আর কত বয়স হলে বয়স্ক ভাতা পাবেন তাঁরা
ঝিনাইদহের শৈলকুপা উপজেলার ৩ নং দিগনগর ইউনিয়নের দিগনগর গ্রামের পাকা রাস্তার পূর্বপাশে তাঁদের বাড়ি। তাঁরা হলেন শতবর্ষী আমির-হামিদা দম্পতি। ছেলের বিধবা স্ত্রী, তিন নাতিসহ ছয়জনের সংসার। সম্পদ বলতে ভিটে বাড়ি, আর মাঠে মাত্র ১০ কাঠা জমি। তাও আবার বর্গা দেওয়া। তাই পুষ্টিকর খাবার পেটে পড়েনি তাঁদের। বুকের হাড়গুলো যেন বের হয়ে আসছে। অজানা ভয়ে আড়ষ্ট তাঁরা। লজ্জায় কারো কাছে হাত পাততে পারেন না তাঁরা।
একসময় আমির-হামিদা দম্পতির পরিবার অনেক সুখী ছিল। টিনের ছাউনি দেওয়া ইটের দেওয়াল ঘর। পূর্ব কোণে অন্য ঘরগুলো ভেঙে পড়েছে। এক সময় গেরস্ত বাড়ি ছিল এটি। গোয়াল ভরা গরু ছিল, গোলাভরা ধান। এখন বড় অসহায় হয়ে পড়েছেন তাঁরা।
তবে আজও বয়স্ক ভাতার তালিকায় নাম উঠেনি এ দম্পতির। আর কত বয়স হলে ‘বয়স্ক ভাতা’ পাবেন আমির-হামিদা দম্পতি?
আজ রোববার (১৪ এপ্রিল) দুপুরে প্রতিবেদকের সঙ্গে নিজ বাড়ির বারান্দায় বসে জীবনের কথাগুলো বলছিলেন বৃদ্ধ আমির হোসেন ও হামিদা খাতুন।
ঝিনাইদহ জেলা সমাজসেবা অফিসের সহকারী পরিচালক মোমিনুর রহমান জানালেন পুরুষের বয়স ৬৫ বছর এবং নারীর বয়স ৬২ হলে বয়স্ক ভাতা পাবেন।
মো. আমির হোসেন বিশ্বাসের দাবি তাঁর প্রকৃত বয়স ১১০ বছর। জাতীয় পরিচয়পত্র মোতাবেক ৯৩ বছর। মোছা. হামিদা খাতুনের বয়সও প্রায় শত বছর। জাতীয় পরিচয়পত্র মোতাবেক ৮১ বছর।
এ দম্পতি বললেন, ‘বাবা আমাদের কেউ নেই, আর কত বয়স হলে বয়স্ক ভাতা পাব আমরা?’
আমির-হামিদা সাত মেয়ে দুই ছেলের জনক-জননী। মেয়েরা স্বামীর সংসারে। ছোট ছেলে আব্দুল আজিজ ছোটকালেই মারা গেছে। বড় ছেলে আরিফুজ্জামান কিছু দিন আগে আত্মহত্যা করেছেন। বৃদ্ধ আমির হোসেন দুই ছেলের মরদেহই কাঁধে নিয়ে কবর দিয়েছেন। তিন নাতির জন্য আরও কিছু দিন পৃথিবীতে থাকতে চান তাঁরা। কিন্তু কীভাবে?
