউ ছিনিমিনি খেলতে না পারে, সে বিষয়ে তিনি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। তিনি বলেন, ‘আমাদের দেশ হবে জাতির পিতার স্বপ্নের ক্ষুধা-দারিদ্র্যমুক্ত উন্নত, সমৃদ্ধ বাংলাদেশ।’
২০১৩-২০১৫ মেয়াদে বিএনপি-জামায়াত চক্রের দেশব্যাপী অগ্নিসংযোগের কথা উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, ‘যারা মানুষকে জীবন্ত পুড়িয়ে হত্যা করতে পারে, তারা রাজনীতি করতে পারে না। তাদের কাছে, ক্ষমতা হচ্ছে অর্থ উপার্জনের যন্ত্র এবং মানুষের ভাগ্য নিয়ে ছিনিমিনি খেলা।’ বাংলাদেশের জনগণের ভাগ্য নিয়ে আর কেউ যাতে ছিনিমিনি খেলতে না পারে, সেজন্য তিনি দেশবাসীকে সতর্ক থাকার আহ্বান জানান।
সমালোচকদের তীব্র নিন্দা করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘তারা আওয়ামী লীগ সরকারের মেয়াদে চালু করা টেলিভিশন, বিদ্যুৎ ও ডিজিটাল ব্যবস্থা ব্যবহার করে, আওয়ামী লীগের সুনাম নষ্ট করার জন্য মিথ্যাচার করছে। মিথ্যা বেশি দিন টিকবে না। এসব কিছু সময়ের জন্য টিকে থাকতে পারে। অবশেষে সত্যের জয় হবে। বিশ্বাসের জয় হবে।’
শেখ হাসিনা বলেন, তার সরকার সফলভাবে দেশে সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ নিয়ন্ত্রণ করেছে। তিনি বলেন, ‘এখনও কিছু মহল এই ধরনের কর্মকাণ্ডের দিকে ঠেলে দেওয়ার চেষ্টা করছে। জনগণ যদি সতর্ক থাকে, তাহলে তারা তা করতে পারবে না এবং এ ক্ষেত্রে জনগণের এগিয়ে আসা সবচেয়ে জরুরি।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘দেশের মানুষ ইতোমধ্যে বিএনপির সন্ত্রাসী চেহারা দেখেছে। জিয়াউর রহমানের শাসনামল থেকে এ দলটির সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকার রেকর্ড রয়েছে। বিএনপি-জামায়াত চক্র দেশের কোনো উন্নয়ন করেনি, বরং তারা দুর্নীতির মাধ্যমে সম্পদ-সম্পত্তির মালিক হয়েছে এবং দেশের অর্থ পাচার করেছে। তারা অর্থ পাচার, সন্ত্রাস, দুর্নীতি, জঙ্গি তৈরি, মানুষ হত্যা এবং এক কোটি ২৩ লাখ ভুয়া ভোটারসহ ভোটার তালিকা তৈরির মতো অনেক অপকর্ম করেছে। এই সন্ত্রাসী সংগঠনের বাংলাদেশের মানুষের কথা বলার কোনো অধিকার নেই।’
বিএনপির নেতৃত্ব সম্পর্কে শেখ হাসিনা বলেন, তিনি দয়া করে খালেদা জিয়ার সাজা স্থগিত করেছেন এবং তাকে বাড়িতে থাকতে দিয়েছেন। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসন ১০ ট্রাক অস্ত্র উদ্ধার ও ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলাসহ অন্যান্য মামলায় সাজাপ্রাপ্ত আসামি এবং এখন পলাতক আসামি হিসেবে লন্ডনে অবস্থান করছেন। তিনি এখন সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার করে খুতবা দিচ্ছেন। শেখ হাসিনা প্রশ্ন রাখেন, ‘তার এত সাহস থাকলে তিনি বাংলাদেশে আসেন না কেন? তারেক জিয়া তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে আর রাজনীতি করবে না বলে মুচলেকা দিয়ে দেশ ছেড়ে পালিয়ে গেছে।’
বর্তমান বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য বিদ্যুৎ ও পানি ব্যবহারে সংযম অবলম্বন করতে, বর্ষাকালে বৃক্ষরোপণ এবং এক ইঞ্চি জমি অনাবাদি না রাখার আহ্বান জানান প্রধানমন্ত্রী।
