স্মরণ

‘মনে রাখিস, হুমায়ুন ফরীদি দুশো বছরে একবার জন্মায়’!

Looks like you've blocked notifications!
হুমায়ুন ফরীদি। ফাইল ছবি

হুমায়ুন ফরীদি- একজন জন্ম অভিনেতা। এ দেশের যে কোনো ধরনের অভিনয়শিল্পীর কাছে এক আদর্শ, অনুকরণীয়, অনুসরণীয় ব্যক্তিত্ব। তাঁর মতো বড় মাপের অভিনেতা সম্পর্কে আমার কিছু বলা সাজে না। কিন্তু তাঁর সাথে কাজ করার কিছু অভিজ্ঞতার কথা বলতে পারি। 

২০০৮ সালে প্রবালদার পরিচালনায় ‘এবং বনলতা সেন’ নামে একটা টেলিফিল্মে তাঁর সাথে প্রথম কাজ করার সুযোগ হয়। খুব ভয়ে ছিলাম। অত বড় মাপের একজন শিল্পী! আমরা ঠিকমতো ম্যানেজ করতে পারব কি না? মিমি আপা অবশ্য অভয় দিয়েছিলেন। দেখলামও তাই। খুব আন্তরিকতা আর উচ্ছ্বাস নিয়ে কাজটা করলেন। সেই কাজটায় ক্যামেরায় ছিলেন নাভিদ ভাই। সেটে এসে ফরীদি ভাই প্রথমেই জিজ্ঞেস করলেন- ‘নাভিদ, কেলভিন কত? তোমার ক্যামেরার ওয়াটার ব্যালেন্সটা ঠিক করো...’ হঠাৎ করে জিজ্ঞেস করাতে নাভিদ ভাই একটু ঘাবড়ে গেছিলেন। আসলে এটা আর কিছুই না। এটা তাঁর গিমিক। এটাই তাঁর স্বভাব। সবাইকে একটু ভড়কে দেওয়া। আর এটাই হুমায়ুন ফরীদি।
 
‘পৌষ ফাগুনের পালা’র কাজ চলছে। নরেন চরিত্রটার জন্য তাঁর বিকল্প আর কেউ ছিল না। সেদিন সকাল থেকে সবাই তটস্থ- আজ ফরীদি ভাইয়ের শুটিং। আউটডোরের কাজ। উনি এলেন। মিমি আপাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আজ কয়টা দৃশ্য?’ মিমি আপা বললেন, ‘৫টা’। আমি তাঁকে পুরোটা বুঝিয়ে বললাম। উনি সব শুনে বললেন, ‘লাঞ্চের পরে দুইটা আর সন্ধ্যায় দুইটা করি। মোট চারটা দৃশ্য আজ করব। কি বলিস?’ মিমি আপা রাজি। এই সিরিয়ালটাতে অনেক অভিজ্ঞ এবং প্রথিতযশা শিল্পীরা কাজ করেছেন। কিন্তু ফরীদি ভাইয়ের অভিনয়ের সময় সবাই মনিটরে এসে তাঁর অভিনয় দেখতেন। ওখানেও তাঁর সেই গিমিক। উনি কাজ করতে গিয়ে এমন কিছু একটা করতেন যা কেউ ভাবতেও পারেনি। লাগাতার শুটিং ছিল না। বেশ কয়েকদিন পরে তাঁর যখন আবার শুটিং থাকত তখন প্রথম শটটা দিয়েই আমাকে ডেকে বলতেন, ‘কি রে...!! ঠিকঠাক হয়েছে তো?’ আমি অবাক, উনি আমাকে জিজ্ঞেস করছেন? ‘অনেকদিন পরে করছি তো... ক্যারেক্টারের লাইনটা ঠিক আছে কিনা...’ এই না হলে হুমায়ুন ফরীদি!

