এফডিসিতে ত্রাণ যাচ্ছে, সবাই কি পাচ্ছে?
বৈশ্বিক মহামারি করোনাভাইরাসের প্রকোপে স্তব্ধ বিশ্ব জনজীবন। মৃত্যুর হার বেড়েই চলেছে। দেশে দেশে চলছে লকডাউন। স্বাস্থ্যবিদেরা ঘরে থাকার পরামর্শ দিচ্ছেন। এরই মধ্যে বেশ কয়েকটি এলাকা লকডাউন করা হয়েছে। কর্মহীন হয়ে পড়েছে অসংখ্য দরিদ্র মানুষ। শুটিং বন্ধ। বিপাকে পড়েছেন চলচ্চিত্রকর্মীরাও।
এরই মধ্যে অসচ্ছল চলচ্চিত্রকর্মীদের দিকে সহায়তার হাত বাড়িয়েছেন বিত্তবানদের কেউ কেউ। পিছিয়ে নেই শিল্পীরাও। কোনো কোনো তারকা শিল্পীকে দেখা গেছে সাধারণ মানুষের হাতে নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রী তুলে দিতে। বিএফডিসিতেও অসচ্ছল শিল্পী ও কলাকুশলীদের মধ্যে নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রী বিতরণের চিত্র লক্ষ করা যাচ্ছে। কিন্তু ত্রাণসামগ্রী কি সবার কাছে পৌঁছাচ্ছে, না কি একটি অংশই ঘুরেফিরে পাচ্ছেন? এমন প্রশ্ন উঠেছে।
এরই মধ্যে এফডিসিতে ত্রাণ বিতরণ করেছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল, চিত্রনায়ক-প্রযোজক-ব্যবসায়ী অনন্ত জলিল, অভিনেতা মনোয়ার হোসেন ডিপজল ও মিশন সেফ বাংলাদেশ নামের একটি প্রতিষ্ঠান।
অভিযোগ রয়েছে, এফডিসিতে হাজারেরও বেশি অসচ্ছল শিল্পী ও কলাকুশলী থাকলেও ঘুরেফিরে তিনশর মতো মানুষ এসব ত্রাণ পাচ্ছেন। এঁদের মধ্যে দুই-তৃতীয়াংশই শিল্পী। কলাকুশলীদের মধ্যে সমস্যায় থাকা ৭০ ভাগ এসব নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রী পাচ্ছেন না।
একটি চলচ্চিত্রে কাজ করেন প্রায় দুইশ শিল্পী-কলাকুশলী। এর মধ্যে ৮০ শতাংশই কলাকুশলী। স্বপ্ন নিয়েই তাঁদের এফডিসিতে আসা। এঁদের অনেকে অসচ্ছল হলেও লাইনে দাঁড়িয়ে ত্রাণসামগ্রী নিতে অনিচ্ছুক। কেউ কেউ বলছেন, অনেকে ত্রাণ বিতরণ করেন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নিজেকে জাহির করার জন্য। সে কারণেও ‘ফটোসেশনের’ অংশীদার হতে চান না অনেকে।
একটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করতে চাইলে সহকারী পরিচালকের প্রয়োজন প্রায় পাঁচ-সাত জন। এঁদের অবশ্যই স্নাতক পাস হতে হবে। অন্যথায় তিনি কাজের অনুমতি পাবেন না। এফডিসিতে তাঁদের সংগঠন বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সহকারী পরিচালক সমিতি। এখানে সদস্য সংখ্যা প্রায় ৩০০। এঁদের মধ্যে বর্তমানে আর্থিক সমস্যায় রয়েছেন ৭০ জনের মতো। সমিতির সভাপতি কাজী মনির বলেন, ‘আমাদের সদস্যরা এসেছে চলচ্চিত্র নির্মাণ করতে। বর্তমান সময়ে প্রায় ৭০ জনের মতো সমস্যায় আছে, এঁরা সময়ের শিকার। না খেয়ে মরে গেলেও এঁরা লাইনে দাঁড়িয়ে ত্রাণসামগ্রী সংগ্রহ করবে না। নিজের সমস্যার কথা মুখ ফুটে বলবেও না।’
