বাংলাদেশি নক্ষত্রের আলোয় উজ্জ্বল ক্যালগেরি

Looks like you've blocked notifications!
কানাডাপ্রবাসী বাংলাদেশি নৃত্যশিল্পী নক্ষত্র। ছবি : সংগৃহীত

দাদি শখ করে নাম রেখেছিলেন নক্ষত্র। তাঁর চোখে নাতনি ছিল আকাশের নক্ষত্ররাজির মতোই উজ্জ্বল। ছোট্ট নক্ষত্র নিজের বিভা ছড়িয়ে গুটি গুটি পায়ে হাঁটত। শারীরিক ভঙ্গিও নজর এড়াত না দাদির। তিনি চাইতেন, নক্ষত্র একদিন নৃত্যশিল্পী হবে। আলোকিত করবে এই শিল্প তথা দেশকে। সে অনেক দিন আগের কথা। আজ নক্ষত্র ২১ বছরের তরুণী। বিদেশে থেকেও নৃত্যশৈলী দিয়ে কানাডার ক্যালগেরিতে মুগ্ধতা তৈরি করেছেন বাংলাদেশি নক্ষত্র।

 

নক্ষত্রের পুরো নাম আনযালা মুরতাজ। জন্ম বাংলাদেশের রংপুর জেলা শহরের মুন্সিপাড়ায়। বাড়িতে সাংস্কৃতিক আবহ। বাবা অমিয় মুরতাজ আবৃত্তিশিল্পী। মা রুবিনা ইয়াসমিন গানের মানুষ। আর দাদি সুফিয়া হোসেনের উৎসাহ তো ছিলই। তাঁদের প্রেরণায় নৃত্যজগতে পদার্পণ নক্ষত্রের। অবশ্য ২০১৩ সালে দাদি মারা যান। সেই কষ্ট নক্ষত্রের হৃদয়ে জ্বলছে।

মাত্র তিন বছর বয়সে নাচে হাতেখড়ি নক্ষত্রের। শিক্ষক রানার কাছে নাচ শিখতেন। পাশাপাশি শিশু একাডেমিতেও ক্লাস করতেন। স্কুলসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অংশ নিয়ে সবার কাছে পরিচিত হয়ে ওঠে নক্ষত্রের মুখ। তবে নক্ষত্র এখন কানাডাপ্রবাসী।

১৯৯৮ সালে বাবা অমিয় মুরতাজ কানাডায় চলে যান। ২০০৬ সালে নক্ষত্র রংপুরের শিশু নিকেতনে প্রথম শ্রেণিতে পড়তেন। সে সময় মাত্র সাত বছর বয়সে ভিনদেশে পা রাখেন নক্ষত্র। এখন সপরিবারে সেখানেই আছেন। এরই মধ্যে ইউনিভার্সিটি অব ক্যালগেরি থেকে জীববিজ্ঞানে স্নাতক শেষ করেছেন তিনি।

একাডেমিক পড়াশোনা জীববিজ্ঞানে হলেও থেমে থাকেনি নক্ষত্রের নৃত্যচর্চা। সেই ছোটবেলায় লোকনৃত্য দিয়ে যাত্রা শুরু। এরপর শুরু হয় তাঁর ধ্রুপদী ওড়িশি ও ভরতনাট্যম নৃত্যচর্চা। ক্যালগেরি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে জ্যাজ নৃত্যও শিখেছেন। সমসাময়িক নৃত্যশৈলীর ওপর চর্চাও থেমে নেই—ব্যালেট, ওয়েস্ট আফ্রিকান ও ট্যাঙ্গো নৃত্যের ওপর তাঁর দখল রয়েছে।

সেই শিশু বয়সে ক্যালগেরির বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানে নেচে সবার নজর কাড়তে সক্ষম হন নক্ষত্র। এখন কানাডার বিভিন্ন সংস্কৃতির হরেক আয়োজনে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করছেন। ভারত, নেপাল, তুরস্ক, সার্বিয়াসহ বিভিন্ন দেশ আয়োজিত অনুষ্ঠানে অতিথি হিসেবে নৃত্যে পারঙ্গমতা দেখিয়েছেন। গত বছর ক্যালগেরিতে আয়োজিত বাংলাদেশের ব্র্যান্ড বিশ্বরঙের ফ্যাশন শোতে একমাত্র নৃত্যশিল্পী হিসেবে নাচেন, কোরিওগ্রাফার ছিলেন সাদিয়া ইসলাম মৌ। তাঁর নাচের প্রশংসা করেছেন তারকা নির্মাতা অমিতাভ রেজা চৌধুরী, মোস্তফা সরয়ার ফারুকী, শিবপ্রসাদ মুখার্জি। পশ্চিমবঙ্গের খ্যাতিমান সংগীতশিল্পী অনুপম রায়ও তাঁর নাচে মুগ্ধতা প্রকাশ করেছেন। তিনি উত্তর আমেরিকার নামকরা আয়োজন ফোবানায় তাঁর নৃত্যশৈলী প্রদর্শন করেছেন।

