নতুন ডিএমপি কমিশনারের দায়িত্ব গ্রহণ, পুরাতনের ফুলেল বিদায়
![](https://ntvbd.com/sites/default/files/styles/big_3/public/images/2023/09/30/ddiempi-thum.jpg)
দীর্ঘ ৩২ বছর আট মাসের চাকরি জীবনের ইতি টেনে অবসরজনিত ছুটিতে যাচ্ছেন সদ্য বিদায়ী ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার খন্দকার গোলাম ফারুক। আজ শনিবার (৩০ সেপ্টেম্বর) ঢাকা মহানগর পুলিশ সদর দপ্তরের দায়িত্ব হস্তান্তরের মধ্য দিয়ে শেষ হয় তাঁর দীর্ঘ চাকরিজীবনের কর্মযজ্ঞ। একই সময়ে ডিএমপির ৩৬তম কমিশনার হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন ট্যুরিস্ট পুলিশের অতিরিক্ত আইজিপি হাবিবুর রহমান।
বিদায়ী ডিএমপি কমিশনার খন্দকার গোলাম ফারুককে আনুষ্ঠানিক রীতি অনুযায়ী পুলিশ সদস্যরা ফুলের রশি দিয়ে গাড়ি টেনে বিদায় জানান। কমিশনারের বিদায়ের সময় ডিএমপির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারাসহ বিভিন্ন পর্যায়ের পুলিশ সদস্যরা আবেগাপ্লুত হয়ে ওঠেন। এর আগে গোলাম ফারুককে বিদায়ী সালাম প্রদান করে ডিএমপির সুসজ্জিত একটি দল।
গত ২০ সেপ্টেম্বর রাষ্ট্রপতির আদেশক্রমে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের উপসচিব সিরাজাম মুনিরা স্বাক্ষরিত এক প্রজ্ঞাপনে হাবিবুর রহমানকে ডিএমপি কমিশনার হিসেবে নিয়োগ দিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়।
হাবিবুর রহমান ১৯৬৭ সালের ১ জানুযারি গোপালগঞ্জ জেলার চন্দ্রদিঘলিয়া গ্রামের আব্দুল আলী মোল্লা এবং মোসাম্মৎ রাবেয়া বেগম দম্পতির ঘরে জন্মগ্রহণ করেন। শৈশব থেকেই লেখাপড়ার পাশাপাশি খেলাধুলা, শিল্প-সাহিত্য-সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে তিনি নিবেদিত প্রাণ। এস এম মডেল হাই স্কুল থেকে মাধ্যমিক শেষ করে গোপালগঞ্জের সরকারি বঙ্গবন্ধু বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক সম্পন্ন করেন। পরবর্তীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউট থেকে কৃতিত্বের সঙ্গে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন।
হাবিবুর রহমান ১৭তম বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে সহকারি পুলিশ সুপার হিসেবে বাংলাদেশ পুলিশে যোগদান করেন। চাকরি জীবনে যে কর্মস্থলেই দায়িত্ব পালন করেছেন, সেখানেই রেখে এসেছেন তার সৃষ্টিশীল চিন্তাচেতনা আর ব্যতিক্রমী কর্মস্পৃহার সাক্ষর। নেতৃত্ব আর সৃজনশীলতা দিয়ে প্রশিক্ষণকালেই ‘আমার হলো শুরু’র সম্পাদক নির্বাচিত হন।