এফডিসিতে পাঠানো ত্রাণসামগ্রী খুব একটা পাননি জানিয়ে মনির বলেন, ‘অনন্ত (জলিল) সাহেব এফডিসিতে ত্রাণ দিয়েছেন। আমাদের সমিতিতে সাত প্যাকেট পাঠানো হয়েছিল। প্রযোজক সমিতির মাধ্যমে সেফ মিশন বাংলাদেশ নামের একটি প্রতিষ্ঠান ত্রাণ দিয়েছে, প্রযোজক সমিতির নেতা খসরু ভাই আমাদের সমিতির সদস্যদের জন্য আরো দিয়েছিলেন ১৫টি প্যাকেট। আমরা এ ছাড়া আর কোনো সাহায্য পাইনি। অবশ্য আমাদের কোনো সদস্য লাইনে দাঁড়িয়ে এসব সংগ্রহও করেননি।’
চলচ্চিত্রে নায়ক-নায়িকার রূপে মুগ্ধ হন সাধারণ দর্শক। মেকআপ শিল্পীর তুলির ছোঁয়ায় ঝলমলে হয় শিল্পীর মুখমণ্ডল। প্রত্যেকটি চলচ্চিত্রে এমন মেকআপ শিল্পী কাজ করেন চার-পাঁচ জন। এফডিসিতে তাঁদের সংগঠন চলচ্চিত্র রূপসজ্জাকর সমিতি। ত্রাণ নিয়ে সমিতির সভাপতি শামসুল ইসলাম বলেন, ‘আমাদের মোট ১২০ জন মেকআপ শিল্পী কাজ করেন। এর মধ্যে বর্তমানে সমস্যায় রয়েছেন ৩৫ জনের মতো। অনন্ত সাহেব যখন ত্রাণ দিয়েছেন, তখন আমাদের সমিতি থেকে নাম চাওয়া হয়। আমরা ২০ জনের নাম দিয়েছিলাম। এর মধ্যে দুজন ত্রাণ পেয়েছে। বিষয়টি জানার পর অনন্ত সাহেবের মেকআপম্যান আরো ১০টির মতো প্যাকেট এনে দেয়। দুদিন আগে এফডিসিতে ডিপজল সাহেব ত্রাণ দিয়েছেন, তখন শিল্পী সমিতি থেকে জায়েদ খান ফোন দিয়েছিলেন। তবে আমাদের কোনো সদস্য এই ত্রাণ গ্রহণ করেনি। কারণ দুটি, এক সেলফির ভয়, অন্যদিকে ৫০০ টাকার ত্রাণ আনতে গিয়ে ৩০০ টাকা খরচ।’
সিনেমার যে পোস্টার দেখে দর্শকের মনে চলচ্চিত্রটি দেখার জন্য আকর্ষণ তৈরি হয়, সেই পোস্টারের জন্য ছবি তোলেন স্থিরচিত্র গ্রাহক। এফডিসিতে তাঁদের সংগঠনের নাম বাংলাদেশ চলচ্চিত্র স্থিরচিত্র গ্রাহক সমিতি। বর্তমানে সক্রিয় চিত্রগ্রাহক আছেন ৪৫ জন। এঁদের মধ্যে কেউ ব্যবসা করছেন, কেউ ঢাকায় নিজে বাড়ি করেছেন। তবে ২৫ জনের মতো আছেন, যাঁরা শুধু স্থির চিত্রগ্রহণকেই পেশা হিসেবে নিয়েছেন। কাজ না থাকায় এঁদের মধ্যে অনেকেই বিপাকে পড়েছেন। এমনটা জানিয়ে সমিতির সভাপতি জি ডি পিন্টু বলেন, ‘আসলে আত্মসম্মান আমাদের মধ্যবিত্তদের জন্য সবচেয়ে বড় সমস্যা। কারণ আমরা মাথা নত করতে জানি না। যে কারণে হাত পাতার কথা আমাদের মাথায় আসে না। এফডিসিতে যে ত্রাণ দেওয়া হচ্ছে, তা আমাদের সংগঠনের কেউ গ্রহণ করেনি।’
