একটি অধ্যায়ের সমাপ্তি

প্লেব্যাক সম্রাট হিসেবে পরিচিত ছিলেন বরেণ্য সংগীতশিল্পী এন্ড্রু কিশোর। চলচ্চিত্রে অসংখ্য জনপ্রিয় গান উপহার দিয়েছেন। শুধু তাঁর গানের জন্য অনেক ছবি হিট হয়েছে বলে মনে করেন অনেকে। তাঁর মৃত্যুতে একটি অধ্যায়ের সমাপ্তি হলো।
এন্ড্রু কিশোরের মৃত্যুতে সংগীতাঙ্গনে শোকাবহ বিরাজ করছে। দীর্ঘদিন ক্যানসারের সঙ্গে লড়াই করে গতকাল সন্ধ্যায় হার মানেন বাংলাদেশি চলচ্চিত্রের প্লেব্যাক সম্রাট। তাঁর মৃত্যুতে বিভিন্ন অঙ্গনের তারকা থেকে শুরু করে শোক জানিয়েছেন সর্বস্তরের মানুষ।
বরেণ্য গীতিকার-সুরকার গাজী মাজহারুল আনোয়ার এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘নিজের কাজ দিয়ে একেকটি মানুষ নিজের পরিমণ্ডল তৈরি করে। তৈরি হয় একটি অধ্যায়ের। এন্ড্রু কিশোরের চলে যাওয়ার সঙ্গে একটি অধ্যায়ের সমাপ্তি হলো। তাঁকে হারানোর ক্ষতি কখনো পুষিয়ে নেওয়া যাবে না। বাংলা চলচ্চিত্রে এক অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে গেল। আমি তাঁর আত্মার শান্তি কামনা করছি।’
প্রিয় শিল্পীর মৃত্যু কিছুতেই মেনে নিতে পারছেন না সংগীতশিল্পী সাবিনা ইয়াসমিন। এনটিভি অনলাইনকে তিনি বলেন, ‘এন্ড্রুদার মৃত্যুর খবর শোনার পর থেকে আমি অসুস্থবোধ করছি। তাঁকে নিয়ে কিছু বলার মতো অবস্থা নেই আমার। নিজেকে বোঝাতে একটু সময় লাগবে। সব সময় সব কিছু মেনে নেওয়াটা অনেক কঠিন। এটি আমি মেনে নিতে পারছি না।’
‘একদিন তোমাকে না দেখলে বড় কষ্ট হয়’, ‘কিছু কিছু মানুষের জীবনে ভালোবাসা চাওয়াটাই ভুল’, ‘ভালো আছি ভালো থেকো’, ‘এ জীবনে যারে চেয়েছি’—এমন অসংখ্য জনপ্রিয় গান মানুষ গুনগুন করে গাইতেন। গ্রামের বিয়েবাড়ি, কোনো উৎসবে উচ্চস্বরে বেজে উঠত গানগুলো। এই গানগুলোতে এন্ড্রু কিশোরের সঙ্গে কণ্ঠ দিয়েছিলেন সংগীতশিল্পী কনকচাঁপা। এন্ড্রু কিশোরের মৃত্যু একটি অধ্যায়ের সমাপ্তি বলে মনে করেন তিনি।
এনটিভি অনলাইনকে কনকচাঁপা বলেন, ‘কিশোরদার মৃত্যুর সঙ্গে একটি অধ্যায়ের সমাপ্তি হয়ে গেল। একটা সময় ছিল, যখন চলচ্চিত্রের গান মানেই এন্ড্রু কিশোর। চারিদিকে শুধু তাঁর গাওয়া গানই বাজত। আমি নিজেও তাঁর অনেক বড় ভক্ত। আমি ভাগ্যবতী, কারণ দাদার সঙ্গে কিছু গান করার সুযোগ হয়েছিল। দাদার সঙ্গে বেশ কিছু স্টেজ শোতেও অংশ নিয়েছি। যে কারণে কাছাকাছি থেকে কাজ করার কিছুটা সুযোগ হয়েছিল আমার।’
