ভৈরবে ঝুঁকি নিয়ে বসবাস ঋষি সম্প্রদায়ের কয়েকশ পরিবারের
কিশোরগঞ্জের ভৈরবে ২৩০ কেভি জাতীয় গ্রিড লাইনের সুউচ্চ বৈদ্যুতিক টাওয়ারের নিচে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বসবাস করছে ঋষি সম্প্রদায়ের কয়েকশ পরিবার। সেখানে তাঁরা দীর্ঘদিন যাবত মানবেতর জীবন যাপন করলেও, সেদিকে কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই স্থানীয় প্রশাসনের। রাষ্ট্রের সংবিধান স্বীকৃত মৌলিক অধিকারের ন্যূনতম উপস্থিতি ওইসব পরিবারের লোকজনের বেলায় না থাকলেও কোনো উদ্যোগ নেই সংশ্লিষ্টদের। ফলে নিয়তির উপর নিজেদের ও পরবর্তী প্রজন্মকে সঁপে দিয়ে দিনযাপন করছেন তাঁরা।
তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এখানে বসবাসকারী মানুষদের ঋষি সম্প্রদায় হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। বংশানুক্রমে তাঁরা ছিলেন যাযাবর। ইহকাল থেকে পরকালকেই এই সম্প্রদায়ের মানুষ বেশি গুরুত্ব দেয়। মুসলমানদের সুফি মতবাদের মতোই অনেকটা এদের মতবাদ। ঈশ্বর প্রেমে বিভোর এই ঋষি সম্প্রদায় আধ্যাত্মিক গান-বাজনা গেয়ে এক অঞ্চল থেকে অন্য অঞ্চলে ঘুরে বেড়াত।
ভারত ভাগ হওয়ার আগে থেকেই সিলেট, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, ময়মনসিংহ প্রভৃতি এলাকা থেকে বন্দর ও সমৃদ্ধ বাণিজ্যনগরী ভৈরবে এ সম্প্রদায়ের আগমন ঘটে। বসবাস শুরু করে তৎকালীন জমিদার ভৈরব রায়ের রাজকাচারীর অনতিদূরে বর্তমান কাঠপট্টির পতিত ভূমিতে। তখন থেকে এলাকার বিভিন্ন পূজা-পার্বণ, উৎসবে গান-বাজনা করে তাদের জীবন চলতে থাকে।
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পাঁচ-ছয় বছর আগে ঋষি সম্প্রদায়ের বসবাসের ভূমিটুকু তৎকালীন সরকারের ভূমি অধিদপ্তর থেকে বন্দোবস্ত আনেন এলাকার এক প্রভাবশালী ব্যক্তি। স্বাধীনতার পর বন্দোবস্ত সূত্রে মালিকের উত্তরাধিকাররা তাদেরকে জোর পূর্বক উচ্ছেদ করে। তারপর স্থানীয় রাজনৈতিক, সামাজিক ও জনপ্রতিনিধিদের সহযোগিতায় ঋষি সম্প্রদায় মেঘনা-ব্রহ্মপুত্র নদের মোহনায় ২৩০ কেভি বৈদ্যুতিক টাওয়ারের আশেপাশে বসবাস শুরু করেন।
সেখানে অস্থায়ীভাবে বসবাস শুরু হলেও সেটিই এখন তাদের স্থায়ী নিবাস হয়ে উঠেছে। বর্তমানে সেখানে টাওয়ারের আশপাশসহ টাওয়ারের নিচের বাউন্ডারি দেওয়ালের ভেতরে সুড়ঙ্গ কেটে ঢুকে ঘর তৈরি করে বাস করছেন লোকজন। উপরে ও চার পাশে সুউচ্চ বৈদ্যুতিক টাওয়ার। অজানা ঝুঁকির আশঙ্কা নিয়ে প্রতিটি দিন কাটে ঋষি সম্প্রদায়ের কয়েকশ পরিবারের চার-পাঁচ হাজার নারী-পুরুষ ও শিশুর।
মাঝে-মধ্যে ছোটখাট দুর্ঘটনা যে ঘটছে না তা কিন্তু নয়। অনেক সময় টাওয়ারের বিভিন্ন যন্ত্রাংশ ভেঙে পড়ে এইসব ঘরের উপর। তাতে ঘর ভেঙে যায়। আহত হয় লোকজন। কিন্তু ছোট খাট বলে এইসব দুর্ঘটনার খবর কোথাও প্রচার হয় না। তাদের আশঙ্কা যদি কখনও ঘূর্ণিঝড় বা ভূমিকম্প-ভূমিধস বা নদী ভাঙনে টাওয়ার ভেঙে পড়ে, তখন কি অবস্থা দাঁড়াবে তাদের ভাগ্যে।
স্থানীয় লোকজন জানায়, ২০১৭ সালের ১ মে সোমবার রাতে ভৈরবের কালীপুর এলাকা দিয়ে বয়ে যাওয়া এক ঘূর্ণিঝড়ে আশুগঞ্জ-সিরাজগঞ্জ ২৩০ কেভি সঞ্চালন লাইনের একটি সুউচ্চ টাওয়ার বিধ্বস্ত হয়েছিল। টাওয়ারটির আশেপাশে বাড়ি-ঘর না থাকায় কোনো প্রাণহানি ঘটেনি। কিন্তু এমনটি যদি এখানে ঘটে, তবে মানবতার চরম বিপর্যয় ঘটবে। তখন আফসোস করা ছাড়া আর কিছুই করার থাকবে না।
শত বছরেও মাথা গোঁজার ঠাঁই না পেয়ে আক্ষেপ নিয়ে এখানকার অধিবাসী রামকুমার ঋষী দাস বলেন, ভৈরবে সরকারের কত খাস জমি বৈধ-অবৈধভাবে দখল করে আছে প্রভাবশালীরা। মুজিব জন্মশতবর্ষ উপলক্ষে ভৈরবসহ সারা দেশে সরকার সাড়ে ৭ লাখ পরিবারকে জমিসহ পাকা ঘর তৈরি করে দিয়েছেন। অথচ আমাদের বেলায় কিছুই নেই। কি দোষ আমাদের?
