সরকারি গুদামে ধান দিতে আগ্রহ নেই কৃষকদের
দেশের সর্ববৃহৎ চালের মোকাম ও চাহিদার অধিক খাদ্য উদ্বৃত্ত জেলা নওগাঁয় চলতি আমন মৌসুমে সরকারিভাবে ধান, চাল সংগ্রহ অভিযান চলছে। এই ধান চাল সংগ্রহের অগ্রগতি ভালো হলেও নানা জটিলতা আর বাজারে ধানের দাম বেশি পাওয়ায় সরকারি খাদ্য গুদামে ধান বিক্রি করতে আগ্রহ নেই কৃষকদের।
চাল সংগ্রহের ক্ষেত্রে সিদ্ধ চাল ৯১ শতাংশ, আতপ চাল ৭৫ শতাংশ কেনা হলে সরকারিভাবে অগ্রগতি নেই ধান কেনার ক্ষেত্রে। জেলায় মোট বরাদ্দে মাত্র ৫ দশমিক ৩৩ শতাংশ ধান কিনতে পেরেছে খাদ্য বিভাগ। চলতি মাসের ২৮ তারিখ শেষ হচ্ছে সংগ্রহের মেয়াদ। কিন্তু এখনও বাকি ৯৪ দশমিক ৬৭ শতাংশ ধান কেনা। যা চলতি আমন মৌসুমে কেনা সম্ভব নয় বলে খোদ খাদ্য কর্মকর্তারা জানান। ফলশ্রুতিতে চাল কেনায় সরকারিভাবে অগ্রগতি লক্ষ করা গেলেও ধান কেনার ক্ষেত্রে ভেস্তে গেছে সরকারি পরিকল্পনা।
নওগাঁ জেলায় ধান কেনার এই চিত্র ভাবিয়ে তুলেছে খাদ্য বিভাগকে।
জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রকের অফিস সূত্রে জানা যায়, ২০২৩ সালের ২৩ নভেম্বর আনুষ্ঠানিকভাবে চলতি আমন মৌসুমের ধান-চাল ও আতপ চাল কেনার ভার্চুয়ালি উদ্বোধন করেন খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার। আমন মৌসুমে জেলায় ৪৮টি অটো রাইস মিল ও ৩৬৮টি হাসকিং রাইস মিল সরকারি খাদ্য গুদামে চাল সরবরাহের চুক্তি করেন। উদ্বোধনের দিনে জেলায় ৪৪ টাকা কেজি দরে চাল কেনার লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১৭ হাজার ৩৫৯ মেট্রিক টন। পরবর্তী সময়ে অতিরিক্ত চালের বরাদ্দ আসে আরও ১০ হাজার ২৫৮ দশমিক ৯৬৯ মেট্রিক টন। এতে চলতি মৌসুমে জেলায় চাল কেনার লক্ষ্যমাত্রা দাঁড়ায় ২৭ হাজার ৫৯২ দশমিক ৯৬৯ মেট্রিক টনে। আজ ৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত জেলার ২০টি খাদ্য গুদামে ২৫ হাজার ৩১ দশমিক ৬৬০ মেট্রিক টন চাল কেনা সম্পন্ন হয়েছে। যা মোট বরাদ্দের ৯১ দশমিক ০৮ শতাংশ। চাল কেনা বাকি আছে দুই হাজার ৪৬১ দশমিক ৩০৯ মেট্রিক টন।
অপরদিকে ৪৩ টাকা কেজি দরে তিন হাজার ৬৫১ মেট্রিক টন আতপ চাল কেনার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়। ইতোমধ্যে দুই হাজার ৭২২ দশমিক ৭৯০ মেট্রিক টন আতপ চাল কেনা সম্পন্ন হয়েছে। যা লক্ষ্যমাত্রার ৭৫ শতাংশ। আতপ চাল কেনা বাকি আছে ৯২৮ দশমিক ২১০ মেট্রিক টন।
জেলার ১১টি উপজেলার ৩০ টাকা কেজি দরে ২০টি খাদ্য গুদামের মধ্যে মাত্র দুটি খাদ্য গুদাম ৪০৬ মেট্রিক টন ধান সংগ্রহ করতে পেরেছে। এর মধ্যে পত্নীতলা উপজেলার নজিপুর খাদ্য গুদাম ৪০৬ মেট্রিক টনের মধ্যে ৪০৫ মেট্রিক টন এবং নওগাঁ সদর খাদ্য গুদাম ৪০৬ মেট্রিক টন ধানের মধ্যে মাত্র এক মেট্রিক টন ধান সংগ্রহ করতে পেরেছে। যা লক্ষ্যমাত্রার মাত্র ৫ দশমিক ৩৩ শতাংশ। এবারে সাত হাজার ৬১৪ মেট্রিক টন ধান কেনার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা থাকলেও এখনও পর্যন্ত বাকি রয়েছে সাত হাজার ২০৮ মেট্রিক টন ধান কেনা। বলা চলে চলতি আমন ধান সংগ্রহ অভিযান একেবারে ভেস্তে গেছে।
