রিজার্ভ চুরির ঘটনায় সিআইডির তদন্ত প্রশ্নবিদ্ধ ও এখতিয়ারবহির্ভূত : দুদক
সাবেক গভর্নর ড. আতিয়ার রহমানের সময়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে হ্যাকিংয়ের মাধ্যমে ৮ কোটি ১০ লাখ ডলার লুটের ঘটনায় তদন্ত করতে চায় দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। রিজার্ভ চুরি হওয়ার নয় বছরেও সুষ্ঠু তদন্ত করতে ব্যর্থ হওয়ায় এবং প্রকৃত অপরাধীদের বিরুদ্ধে প্রতিবেদনে ব্যর্থ হওয়ায় সিআইডির সাবেক কর্মকর্তাদের কার্যক্রম নিয়েও প্রশ্ন তুলেছে দুদক।
দুর্নীতি দমন কমিশনের অনুবিভাগ থেকে বলা হয়, রিজার্ভ চুরির ঘটনাটি দুদকের তফসিলভুক্ত। রিজার্ভ চুরির ঘটনাটি দুদকের তফসিলভুক্ত অপরাধ। শেখ হাসিনা সরকার ঘটনাটি ধামাচাপা দিতে একটি সাজানো মামলা করে তদন্তের দায়িত্ব দিয়েছিল সিআইডিকে। ঘটনার ৩৯ দিন পর মতিঝিল থানায় মামলা করা হয়। মামলায় চুরিসহ তিনটি ধারা অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
দুদুকের অনু বিভাগের এক কর্মকর্তা বলেন, রিজার্ভ চুরির ঘটনাটি ঘটেছে মূলত হ্যাকিংয়ের মাধ্যমে, কিন্তু মামলায় কৌশলে চুরির ধারা দেওয়া হয়। আইনে হ্যাকিংয়ের স্পষ্ট ধারা থাকলেও সেটি মামলায় উল্লেখ করা হয়নি, যাতে অভিযোগপত্র দিলেও মামলাটি বিচারে গিয়ে আসামিরা ছাড় পান। আসামিদের সুবিধা দিতেই এই ধারা যুক্ত করা হয়। ৩১ ডিসেম্বর মামলাটি তদন্তের দায়িত্ব চেয়ে সিআইডিকে চিঠি পাঠানো হয়েছে। তবে এখনো সিআইডি থেকে উত্তর পাওয়া যায়নি।
দুদক বলছে, গত ৩১ ডিসেম্বর মামলাটি তদন্তের দায়িত্ব চেয়ে সিআইডিকে একটি চিঠি পাঠানো হয়েছে। ২ জানুয়ারি দুদকের চিঠিটি পেয়েছে সিআইডি। তবে এখনো সিআইডি থেকে কোনো সিদ্ধান্ত দেওয়া হয়নি।
এ বিষয়ে দুদকের মহাপরিচালক মো. আক্তার হোসেন এনটিভি অনলাইনকে বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে ৮ কোটি ১০ লাখ মার্কিন ডলার সরিয়ে নিয়েছিল হ্যাকাররা। ওই ঘটনায় মতিঝিল থানায় যে মামলা হয়েছিল। এখন মামলাটির তদন্তে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) কাজ করতে চায়। ২০১৬ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি রাতে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে ৮ কোটি ১০ লাখ মার্কিন ডলার চুরি হয়। দুর্বৃত্তরা সুইফট পেমেন্ট পদ্ধতিতে প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক অব নিউইয়র্কে রাখা বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে ওই বিপুল পরিমাণ টাকা সরিয়ে নেয়। এই অর্থ ফিলিপাইনের মাকাতি শহরে রিজাল ব্যাংকের শাখায় চারটি অ্যাকাউন্টে যায় এবং সেখান থেকে দ্রুত টাকা উত্তোলন করা হয়। এর মধ্যে ৩৪ শতাংশ অর্থ ফেরত পাওয়া গেছে। বাকিটা এখনো ফিলিপাইনের একটি ব্যাংকে জমা রয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক ফিলিপাইন ব্যাংকের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের আদালতে একটি মামলা করেছে। মামলায় জিততে পারলে বাকি টাকা ফেরত পাওয়া যাবে।
জানা যায়, সুইফট সিস্টেমের নিরাপত্তা-ব্যবস্থা সংরক্ষণে অবহেলা ও গাফিলতির কারণে হ্যাকাররা দেশের রিজার্ভের টাকা সরিয়ে নিতে সক্ষম হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের ফরেন রিজার্ভ সুইফট (সোসাইটি ফর ওয়ার্ল্ডওয়াইড ইন্টার ব্যাংক ফিন্যান্সিয়াল টেলিকমিউনিকেশন) সার্ভার একটি সংবেদনশীল ব্যবস্থা। তা সত্ত্বেও গভর্নর সুইফটের মাধ্যমে আরটিজিএসের (রিয়েল টাইম গ্রস সেটেলমেন্ট) সংযোগ করার অনুমোদন দেন এবং বাস্তবায়ন নিশ্চিত করেন। এটাকে অপরাধমূলক উদ্দেশ্য হিসেবে চিহ্নিত করেছেন তদন্তকারীরা। আরটিজিএস একটি বিশেষায়িত তহবিল স্থানান্তর ব্যবস্থা, যার মাধ্যমে এক ব্যাংক থেকে অন্য ব্যাংকে তাৎক্ষণিক তহবিল স্থানান্তর করা যায়।
ইতোমধ্যে রিজার্ভ চুরির ঘটনায় বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর আতিউর রহমানসহ ১৪ জনের বিদেশযাত্রায় নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে ইমিগ্রেশন পুলিশ। বিদেশযাত্রায় নিষেধাজ্ঞা পাওয়া ১৪ জনের মধ্যে চারজন ছাড়া অন্যদের নাম–পরিচয় পাওয়া গেছে। তাঁরা হলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর আতিউর রহমান, সামিট অ্যালায়েন্স পোর্ট ও ইনস্টিটিউট অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের সাবেক পরিচালক আনিসউদ্দিন আহমেদ খান ওরফে আনিস এ খান, বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক মেইন্টেন্যান্স ইঞ্জিনিয়ার দীপঙ্কর কুমার চৌধুরী, সাবেক উপমহাব্যবস্থাপক এস এম রেজাউল করিম, সাবেক নির্বাহী পরিচালক শুভংকর সাহা, মামলার বাদী জুবায়ের বিন হুদা, সাবেক উপপরিচালক (সুইফট অপারেটর) জি এম আব্দুল্লাহ সালেহীন, সহকারী পরিচালক শেখ রিয়াজ উদ্দিন, কর্মকর্তা একলাস উদ্দিন ও বর্তমান নির্বাহী পরিচালক মেজবাউল হক।
রিজার্ভ চুরির ঘটনায় মামলার সিডি, আলামতসহ অন্যান্য রেকর্ডপত্র চেয়ে সিআইডির কাছে পাঠানো দুদকের চিঠিতে বলা হয়েছে, দণ্ডবিধির ২১ ধারা, দুর্নীতি প্রতিরোধ আইন ও ব্যাংক কোম্পানি আইন অনুযায়ী বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নরসহ জড়িত কর্মকর্তারা সরকারি কর্মচারী বা পাবলিক সার্ভেন্ট। এটা দুদকের তফসিলভুক্ত অপরাধ। তাই মামলাটি দুদকের কাছে হস্তান্তরের জন্য অনুরোধ করা হয়েছে।