পিন্টু আরো বলেন, ‘দুয়েকজন যে সমস্যায় নেই, বিষয়টা তা নয়। তবে এভাবে লাইনে দাঁড়িয়ে কেনই বা ত্রাণ নেবে। তবে চলচ্চিত্রকর্মী হিসেবে এই দুর্যোগে যদি কেউ সাহায্য করতে চায়, কেউ যদি কারো পাশে দাঁড়াতে চায়, তবে তা দেশ ও জাতিকে জানিয়ে ছবি তুলে কেন করতে হবে? আর লাইনই বা কেন ধরতে হবে? এফডিসিতে আমাদের ১৮টি পেশাজীবী সংগঠন আছে। এর মধ্যে সমস্যায় আছে ৮-১০টি সংগঠনের সদস্য, সমিতির কাছেই তো জানতে পারে কোন পেশায় কতজন সমস্যায় আছে। সমিতিগুলোকে দায়িত্ব দিলেই নিজেদের সদস্যদের বাড়িতে পাঠিয়ে দেবে এসব ত্রাণ।’
ঘরে খাবার নেই, হাতে টাকা নেই। সেলফি, ফেসবুক লাইভ আর লোকলজ্জার ভয়ে লাইনে দাঁড়িয়ে অনেকে ত্রাণ নিতে পারছেন না। একপ্রকার অসহায় হয়ে পড়েছে অনেক চলচ্চিত্রকর্মীর জীবন। অনেকে বলছেন, সমিতির মাধ্যমে ত্রাণ পাঠালে ঘুরেফিরে একই সদস্য নয়, বরং অসচ্ছল সব কর্মীর হাতেই ত্রাণ পৌঁছাবে।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতির সাধারণ সম্পাদক ও চিত্রনায়ক জায়েদ খান বলেন, ‘এফডিসিতে আমাদের যে সংগঠনগুলো আছে, সেগুলো পেশাজীবী সংগঠন। আমাদের কাজ হচ্ছে সমিতির সদস্যদের স্বার্থ রক্ষা করা, তাঁদের অধিকার আদায় করা। আবার সুদিনে তাঁদের আনন্দ দেওয়া বা করোনাভাইরাসের মতো দুঃসময়ে তাঁদের পাশে দাঁড়ানো। আমি সমিতির সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দিনরাত কাজ করে যাচ্ছি। আমাদের সদস্য রয়েছেন চার শতাধিক, এর মধ্যে দুই শতাধিক সমস্যায় আছেন। আবার কিছু আছেন, যাঁরা ছোটখাটো কাজ করেছেন, তবে আমাদের সমিতির সদস্য নন। সব মিলিয়ে তিনশর মতো। এরই মধ্যে আমি তিনবার এঁদের মধ্যে নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রী দিয়েছি। যতদিন সমস্যা থাকবে, যেখান থেকে পারি, এসব শিল্পীর বাসায় খাবার পাঠাব, আমাদের সদস্য কেউ না খেয়ে মারা যাবেন না ইনশাআল্লাহ।’
জায়েদ খান আরো বলেন, ‘আমি শিল্পীদের পাশাপাশি কিছু কলাকুশলীকেও এসব সামগ্রী দিয়েছি। অনেকেরই খবর নিচ্ছি, সাধ্যমতো পাশে দাঁড়াচ্ছি, এটা সহকর্মী হিসেবে ভালোবাসা। এটা আমার দায়িত্ব নয়। আমি মনে করি প্রত্যেকটি সমিতি নিজেদের জন্য নিজেরাই উদ্যোগ নিতে পারে। যেসব কলাকুশলী পাননি, সেই দায় তাঁর সমিতিকেই নিতে হবে। যাঁরা সাহায্য করার মতো আছেন, তাঁদের কাছে সমস্যা জানাতে হবে, তবেই না সমাধান হবে।’
সেলফি বা ফেসবুক লাইভ নিয়ে জায়েদ খান বলেন, ‘আমাদের শিল্পীরা কিন্তু একটু বেশিই আত্মসম্মানবোধ নিয়ে চলেন। অনেকেই আসেন না, তাঁদের বাসায় পাঠাতে হয়। আর সেলফি বা লাইভে গিয়ে যিনি আমাদের পাশে দাঁড়িয়েছেন, তাঁকেও সম্মান করি। তিনি যেন দেখতে পান যে, আমরা সঠিকভাবে এসব বিতরণ করছি। তা ছাড়া এই ছবি বা ভিডিও দেখে অনেকেই আমাদের পাশে দাঁড়িয়েছেন, সাহায্য করছেন।’