ঢাকা জেলার সব থানার ওসি একযোগে বদলি
ঢাকা জেলার সাতটি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ও পুলিশ পরিদর্শক পদে কর্মরত সবাইকে একযোগে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। বাদ পড়েননি আদালত পরিদর্শক ও দুই গোয়েন্দা কার্যালয়ের ওসিরাও। একযোগে সব থানার ওসিদের বদলির বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন ঢাকা জেলার পুলিশ সুপার (এসপি) আহম্মদ মুঈদ।
স্বৈরাচার শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর সৃষ্ট পরিবর্তিত পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে ঢাকা জেলা পুলিশকে ঢেলে সাজাতে এবং জনবান্ধব করতে এ উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা।
সূত্রে জানা গেছে, ঢাকা জেলার থানাগুলোতে নতুন করে দায়িত্ব নেওয়া কর্মকর্তারা দীর্ঘদিন ধরে ছিলেন বঞ্চিত এবং নানাভাবে বৈষম্যের শিকার। তারা বিশেষ করে সততা ও অভিজ্ঞতা থাকা সত্ত্বেও দলবাজি ও লবিংয়ে পেছনে থাকা পুলিশ কর্মকর্তা। নতুন ওসিদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তারা কখনো ঢাকা জেলার বিভিন্ন থানায় ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালনের বিষয়টি স্বপ্নেও ভাবেননি। এখন তারাই দায়িত্ব পেলেন গুরুত্বপূর্ণ এই জেলার বিভিন্ন থানার।
সূত্রমতে, ক্ষমতাচ্যুত শেখ হাসিনা সরকারের আমলে ঢাকা জেলার বিভিন্ন থানায় ওসির দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে গুনতে হতো মোটা অঙ্কের নজরানা। নানাজনকে ‘খুশি’ করে আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী মহলের সংকেতেই ‘প্রাইজ পোস্টিং’ হিসেবে আসতে হতো ঢাকার বিভিন্ন থানায়। এমনই একজন সুবিধাভোগী এ এফ এম সায়েদ। সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের দাপটে এ এফ এম সায়েদ ঢাকা জেলাতেই একটানা চাকরি করেছেন ১০ বছর ১০ মাস ছয় দিন। মাঝের কিছুদিন নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ থানায় চাকরি করলেও ফের ঢাকা জেলায় বদলি হয়ে যোগ দেন আশুলিয়া থানায়। বছরের পর বছর মেধা ও যোগ্যতার বাইরে গিয়ে পদায়ন করা হতো এসব থানায়। এমনকি, ঢাকায় ওসিদের বদলি করার ক্ষমতা কখনোই প্রয়োগ করতে পারেননি এসপি। বারংবার পুলিশ সদরদপ্তরে চাহিদা পাঠিয়েও অনেক দুর্নীতিপরায়ণ কর্মকর্তাকে পদ থেকে সরানো যায়নি। প্রভাবশালী মহলের দাপটে ওসিদের কাছে এসপিরা ছিলেন অসহায়। অনেক ক্ষেত্রে উল্টো ওসিদের দেখা যেত এসপিদের বদলির তদবির করতে।
ঢাকা জেলার পুলিশ সুপার (এসপি) আহম্মদ মুঈদ স্বাক্ষরিত অফিস আদেশের তথ্য অনুযায়ী, সাভার মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার (ওসি) পদে যোগ দিয়েছেন মোহাম্মদ জুয়েল মিঞা। আশুলিয়া থানায় মো. আবু বকর সিদ্দিক, ধামরাই থানায় মো. মনিরুল ইসলাম, কেরানীগঞ্জ মডেল থানায় মুহাম্মদ সোহরাব আল হোসাইন, দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানায় মোহাম্মদ মাজহারুল ইসলাম, নবাবগঞ্জ থানায় মো. মমিনুল ইসলাম, দোহার থানায় মো. রেজাউল করিম, ঢাকা উত্তর গোয়েন্দা পুলিশে জালাল উদ্দিন, ঢাকার দক্ষিণ গোয়েন্দা পুলিশে সাইদুল ইসলাম, কোট পুলিশ পরিদর্শক (প্রশাসন) পদে সৈয়দ মোহাম্মদ আক্তার হোসেন, সাভার মডেল থানার পুলিশ পরিদর্শক (তদন্ত) পদে মো. আশিক ইকবাল এবং আশুলিয়া থানার পুলিশ পরিদর্শক (তদন্ত) পদে বদলি করা হয়েছে মো. কামাল হোসেনকে।
যোগাযোগ করা হলে সদ্য যোগ দেওয়া একটি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকতা (ওসি) নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘আমরা কোনো তদবিরের জোরে দায়িত্বে আসিনি। কারো মুখের দিকে তাকিয়ে কর্তব্য পালনের কোনো সুযোগ নেই। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠাই আমাদের প্রত্যয়।’