ডিএমপির ডিসি (হেডকোয়ার্টার্স) হিসেবে কর্মরত অবস্থায় মেধা ও নেতৃত্বগুণে হাবিবুর রহমান সাধারণ মানুষ, সহকর্মী ও অধস্তন পুলিশ সদস্যের কাছে হয়ে উঠেন মানবিক পুলিশি সেবার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। তার প্রচেষ্টায় রাজারবাগ পুলিশ লাইন্সে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘বাংলাদেশ পুলিশ মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর’। মহান মুক্তিযুদ্ধে প্রথম সশস্ত্র প্রতিরোধযোদ্ধা হিসেবে বাংলাদেশ পুলিশ স্বীকৃতি পায় তার অনন্য উদ্যোগের মাধ্যমে। পুলিশ সদর দপ্তরের ডিসি থাকাকালীন তিনি বাংলাদেশ পুলিশের বাস্কেটবল এবং কাবাডি টিমের দায়িত্ব গ্রহণ করে পুলিশ টিমের খেলায় প্রাণচাঞ্চল্য ফিরিয়ে আনেন।
হাবিবুর রহমান ঢাকা জেলার পুলিশ সুপার হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করার পর আইনশৃঙ্খলা বজায় রাখতে অভিনব কর্মকৌশল প্রযোগ করেন। তিনি সাধারণ মানুষকে পুলিশের কর্মকাণ্ডের সঙ্গে সম্পৃক্ত করার মাধ্যমে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ‘জনগণের পুলিশ’ হিসেবে চিত্রিত করেন।
![](https://ntvbd.com/sites/default/files/styles/very_big_1/public/images/2023/09/30/ddiempi-in-2.jpg)
অতিরিক্ত ডিআইজি হিসেবে পুলিশ সদর দপ্তরে সফলভাবে কাজের পর ডিআইজি হিসেবে ঢাকা রেঞ্জে যোগদান করেন হাবিবুর রহমান। ঢাকা রেঞ্জের ডিআইজি হিসেবে করোনাকালীন সমাজের নিম্নস্তরের ও পিছিয়ে থাকা মানুষদের সহায়তা, পুলিশ নিয়োগ ও পদায়নে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠা, জনগণকে অপরাধ নিয়ন্ত্রণে সম্পৃক্ত করা, মনিটরিং সেল স্থাপনসহ বিভিন্ন পর্যায়ে ঢাকা রেঞ্জ পুলিশকে অনন্য পর্যায়ে নিয়ে যান যা অন্যান্য পুলিশ ইউনিটের জন্য অনুকরণীয় হিসেবে প্রকাশ পায়।
দীর্ঘ তিন বছর ঢাকা রেঞ্জ ডিআইজি হিসেবে দায়িত্ব পালন শেষে হাবিবুর রহমান অতিরিক্ত আইজিপি হিসেবে ট্যুরিস্ট পুলিশ প্রধানের দায়িত্ব পালন করছেন। দেশী ও বিদেশী পর্যটকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে ট্যুরিস্ট স্পটে নিরাপত্তা ও নির্ভরতার প্রতীক হয়ে উঠেছে বাংলাদেশ ট্যুরিস্ট পুলিশ। পেশাগত জীবনে তার অসাধারণ কৃতিত্বের জন্য যেমন লাভ করেছেন প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি, তেমনি অর্জন করেছেন রাষ্ট্রীয় পুরস্কার। তিনি তিন বার বাংলাদেশ পুলিশ পদক (বিপিএম) এবং দুই বার প্রেসিডেন্ট পুলিশ পদকে (পিপিএম) ভূষিত হন।
‘মানবিক পুলিশ অফিসার’ হিসেবে পরিচিত হাবিবুর রহমানের উদ্যোগে বদলে গিয়েছে বাংলাদেশের বেদে সম্প্রদায় ও তৃতীয় লিঙ্গের মানুষের জীবন। কাজ করেছেন যৌনপল্লীর শিশুদের মধ্যে শিক্ষার আলো ছড়াতে। দেশ জুড়ে অসংখ্য মসজিদ, মাদ্রাসা ও কবরস্থান নির্মাণ করেছেন।