বৈশ্বিক মহামারি করোনাভাইরাসে জনজীবন স্থবির। কানাডাও এর ব্যতিক্রম নয়। অবশ্য সেখানে এর প্রকোপ অনেকটাই কম। তবু গৃহে কাটাতে হচ্ছে বেশির ভাগ সময়। এ সময়কে কাজে লাগাচ্ছেন নক্ষত্র। অনলাইনে ইন্দিরা গান্ধী সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের নৃত্য-কর্মশালায় অংশ নিচ্ছেন, রবীন্দ্রনৃত্য শিখছেন শর্মিলা ব্যানার্জির কাছ থেকে।

গতকাল রোববার (৭ জুন) এনটিভি অনলাইনের সঙ্গে কথা হয় নক্ষত্রের। তিনি বলেন, ‘ছোটবেলা থেকে নাচ শিখছি। এটা আমার জীবনের অংশ। প্রতিটি মুহূর্ত নাচ শেখার আগ্রহ। চাই ভালো নৃত্যশিল্পী হতে। করোনার কারণে এখন বাসায় দিন কাটছে। প্রতিদিন ছয়-সাত ঘণ্টা রিহার্সেল করছি।’

বিদেশের মাটিতে বাংলা নাচ তথা সংস্কৃতিকে জনপ্রিয় করার স্বপ্ন দেখেন নক্ষত্র। বাবার আবৃত্তির সঙ্গেও নেচেছেন। তাঁর প্রশংসা ক্যালগেরির বাঙালি প্রবাসী থেকে সেখানকার অধিবাসীদের মুখেও। প্রশংসার কথা তুলতেই লাজুক ভঙ্গিতে তিনি বললেন, ‘আসলে নিজের কথা আমি কীভাবে বলব জানি না। দেখেছি, ক্যালগেরির বাইরেও অনেকে আমাকে চেনেন। আর নাচের কারণেই তো চেনেন।’ নাচের পাশাপাশি এর ইতিহাস সম্পর্কে জানতে আগ্রহী তিনি। সে জন্য অবিরাম পড়াশোনা চালিয়ে যাচ্ছেন।

কানাডায় থাকলেও বাংলাদেশে মন পড়ে থাকে নক্ষত্রের। সেখানে মা-বাবা ও ছোট ভাই ধ্রুব থাকেন। আর চাচা-চাচিসহ স্বজনদের সবাই তো বাংলাদেশে। তাঁদের খুব দেখতে ইচ্ছে হয়। সেই সাত বছর বয়সে কানাডায় পাড়ি দিয়েছেন, আর আসা হয়নি নিজ দেশে। এ বছর তাঁরা পরিকল্পনা করেছিলেন দেশে আসবেন। কিন্তু বাধ সাধল করোনা। বলেন, ‘বাংলাদেশকে খুব মিস করি। আত্মীয়-স্বজন সবাই দেশে থাকেন। এ বছর যাওয়ার ইচ্ছে ছিল। কিন্তু করোনার কারণে যেতে পারলাম না।’

কানাডায় কীভাবে কাটছে করোনাকাল? নক্ষত্র বললেন, ‘সবাই চেষ্টা করছি যতটা সম্ভব বাসায় থাকা যায়। এখানে অবশ্য করোনা অতটা ভয়াবহ রূপ নেয়নি। এখানকার সবাই সরকার নির্দেশিত স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলে। তাই করোনার ভয়াবহতার কথা খুব একটা শুনিনি।’

নিজের নৃত্যদ্যুতি দিয়ে বসুধা আলোকিত করবেন নক্ষত্র, তাঁর প্রতি এ শুভ কামনা সবার। দেশীয় ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে বিশ্বদরবারে তুলে ধরবেন, এ প্রতিজ্ঞা নক্ষত্রের। ভিনদেশ হোক, মাতৃভাষা ভিন্ন হোক, শিল্পের ভাষা সার্বজনীন। নক্ষত্রের শারীরিক ভঙ্গি, নাচের তাল, লয়, মুদ্রা ভাষা-সীমান্ত পেরিয়ে দূর দেশে আলো ছড়াক।