বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে অংশ নিয়ে হাতহারা মামুন
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে অংশ নিয়ে দুই হাত হারিয়েছেন তিনি। ফলে সারা জীবনের জন্য কর্মক্ষমতা হারিয়ে স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে এগোচ্ছেন। তিনি হলেন ভৈরবের লক্ষ্মীপুর এলাকার মৃত জাহের মিয়ার ছেলে মামুন।
মা, স্ত্রী মৌসুমী আর দুই শিশু সন্তান আবু হুরায়রা ও মুবাশ্বিরাকে নিয়ে মামুনের সংসার। হাতহারা মামুনের জীবন এখন গভীর অন্ধকারাচ্ছন্ন। পরিবারের ভরণপোষণ জোগাড়ে পুরোপুরিই অক্ষম তিনি।
পঁয়ত্রিশ বছরের টসবগে যুবক মামুন। ট্রাক্টর চালিয়ে ও দিনমজুরি করে চলত তাঁর সংসার। ৮০০ থেকে হাজার টাকা রোজগার করতেন প্রতিদিন। এতে বেশ ভালোই কেটে যাচ্ছিল তাঁর সংসার।
স্বল্পশিক্ষিত মামুন রাজনৈতিকভাবে বেশ সচেতন। তাই স্বৈরাচার হাসিনার বিরুদ্ধে প্রতিটি আন্দোলন-সংগ্রামে অংশ নেন স্বতঃস্ফূর্তভাবে।
মামুন জানান, গত ১৯ জুলাই শুক্রবার নিজের কাজ ফেলে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে অংশ নেন। ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের লক্ষ্মীপুর শহীদুল্লাহ কায়সার পাদুকা সুপার মার্কেট এলাকায় প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। সবাই মিলে আটকে দেন যানবাহন চলাচল।
খবর পেয়ে ছুটে আসে কয়েকশ পুলিশ। তাদের সঙ্গে দেশীয় মারাত্মক সব অস্ত্র-শস্ত্র নিয়ে যোগ দেয় ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ, অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের শত শত নেতাকর্মী। চলে পুলিশ-আওয়ামী লীগ ও ছাত্র-জনতার ত্রিমুখী ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া। এলাকা পরিণত হয় রণক্ষেত্রে।
ছাত্র-জনতার ছোড়া ইট-পাটকেলের জবাবে পুলিশ মুহুর্মুহু ছুড়তে থাকে টিয়ারশেল, রাবার বুলেট আর সাউন্ড গ্রেনেড। আর রাজনৈতিক কর্মীরাও ছুড়তে থাকে ইটপাটকেল।
ধাওয়া-পাল্টাধাওয়ার একপর্যায়ে পা পিছলে মহাসড়কে হোচট খেয়ে পড়ে যান মামুন। তখন তাঁকে ফেলে রেখে তাঁর পক্ষের লোকজন চলে যায় আড়ালে। এই ফাঁকে প্রতিপক্ষের লোকজন তাঁকে ঘিরে ফেলে রাম দা দিয়ে কুপিয়ে মৃত ভেবে ফেলে রেখে যায়।
খবর পেয়ে পরে মামুনের স্বজনরা এসে গুরুতর আহত অবস্থায় উদ্ধার করে স্থানীয় উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে গেলে চিকিৎসক পাঠান বাজিতপুরের ভাগলপুর জহুরুল ইসলাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। সেখানকার চিকিৎসকরা অবস্থা বেগতিক দেখে পাঠান ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। সেখানেও তাঁর চিকিৎসা সম্ভব না হওয়ায় পাঠানো হয় ঢাকায় পঙ্গু হাসপাতালে। সেখানে বেশ কিছুদিন চিকিৎসার পর চিকিৎসকরা তাঁর ডান হাতটি কনুই পর্যন্ত কেটে ফেলতে বাধ্য হন। আর বাম হাতের হাঁড়গুলো টুকরো টুকরো হয়ে যাওয়ায় অপারেশন করে রড ঢুকিয়ে দিয়েছেন আপাতত। তবে সেটিও টিকিয়ে রাখা অসম্ভব বলে স্বজনদের জানিয়েছেন চিকিৎসকরা।
মামুন জানান, দিনমজুরি করে সংসার ভালোই চলছিল। দুই হাত হারিয়ে বর্তমানে তিনি পুরোপুরি কাজ করতে অক্ষম হয়ে পড়েছেন। সরকার যদি তাঁর পাশে সহায়তার হাত না বাড়ায়, পরিবার নিয়ে তাঁর বেঁচে থাকা দায় হয়ে পড়বে।
বুকফাটা আর্তনাদ করে মামুনের মা জোসনা বেগম বলেন, ‘তরতাজা ছেলের এই অবস্থা দেখতে পারি না। বুকটা ফেটে যায়। আমার ছেলের এমন নির্মম অবস্থা যারা করেছে আমি তাদের ফাঁসি চাই। আমার এই অসহায় ছেলের পাশে সরকার এসে দাঁড়াক, আমি এটি চাই।’
মামুনের স্ত্রী মৌসুমী জানান, দিনমজুর স্বামীর রোজগারে সংসার ভালোই চলছিল। কিছু দিন আগে দুটি এনজিও থেকে ৩০ হাজার করে ৬০ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে বসবাসের একমাত্র ঘরটি মেরামত করেছেন। এখন স্বামীর রোজগার নেই। ঋণ কিভাবে শোধ করবেন?
মৌসুমী আরও জানান, এইচএসসি পাস তিনি। তার যোগ্যতা অনুযায়ী সরকারি বা বেসরকারি কোনো প্রতিষ্ঠানে একটি চাকরি দিলে তিনি অসুস্থ স্বামী আর সন্তানদের নিয়ে জীবন চালিয়ে নিতে পারতেন। এ বিষয়ে তিনি সবার সহযোগিতা কামনা করেছেন।
মামুনের উপর এই বর্ববর হামলার বিচার চান প্রতিবেশী মো. ইদু মিয়া, সাহাজ উদ্দিন। তাঁরা চান সরকারি সহায়তায় মামুনের সংসারটি টিকে থাকুক। সরকারি-বেসরকারি কোনো একটি প্রতিষ্ঠানে একটি চাকরি হোক মামুনের স্ত্রীর। আর ঋণমুক্তি ও চিকিৎসা চালিয়ে যাওয়ার জন্য জরুরি ভিত্তিতে প্রবাসীদের কাছে আর্থিক সহায়তাও দাবি তাঁদের।