পুলিশের চাকরির পাশাপাশি লেখালেখি-গবেষণাতেও উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন অতিরিক্ত আইজিপি হাবিবুর রহমান। তার সম্পাদিত গ্রন্থ ‘Speeches of Sheikh Hasina’, ‘শেখ মুজিবের চিঠি’ ও একই বইয়ের ইংরেজি সংস্করণ ‘Letters of Sheikh Mujibur Rahman’, ‘নন্দিত স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বীর মুক্তিযোদ্ধা আসাদুজ্জামান খান’, ‘পিতা তুমি বাংলাদেশ’, ‘মুক্তিযুদ্ধে পুলিশের ভূমিকা’ ও ‘মুক্তিযুদ্ধে প্রথম প্রতিরোধ’- এসব বইয়ে প্রথমবারের মতো বিস্তারিত উঠে আসে একাত্তরে মহান মুক্তিযুদ্ধে পুলিশের ভূমিকা।
এ ছাড়া হাবিবুর রহমানের গবেষণাধর্মী গ্রন্থ ‘ঠার’ পাঠক সমাজে আলোচিত। এই বইয়ে তিনি বেদে সম্প্রদায়ের বিলুপ্তপ্রায় ভাষা নিয়ে কাজ করেছেন। গ্রন্থটির জন্য হাবিবুর রহমান ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা পদক-২০২৩’ লাভ করেন।
হাবিবুর রহমানের হাত ধরে পুলিশ কল্যাণ ট্রাস্টের উদ্যোগে রাজধানীর অদূরে দক্ষিণ কেরানীগঞ্জের বসুন্ধরা রিভারভিউ প্রকল্পে গড়ে ওঠা অত্যাধুনিক মাদক নিরাময় ও পুনর্বাসন কেন্দ্র ‘ওয়েসিস’ এ টেলিমেডিসিন সেবা চালু হয়। যেখানে বিনামূল্যে ২৪ ঘণ্টা বিশেষজ্ঞ ডাক্তারদের মাধ্যমে টেলিমেডিসিন সেবা দেওয়া হয়।
হাবিবুর রহমানের আরেকটি মানবিক উদ্যোগ ‘পুলিশ ব্লাড ব্যাংক’, যা করোনা রোগীদের প্লাজমা এবং ডেঙ্গু রোগীদের প্লাটিলেট সরবরাহ করে কোডিড-১৯ ও ডেঙ্গু চিকিৎসায় প্রশংসনীয় ভূমিকা রেখেছে। তিনি বাংলাদেশ পুলিশের মাসিক প্রকাশনা ‘দি ডিটেকটিভ’ সম্পাদনা করছেন। সাংস্কৃতিমনা হাবিবুর রহমান বাংলাদেশ পুলিশ নাট্যদলের প্রতিষ্ঠাতা। তার গবেষণা ও দিকনির্দেশনায় মঞ্চায়িত হয়েছে জনপ্রিয় ‘অভিশপ্ত আগস্ট’ ও ‘অচলায়তনের অপ্সরী’ নাটক ।
![](https://ntvbd.com/sites/default/files/styles/very_big_1/public/images/2023/09/30/ddiempi-in-1.jpg)
হাবিবুর রহমান একজন সফল ক্রীড়া সংগঠক। তিনি বাংলাদেশ কাবাডি ফেডারেশনের সেক্রেটারি এবং এশিয়ান কাবাডি ফেডারেশনের সহসভাপতি। বাংলাদেশের জাতীয় খেলা কাবাডি হাবিবুর রহমানের হাত ধরেই আন্তর্জাতিক অঙ্গনে এক নতুন উচ্চতায আবির্ভূত হয়। তার গতিশীল নেতৃত্বে দেশে বাংলাদেশ গেমস, যুব গেমস, জাতীয় কাবাডি প্রতিযোগিতা, আইজিপি কাপ জাতীয় যুব কাবাড়ি, প্রিমিয়ার কাবাডি লীগ, প্রথম ও দ্বিতীয় বিভাগ কাবাডি লীগসহ অসংখ্য কাবাডি টুর্নামেন্ট অনুষ্ঠিত হয়েছে। বর্তমানে বিশ্বকাপ কাবাডিতে বাংলাদেশ কাবাডির অবস্থান পঞ্চম। এ ছাড়া এশিয়ান কাবাডিতে পঞ্চম ও সাউথ এশিয়ান কাবাডিতে বাংলাদেশের অবস্থান তৃতীয়। কাবাডিতে তার অভূতপুর্ব উদ্যোগের কারণে ২০২২ সালে ক্রীড়া ফেডারেশনগুলোর মধ্যে কাবাডি ফেডারেশন শ্রেষ্ঠ ফেডারেশন হিসেবে স্বীকৃতি পায়।