মতবিনিময়কালে প্রধানমন্ত্রী টুঙ্গিপাড়ার উন্নয়ন নিয়ে স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মী ও জনপ্রতিনিধিদের অভিজ্ঞতা শুনতে চান। শেখ হাসিনা বার্ধক্যজনিত কারণে অবসরে যাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করলে, স্থানীয় জনগণ তাকে দেশ ও জনগণের কল্যাণে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে থাকার অনুরোধ জানান। তারা শেখ হাসিনাকে পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দেখার আকাঙ্ক্ষা ব্যক্ত করেন এবং এ লক্ষ্যে আগামী সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে সাহায্য করার জন্য কাজ করার দৃঢ়অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করেন।
মতবিনিময় সভায় অন্যান্যদের মধ্যে সংসদ সদস্য শেখ হেলাল উদ্দিন ও শেখ সালাউদ্দিন জুয়েল উপস্থিত ছিলেন। টুঙ্গিপাড়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আবুল খায়ের মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন এবং অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন সাধারণ সম্পাদক মো. বাবুল শেখ।
এর আগে প্রধানমন্ত্রী কোটালীপাড়া ও টুঙ্গিপাড়ায় দুই দিনের সফরের অংশ হিসেবে তার সরকারি বাসভবন গণভবন থেকে গাড়িতে করে তিন ঘণ্টায় পদ্মা সেতু পার হয়ে গতকাল (১ জুলাই) বেলা ১১টা ২৭ মিনিটের দিকে কোটালীপাড়ায় পৌঁছান। প্রধানমন্ত্রীর আইসিটি বিষয়ক উপদেষ্টা ও একমাত্র ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় তার সঙ্গে ছিলেন।
টুঙ্গিপাড়ায় প্রধানমন্ত্রীর উপস্থিতিতে স্থানীয় জনগণের মধ্যে বাড়তি বিপুল উদ্দীপনা ও উৎসবের আমেজ যোগ করেছে। প্রধানমন্ত্রীকে স্বাগত জানাতে পুরো গোপালগঞ্জকে রঙিন পোস্টার, ব্যানার ও প্ল্যাকার্ডে সাজানো হয়।
প্রধানমন্ত্রী গতকাল শনিবার কোটালীপাড়া উপজেলা আওয়ামী লীগ কার্যালয় প্রাঙ্গনে নিম, বকুল এবং আমগাছের চারা রোপণ করেন। এছাড়াও নবনির্মিত কোটালীপাড়া উপজেলা আওয়ামী লীগ কার্যালয় উদ্বোধন করেন তিনি।
আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা পরে কোটালীপাড়া উপজেলার স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মী, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও কোটালীপাড়া উপজেলার জনসাধারণের সঙ্গে পবিত্র ঈদুল আজহার শুভেচ্ছা বিনিময় করেন।
অনুষ্ঠান শেষে প্রধানমন্ত্রী শনিবার বিকেলে টুঙ্গিপাড়ায় গিয়ে ফুল দিয়ে বঙ্গবন্ধুর সমাধিতে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন এবং ফাতেহা পাঠ করেন। তিনি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সমাধিতে মোনাজাতে যোগ দেন। শনিবার দিনগত রাত টুঙ্গিপাড়ায় কাটান প্রধানমন্ত্রী।
টুঙ্গিপাড়ায় পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সমাধিতে মোনাজাত করার পর গতকাল রোববার বিকেলে টুঙ্গিপাড়া থেকে তিনি তার সরকারি বাসভবন গণভবনে পৌঁছান।