সুউচ্চ বৈদ্যুতিক টাওয়ারের নিচে অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় মানবেতর জীবন যাপন করছে ঋষি সম্প্রদায়ের আগামী প্রজন্মের শিশুরা। তাদের নিরাপত্তাহীন জীবনে যে কোন মুহূর্তে দুর্ঘটনায় নিভে যেতে পারে শত শত জীবন প্রদীপ। সরকার ও সুশীল সমাজের কারও কোন ভাবনাই নেই তাদের নিয়ে। ক্ষোভ আর দুঃখ নিয়ে একথা জানান বৃদ্ধা কমলাঋষী দাস, অনিদ্র ঋষী দাস আর স্মৃতি রানি ঋষী দাস।
টাওয়ারের নিচ দিয়ে পশুর খোয়ারে ঢোকার মতো করে প্রতিদিন আসা-যাওয়া করতে হয় তাদের। নেই শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পয়ঃনিষ্কাশনের ব্যবস্থা। নেই বিশুদ্ধ পানি ও চলাচলের ব্যবস্থা। এই দুঃসহ জীবন থেকে সুস্থ-সুন্দর ও স্বাভাবিক জীবনে পুনর্বাসিত হতে চায় অধিকারবঞ্চিত ঋষি সম্প্রদায়ের মানুষ। একথা জানালেন বাংলাদেশ দলিত জনগোষ্ঠী অধিকার আন্দোলন, কিশোরগঞ্জ জেলা শাখার সভাপতি স্বপনকুমার ঋষি দাস।
স্বপনকুমার ঋষি দাস আরও জানান, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে দলিত সম্প্রদায়ের পক্ষ থেকে ইতোমধ্যে ৮ দফা দাবি জানানো হয়েছে। এরমধ্যে প্রধান দাবি হলো-তাদের পুনর্বাসন। কিন্তু এ বিষয়ে বার বার তাগাদা দিলেও, হবে, হচ্ছে করে তাদের পুনর্বাসন নিয়ে এখনও কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করা হচ্ছে না। আমাদের পুনর্বাসনের বিষয়টি দ্রুত সম্পন্ন করার জন্য সরকারের প্রতি জোর দাবি জানাই।
জাতীয় সঞ্চালন লাইনের সুউচ্চ টাওয়ারের মতো একটি অতি জনগুরুত্ব সম্পন্ন ও ঝুঁকিপূর্ণ স্থাপনার নিচে কি করে এমন একটি ঘনবসতিপূর্ণ বসতি গড়ে উঠলো এবং দীর্ঘদিন যাবত অতিঝুঁকি নিয়ে কয়েক হাজার মানুষ কি করে বসবাস করে আসছে?
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড ভৈরব সরবরাহ কেন্দ্রের নির্বাহী প্রকৌশলী মোহাম্মদ সালাহ উদ্দীন এনটিভি অনলাইনকে জানান, জাতীয় গ্রিড লাইনের টাওয়ার দেখভালের দায়িত্ব তাঁর কার্যালয়ের নয়। সেটি দেখাশোনা করে পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি বাংলাদেশ (পিজিসিবি)।
জানতে চাইলে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ সাদিকুর রহমান সবুজ এনটিভি অনলাইনকে বলেন, বিষয়টি আমার জানা ছিল না। আমি আপনার মাধ্যমে ছবি ও ভিডিও দেখে অবগত হলাম। কিছু পরিবার জাতীয় সঞ্চালন লাইনের টাওয়ারের নিচে বসবাস করছেন ঝুঁকি নিয়ে, এটি অত্যন্ত অমানবিক। আমি শিগগিরই ওই এলাকা পরিদর্শন করব। পরিদর্শন শেষে বিদ্যুৎ বিভাগকে চিঠি দিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে বলব। আর সরকারি খাস ভূমিতে যদি তারা পুনর্বাসিত হতে চায়, তবে আমি তাদের পুনর্বাসনে উদ্যোগ নেব।