জাতীয় পরিচয়পত্র সূত্রে জানা যায়, মো. আমির হোসেন বিশ্বাসের জন্ম ১৯৩১ সালের জানুয়ারি মাসের ১ তারিখ। স্ত্রী মোছা. হামিদা খাতুনের জন্ম (জাতীয় পরিচয়পত্র মোতাবেক) ১৯৪৩ সালের ১ জানুয়ারি। তবে আমির হোসেন দাবি করেছেন তার বয়স এখন ১১০ বছর। দেশভাগের কিছুদিন পর (হিন্দুস্থান-পকিস্তান) সংসার পেতেছিলেন তারা। সাত মেয়ে আলেয়া, ছালেহা, সাহিদা, চায়না, পান্না, জেসমিন, নাহিদা বিয়ের পর স্বামীর সংসারে চলে গেছেন। দুই ছেলের মধ্যে বড় ছিলেন আরিফুজ্জামান। তিনি ঝিনাইদহ সরকারি কেশবচন্দ্র মহাবিদ্যালয়ে বিএ পড়া অবস্থায় নাইচ খাতুনকে বিয়ে করেন। তাঁদের দুই ছেলে এক মেয়ে। বড় ছেলে নুরুজ্জামান নাইম ১০ শ্রেণির শিক্ষার্থী। মেয়ে আফরিন আক্তার নবম শ্রেণিতে পড়ে। ছোট ছেলে আজিম। বয়স মাত্র ৯ বছর। দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ে। মৃত্যুর আগে মা-বাবা স্ত্রী সন্তানদের নিয়ে একটু ভালোভাবে বেঁচে থাকার জন্য মাঠে জমি জমা বিক্রি করে দুই দফায় মালোয়েশিয়া পাড়ি জমিয়ে ছিলেন। পরিবারে সচ্ছলতা ফেরাতে। করোনার সময়ে কর্ম চলে যায় তাঁর। দেশে ফিরে আসতে বাধ্য হন তিনি।
আরিফুজ্জামান ২০২৩ সালে আরেক দফায় বিদেশ যেতে চাইলে যশোরের শার্শা উপজেলার গৌরপাড়া গ্রামের মশিউর দালাল চার লাখ টাকা হাতিয়ে নেন। ভুয়া ওয়ার্ক পারমিটে তাঁকে থাইল্যান্ড পাঠিয়ে দেন দালাল। থাইল্যান্ডে জঙ্গল থেকে গ্রেপ্তার হয়ে হন তিনি। থাইল্যান্ড কারাগারে চার মাস কারাভোগের পর বাড়ি ফিরে আসতে হয় তাকে। দেশে ফিরে এলে হতাশা ঘিরে ধরে তাঁকে। পরে ২০২৩ সালের ২৬ অক্টোবর ঘুমের বড়ি খেয়ে আত্মহত্যা করেন তিনি।
ছেলের বউ (আরিফুজ্জামানের বিধবা স্ত্রী) নাইচ খাতুন বলেন, বয়স্ক ভাতার কার্ড দেওয়ার কথা বলে দুই বার ভোটার আইডি কার্ড জামা দিয়েছি। লাভ হয়নি। স্বামীর বোনদের সহযোগিতায় এক বেলা আধা বেলা খেয়ে না খেয়ে কাটছে তাদের জীবন। বৃদ্ধ শ্বশুর-শাশুড়ি আর তিন সন্তান নিয়ে কী করবেন তা বুঝে উঠতে পারছেন না তিনি। ছেলে-মেয়েদের লেখাপড়া বন্ধের উপক্রম।
কথা বলার ফাঁকে ফাঁকে বৃদ্ধা হামিদা খাতুনের চোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছিল। ভালো ভাবে কথা বলতে পারছিলেন না তিনি। একপর্যায়ে প্রতিবেদকের হাত ধরে কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন ‘বাবা আমাদের কেউ নেই।’
প্রাপ্ত তথ্য মতে সরকার থেকে অসচ্ছল বয়স্ক নারী-পুরুষকে ৬০০ টাকা করে ভাতা দেওয়া হয়ে থাকে। শৈলকুপা উপজেলা পৌরসভাসহ ১৫টি ইউনিয়নে ভাতাভোগীর সংখ্যা ২২ হাজার ১০ জন। দিগনগর ইউনিয়নে ভাতা দেওয়া হচ্ছে এক হাজার ২২৩ জনকে। আমির হোসেন বিশ্বাস কিংবা তাঁর স্ত্রী মোছা. হামিদা খাতুনের নাম ওই তালিকাতে অন্তর্ভুক্ত হয়নি। এ নিয়ে তদন্ত কমিটি গঠনের দাবি তুলেছেন জেলা সিটিজেন ফোরামের নেতারা।
এ বিষয়ে শৈলকুপা উপজেলা সমাজসেবা অফিসার শরিফ উদ্দিন সমুনের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি বলেন, ইউনিয়ন পর্যায়ের কমিটির দায়িত্বহীনতার কারণে ঘটনাটি ঘটেছে। আসছে তিন মাসের মধ্যে আমির হোসেন বিশ্বাস ও হামিদা খাতুনের বয়স্ক ভাতার ব্যবস্থা করা হবে।