নতুন দায়িত্ব পাওয়া এই ওসি আরও বলেন, ‘দীর্ঘদিন পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনে (পিবিআই) কাজ করেছি। কখনো কল্পনাও করিনি ঢাকার গুরুত্বপূর্ণ থানায় ওসির দায়িত্ব পালনের সুযোগ আসবে। আমরা নিষ্ঠার সঙ্গে এই দায়িত্ব পালনে বদ্ধপরিকর। পুলিশের প্রতি আস্থা ফিরিয়ে আনাই আমাদের বড় চ্যালেঞ্জ।’
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলন দমাতে তৎকালীন স্বৈরাচারী আওয়ামী লীগ সরকার পুলিশ বাহিনীকে দলীয় বাহিনী হিসেবে ব্যবহার করে। পুলিশের পাশাপাশি লেলিয়ে দেওয়া হয় দলীয় সশস্ত্র সন্ত্রাসীদেরকেও।
গত ১৮ জুলাই সাভারে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে যোগ দিয়ে পুলিশের গুলিতে প্রথম শহীদ হন মিরপুর মিলিটারি ইনস্টিটিউট অফ সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজির কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী শাইখ আসহাবুল ইয়ামিন। গুলিবিদ্ধ ইয়ামিনকে পুলিশের সাঁজোয়া যানেই ওপর ঘুরিয়ে পরে সড়কে ফেলে দেওয়ার দৃশ্য ভাইরাল হয়, যা আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমেও ফলাও করে প্রচার করা হয়। আন্দোলন পায় তীব্র মাত্রা। ইউনিট কমান্ডার হিসেবে সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানের প্রভাবে ২৯তম ব্যাচের পুলিশ কর্মকর্তা ঢাকা জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আব্দুল্লাহ হিল কাফীর নেতৃত্বে ব্যাপক হত্যাযজ্ঞে মেতে ওঠে পুলিশ।
ঢাকা জেলার কেবল সাভারেই পুলিশের গুলিতে মারা যান ছাত্র-জনতা মিলিয়ে ৭৫ জন। গুলিবিদ্ধ হয় চার শতাধিক মানুষ। এদের মধ্যে অনেকেই চিরতরে অন্ধ ও পঙ্গু হয়ে গেছেন।
এ ছাড়া গত ৩০ আগস্ট একটি ভিডিও ক্লিপ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপক ভাইরাল হয়। ভাইরাল হওয়া ১ মিনিট ১৪ সেকেন্ডের ভিডিওতে দেখা যায়, আশুলিয়া থানার সামনে গুনে গুনে লাশ ভ্যানে স্তূপ করে তোলা হচ্ছে। পরে তা পুড়িয়ে দেওয়ার মতো গণহত্যার প্রমাণস্বরূপ সেই পৈশাচিক ঘটনা নজর কাড়ে সারা বিশ্বের। সরিয়ে দেওয়া হয় আশুলিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) এ এফ এম সায়েদকে। তাকে বদলি করা হয় কক্সবাজারের উখিয়ায় ১৪ আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নে। তা সত্বেও তিনি যোগ দেননি কর্মস্থলে।
গত ২ সেপ্টেম্বর রাতে দেশ ছেড়ে পালানোর চেষ্টাকালে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে ঢাকা জেলার তৎকালীন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (বর্তমানে বরখাস্ত এবং ডিমান্ডে আছেন) আব্দুল্লাহ হিল কাফীকে আটক করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি)।
অন্যদিকে, আশুলিয়ায় লাশ পোড়ানোর ঘটনায় সম্পৃক্ত ঢাকা জেলা গোয়েন্দা পুলিশের (উত্তর) পরিদর্শক (তদন্ত) আরাফাত হোসেনকে গত ১৩ সেপ্টেম্বর ভোরে রাজধানীর আফতাবনগর থেকে গ্রেপ্তার করে র্যাব। ছাত্র-জনতার ক্ষোভের আগুনে পুড়ে যায় সাভার মডেল থানা, আশুলিয়া থানা ও ধামরাই থানা।
এমন পরিস্থিতিতে জেলা পুলিশকে খোলনলচে বদলে ফেলার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় পুলিশের ঊর্ধ্বতন পর্যায়ে। এ বিষয়ে ঢাকা জেলার পুলিশ সুপার আহম্মদ মুঈদ বলেন, ‘ছাত্র–জনতার আত্মত্যাগের মাধ্যমে আমরা দায়িত্বে এসেছি। ২৪তম ব্যাচের পুলিশ কর্মকর্তা হিসেবে আমি নিজেও দীর্ঘদিন বঞ্চিত ছিলাম। আমি বুঝি বঞ্চিত ও বৈষম্যের শিকার মানুষদের দুর্দশার কথা। তাই শহীদদের আত্মত্যাগ আমরা বৃথা যেতে দেব না। পুলিশকে সত্যিকার অর্থে গণবান্ধব পুলিশ হিসেবে গড়ে তোলাই এখন আমাদের চ্যালেঞ্জ। যার রূপরেখার অংশ হিসেবে এই ব্যাপক রদবদল।’