কনকচাঁপা আরো বলেন, ‘দাদার কণ্ঠকে আমি বলতাম গলিত সোনা। আমার মনে হতো, তিনি যখন গান গাইতেন, তখন যেন তাঁর গলা দিয়ে সোনা গলে গলে পড়ত। দাদার সঙ্গে গান করতে অনেক বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতাম। সবাই এন্ড্রুদার জন্য দোয়া করবেন।’
আশি দশকে এন্ড্রু কিশোরের সঙ্গে পরিচয় সংগীতশিল্পী কুমার বিশ্বজিতের। একই অঙ্গনে কাজ করার সুবাদে তাঁদের মধ্যে রয়েছে ঘনিষ্ঠতাও। তিনি সাদা মনের মানুষ ছিলেন মনে করেন কুমার বিশ্বজিৎ। এনটিভি অনলাইনকে তিনি বলেন, ‘এন্ড্রুদা অনেক বড় মাপের শিল্পী ছিলেন। একজন শিল্পীর মধ্যে প্রথম যে গুণটি থাকা প্রয়োজন, সেটি হচ্ছে নিরহংকার মানুষ হতে হবে, যেটি আমি দাদার মধ্যে দেখেছি। তাঁকে আমার সব সময় সাদা মনের মানুষ মনে হতো। এই বিষয়টি এখনকার শিল্পীদের মধ্যে কমই দেখা যায়। তিনি আমাকে ছোট ভাইয়ের মতো স্নেহ-ভালোবাসা দিতেন। অসংখ্য চলচ্চিত্রে গান গেয়েছি একসঙ্গে। কাজ করার সুবাদে তাঁর কাছাকাছি থাকার সুযোগ হয়েছে। ফলে তাঁকে জানার সুযোগও আমার হয়েছিল। কিন্তু আজ সবই অতীত! তিনি নিজেই একটি অধ্যায় তৈরি করেছিলেন, যা তাঁর মৃত্যুতে শেষ হলো।’
‘হায় রে মানুষ রঙিন ফানুস দম ফুরাইলে ঠুস’ গানটি এখনো মানুষের মনে নাড়া দেয়। ‘বড় ভালো লোক ছিল’ চলচ্চিত্রের জন্য গানটি লিখেছিলেন সৈয়দ শামসুল হক। আর গানটি সুর করেন আলম খান। এন্ড্রু কিশোর চলচ্চিত্রে প্রথম প্লেব্যাক করেন আলম খানের হাত ধরে। মৃত্যুর খবরে নির্বাক আলম খান। গতকাল থেকে এন্ড্রু কিশোরের গান শুনছেন আর চোখের জল ফেলছেন।
কান্নাজড়িত কণ্ঠে আলম খান বলেন, ‘এন্ড্রু আমাকে আগেই বলেছিল, আমার সময় শেষ, আর ফেরা হবে না। সে আসলে জানত, তার শারীরিক অবস্থার কথা। বুঝতে পেরেছিল তার পরিণতি। শেষ যেদিন দেখা হয়েছিল, সেদিন বলেছিল, এখন শুধু দোয়া করবেন যেন ভালোভাবে যেতে পারি, কষ্ট যেন কম হয়। শুনে মনটা ভেঙে গিয়েছিল। সে তো চলেই গেল। সবাই দোয়া করবেন, যেখানেই থাকুক, যেন ভালো থাকে।’
প্লেব্যাক সম্রাট এন্ড্রু কিশোরকে নিয়ে স্মৃতিচারণ করেছেন কণ্ঠশিল্পী আসিফ আকবর। এনটিভি অনলাইনকে তিনি বলেন, ‘দাদা আমাকে ছোট ভাইয়ের মতো ভালোবাসতেন, আদর করতেন। আমাদের সম্পর্ক প্রায় ২২ বছরের। তিনি সব সময় আমাকে পরামর্শ দিতেন। আমার রাগ একটু বেশি, তাই তিনি আমাকে রাগ কমাতে বলতেন। তাঁর চলে যাওয়ায় ইন্ডাস্ট্রিতে খুব বড় ধরনের ক্ষতি হয়ে গেল। শেষ হলো একটি অধ্যায়ের। তাঁর শূন্যতা কোনোভাবেই পূরণ হবে না। এখন আমাদের উচিত তাঁকে যথাযথ সম্মান প্রদর্শন করা। তাঁর কাজ ও স্মৃতি সংরক্ষণ করা।’