সদর উপজেলার বক্তরাপুর ইউনিয়নের হালঘোষপাড়া গ্রামের কৃষক মো. আবেদ আলী জানান, সরকারি খাদ্য গুদামে ধান বিক্রি করা দুরূহ একটি কাজ। নানান ঝক্কি-ঝামেলা পোহাতে হয় ধান দিতে গিয়ে। ধান শুকাতে হয়, আর্দ্রতা ঠিক রাখতে হয়, ধানে ফ্যান দিয়ে পরিষ্কার করার পরও খাদ্য গুদামে ধান নিয়ে গেলে নানান রকমের সমস্যা তুলে খাদ্য গুদামে ধান নিতে চায় না। ফিরিয়ে দেয়। এ কারণে দীর্ঘ দিনের তিক্ত অভিজ্ঞতা থেকে কৃষকরা দিন দিন সরকারি খাদ্য গুদাম থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। এ ছাড়া, ধান কাটার পরপর বাজার দর ভালো থাকায় ভেজা ধানই কৃষকরা ভালো দামে সঙ্গে সঙ্গে হাট-বাজারে বিক্রি করতে পারে। নগদ টাকা পায়। দায়-দেনা শোধ করতে সুবিধা হয়। এসব কারণে কৃষকরা সরকারি খাদ্য গুদামে না গিয়ে বাজারে ধান বিক্রি করতে বেশি আগ্রহী।
একই রকম কথা জানালেন সদর খাদ্য গুদামের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. মাসুদ রানা। তিনি বলেন, সরকারি খাদ্য গুদামে ধান এবং চাল নেওয়ার ক্ষেত্রে কিছু নিয়মনীতি মানতে হয়। খাদ্য বিভাগের বিনির্দেশ মতো ধান চাল না হলে তা কেনা সম্ভব হয় না। চালের ক্ষেত্রে বিনির্দেশ মানা সম্ভব হলেও গ্রামের কৃষকদের পক্ষে বিনির্দেশ মেনে ধান সরকারি গুদামে দেওয়া সম্ভব না। তারপরও আমরা খাদ্য বিভাগের পক্ষ থেকে ধান সংগ্রহের জন্য লটারি করে রেখেছি। লটারিতে যেসব কৃষকের নাম উঠেছে তাদের ধান দেওয়ার জন্য বারবার তাগাদা দেওয়া হয়েছে। প্রতিটি উপজেলায় খাদ্য বিভাগের পক্ষ থেকে মাইকিং করা হয়েছে। তার পরও কৃষকরা সরকারি খাদ্য গুদামে ধান দিতে আসেনি। ধান দিতে অপরগতা প্রকাশ করেছে। এ কারণে চলতি আমন মৌসুমে নওগাঁয় ধান সংগ্রহ অভিযান সফলতার মুখ দেখেনি।
ধান সংগ্রহে কোনো অগ্রগতি নেই কেন প্রশ্ন করা হলে নওগাঁ জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক মো. তানভির রহমান বলেন, সরকারি বেঁধে দেওয়া দামের চাইতে ধানের দাম বাইরের বাজারে বেশি। মোটা ধানই হাটে বাজারে এক হাজার ২০০ টাকা মণ বিক্রি হচ্ছে। আমরা তো বিনির্দেশ সম্মত ধান নিয়ে থাকি। আর কৃষকরা ওই ভাবে ধান দিতে সবসময় আগ্রহী হয় না। যার কারণে কৃষকরা বাইরের হাট-বাজারে ধান বিক্রি করে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে, বেশি দাম পায়।
খাদ্য নিয়ন্ত্রক আরও বলেন, সরকারের উদ্দেশ্যে থাকে কৃষক ধানের ভালো দাম পেল কি না। সেদিক থেকে কৃষক খাদ্য গুদামে ধান না দিয়েও নায্যমূল্য পেলে সরকার খুশি। সরকার চায় কৃষক ধানের নায্য মূল্য পাক। সেটা যেভাবেই হোক নিশ্চিত হচ্ছে।
আরেক প্রশ্নের উত্তরে খাদ্য নিয়ন্ত্রক জানান, আজ পর্যন্ত সিদ্ধ চাল ৯১ দশমিক ০৮ শতাংশ, আতপ চাল ৭৫ শতাংশ কেনা সম্পন্ন হয়েছে। আগামী ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সময়সীমা আছে। আমরা আশা করছি চালের লক্ষ্যমাত্রা আমরা পূরণ করতে পারব। আমাদের সংগ্রহ অভিযানও সফল হবে।