শরীরের কারণে কস্টিউম খুব হিসাব করে বানানো হতো। নরম সুতির কাপড় ছাড়া তাঁর জন্য অসুবিধা হতো কাজ করা। আরেকটি বিষয় ছিল- স্ক্রিপ্ট। তাঁকে অন্তত ১৬ ফন্টে ছাপিয়ে দিতে হতো। নইলে পড়তে অসুবিধা হয়। আর অসাধারণ ছিল তাঁর রসবোধ। খুব সিরিয়াস একটা দৃশ্যর রিহার্সেল চলছে। সবাই খুব উৎকণ্ঠিত। হুট করে উনি বললেন, ‘শোন একটা গল্প বলি...’ ব্যস শুরু হয়ে গেল, হাসতে হাসতে সবার কাজকর্ম একদম চুলোয় যাওয়ার পালা! বলতেন, ‘শক্ত হয়ে কখনো কোনো ধরনের ক্রিয়েটিভ কাজ হয় না।’ 

সেবার ‘পৌষ ফাগুনের পালা’র প্রিমিয়ার শোর কার্ড পৌঁছে দিতে গেছি। কার্ডে তাঁর নামের বানানটা ভুলবশত ভুল ছাপানো হয়েছিল। ফোন করে বললেন- ‘গাধা, তোকে যদি আমি রাকেশ না বলে বাকেশ বলে ডাকি, তোর শুনতে কেমন লাগবে?’ আমি তো চুপ! উনি বললেন, ‘কারো নামের বানান ভুল করা মানে ওই মানুষটাকে ছোট করা হয়। বুঝলি?’ 

এমনি অনেক কিছু শিখতাম তাঁর কাছে। তাঁর জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে কত ধরনের গল্প বলতেন! ‘পৌষ ফাগুনের পালা’র সেই অংশটা আমরা টাঙ্গাইলের মহেড়ায় শুটিং করছি। ফরীদি ভাই আসবেন। কো-আর্টিস্ট মিমি আপা, লায়লা হাসান। আমরা ইউনিট নিয়ে অপেক্ষা করছি। বেলা ২টার দিকে উনি পৌঁছালেন। গাড়ি থেকে কাঁপতে কাঁপতে নামলেন। বললেন, ‘এতো দূরে এলি কেন? মনে হয় না কাজ করতে পারব।’ আমি বললাম, ‘চলুন আগে খাবেন।’ খেতে খেতে অনেক কথাই বলছিলেন। কথা প্রসঙ্গে একটা কথা বলেছিলেন, ‘মনে রাখিস... হুমায়ুন ফরীদি দুশো বছরে একবার জন্মায়।’ ভাবলাম, এটা কি তাঁর অহংকার? আবার ভাবলাম, তাঁর মতো শিল্পীর জন্য এটাই মানায়। কারণ তিনি হুমায়ুন ফরীদি। ‘পৌষ ফাগুনের পালা’য় ওটাই তাঁর জন্য শেষ দিনের আসা ছিল। আমাদেরও কাজের জন্য শেষবারের মতো তাঁকে পাওয়া।
 
শেষ সময়ে তাঁর ঘুমের সাইকেল নষ্ট হয়ে গেছিল। দিনে ঘুমাতেন, রাতে জেগে থাকতেন। তখন তাঁর অনেক কাছের মানুষকে ফোন করতেন। অনেক কথা বলতেন। আমারও সৌভাগ্য হয়েছিল তাঁর সেই সময়কার কিছু কথা শুনবার। উনি বলেছিলেন, ‘চারিদিকে শুধু পলিউশন, মানুষের মধ্যে বেশি। মানুষ হচ্ছে সুন্দরের পূজারি। কিন্তু সেই মানুষ নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। যা হচ্ছে ঠিক হচ্ছে না রে! এখন অনেক কষ্ট হয় এসব দেখে...’ 

আমি শুনতাম... আসলেই আমরা নষ্ট হয়ে যাচ্ছি... সুন্দরের বদলে অসুন্দরের পূজারি হচ্ছি। কেউ ভাবার নেই। ফরীদি ভাইও চলে গেছেন... তাঁর সমসাময়িক শিল্পীরাও থাকবেন না। তাহলে? তাহলে আমাদের কী হবে? কে আলোর পথ দেখাবে? চেষ্টা করলে আর কয়েকটা দিন কি থাকতে পারতেন না আপনি... 

ফরীদি ভাই?

লেখক : নাট্য নির্মাতা। হুমায়ুন ফরীদি অভিনীত সর্বশেষ মেগা সিরিয়াল ‘পৌষ ফাগুনের পালা’য় যৌথভাবে পরিচালনার দায়িত্ব পালন করেছেন আফসানা মিমির সাথে।