আমার আইডল রুনা আপা : মিতালী মুখার্জি

Looks like you've blocked notifications!
জনপ্রিয় সংগীতশিল্পী মিতালী মুখার্জি। ছবি : সংগৃহীত

‘জীবন নামের রেলগাড়িটা’, ‘এই দুনিয়া এখন তো আর সেই দুনিয়া নাই’, ‘কেন আশা বেঁধে রাখি’, ‘যেটুকু সময় তুমি থাকো পাশে’—জনপ্রিয় এই গানগুলোর শিল্পী মিতালী মুখার্জি। বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত এই শিল্পী ভারতের জনপ্রিয় গজলশিল্পী ভূপিন্দর সিংহকে বিয়ে করার পর মুম্বাইয়ে স্থায়ীভাবে বসবাস করছেন। ভারতে তিনি মিতালী সিং মুখার্জি নামেই পরিচিত। জনপ্রিয় এই সংগীত তারকা গত শুক্রবার চ্যানেল আই ক্ষুদে গানরাজ সিজন সিক্সের গ্র্যান্ড ফিনালের দিন অতিথি বিচারক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন। এই অনুষ্ঠানে যোগ দিতেই মূলত এবার ঢাকায় আসেন তিনি। ঢাকায় ব্যস্ততার ফাঁকে এনটিভি অনলাইনকে বিশেষ সাক্ষাৎকার দেন মিতালী মুখার্জি।

আপনি তো ভারতের জি বাংলা চ্যানেলের সংগীতবিষয়ক জনপ্রিয় অনুষ্ঠান ‘সা রে গা মা পা’-এর বিচারক ছিলেন। এ ছাড়া ভারতের অনেক রিয়েলিটি শোতেও আপনি বিচারক হয়েছেন। বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো অতিথি বিচারক হলেন। কেমন লাগল?

মিতালী মুখার্জি : আমার সৌভাগ্য যে, চ্যানেল আই থেকে আমাকে বিচারক হওয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। যখন কলকাতায় ‘সা রে গা মা পা’ শুরু হয়, তখন আমি বিচারক ছিলাম। সে সময় ‘সা রে গা মা পা’র পরিচালক আমাকে বলেছিলেন, ‘দিদি, বাংলাদেশ থেকে গান ভালোবাসে এ রকম অনেকের চিঠি পাচ্ছি।’ তখন আমি তাঁকে বলেছিলাম, তুমি বাংলাদেশ থেকে প্রতিযোগী আনো না কেন? জবাবে সে বলেছিল, ‘ওরা তো সব ধরনের গান করে না। যেখানে যায় শুধু পল্লীগীতি গায়।’ তখন আমি তাঁকে বলেছিলাম, ফোক আমাদের দেশের অনেক শক্তিশালী সংগীত। আসলে তাঁরা হিন্দি, বাংলা, পাঞ্জাবি মানে সব ধরনের গান গাইতে পারে—এ রকম শিল্পী আশা করেছিলেন। একটা গান দিয়ে তো একজন শিল্পীর পরিচয় হয় না। সবকিছু শেখার বিষয়। এবার ক্ষুদে গানরাজ প্রতিযোগিতায় আমি দেখলাম, ঐক্য খুব ভালো গান গেয়েছে। ঈশ্বরপ্রদত্ত কণ্ঠ ওর। তিলোত্তমা ক্ল্যাসিক গান অসাধারণ গেয়েছে। চ্যাম্পিয়ন অঙ্কনের কণ্ঠও ঈশ্বরপ্রদত্ত। ওরা সবাই এখন বাচ্চা। ওদের গ্রুমিং খুব ভালো হয়েছে। ওদের দিয়ে আগামীতে অনেক ভালো কিছু করা সম্ভব। অনুষ্ঠানটির বিচারক হওয়ার আগে আমি কখনো এটা দেখিনি। বাংলাদেশে আসার আগে ইউটিউবে আগের সিজনের কিছু অনুষ্ঠান আমি দেখেছি। ভালো লেগেছে। শিল্পী হিসেবে আমি ওদের আগে গান শুনি। আর এই অনুষ্ঠানে আমরা তো গান শোনার পাশাপাশি ক্ষুদে শিল্পীদের দেখলামও। গান গাওয়ার সময় একটুও তারা বিচলিত হয়নি।

বাংলাদেশের কোন শিল্পীর সঙ্গে আপনার যোগাযোগ হয়?

মিতালী মুখার্জি : দীর্ঘদিন কারো সঙ্গে তেমন যোগাযোগ হয় না। কিছুদিন আগে মুম্বাইতে হাইকমিশনের একটি অনুষ্ঠানে রুনা আপা (রুনা লায়লা) এসেছিলেন। তখন তাঁর সঙ্গে কিছুক্ষণের জন্য দেখা হয়। আমাদের কুশল বিনিময় হয়েছিল।

বাংলাদেশে এলে কোন খাবারটা খেতে ইচ্ছে করে?

মিতালী মুখার্জি : মাছভর্তা, পরোটা ও হালুয়া।

এবার আপনার সংগীতজীবন নিয়ে কিছু কথা বলতে চাই। আমজাদ হোসেন পরিচালিত ‘দুই পয়সার আলতা’ চলচ্চিত্রে ‘এই দুনিয়া এখন তো আর সেই দুনিয়া নাই’ গানটি গেয়ে বাংলাদেশের জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছেন। গানটি নিয়ে কোনো স্মৃতি মনে আছে?

মিতালী মুখার্জি : গানটার রেকর্ড আমি যখন করি, তখন আমার ভালো সময় ছিল। বিটিভিতে তখন প্রযোজক মুসা আহম্মেদ ভাই ছিলেন। তিনি তখন ‘মিতালী মুখার্জির একক ১০টি গান’ নামে একটা অনুষ্ঠান বানিয়েছিলেন। গানের দায়িত্ব তিনি সুরকার আলাউদ্দীন আলী ভাইকে দেন। ওই অনুষ্ঠানের জন্যই মূলত তখন গানটা রেকর্ড করা হয়। রেকর্ডের সময় আলাউদ্দীন ভাইকে আমি বলেছিলাম, আপনার সুর করা ‘কেউ কোনোদিন আমারে তো কথা দিল না’ গানটির মতো সুন্দর একটি মেলোডিয়াস গান করে দেন। বিটিভির অনুষ্ঠানে গানটি প্রথম প্রচার হয়। পরে আমজাদ ভাই তাঁর সিনেমা ‘দুই পয়সার আলতা’য় গানটি ব্যবহার করেন।

গান রেকর্ডের সময় শিল্পীরা কিন্তু বোঝে না, কোন গান তাঁর জীবনের একটা শ্রেষ্ঠ গান হয়ে উঠতে পারে। আমার কাছেও এই গান রেকর্ডের সময় অন্য সব গানের মতোই মনে হয়েছিল। তবে গানটি গেয়ে তখন খুব ভালো লেগেছিল আমার। গানটির কথা ও সুরে কখনো কখনো ব্যক্ত করা যায় না যে হৃদয়ের কোন জায়গায় গানটি ছুঁয়ে যায়। পুরস্কারও পেয়েছি। অবশ্যই ভালো লেগেছে। একটা গানের পেছনে শুধু শিল্পী নয়, সুরকার ও গীতিকারদেরও অবদান অনেক। লতাজি যদি ভালো গীতিকার ও সুরকার না পেতেন, তিনিও তাঁর ট্যালেন্টটা ওভাবে দেখাতে পারতেন না হয়তো।

শুনেছি ‘কেন আশা বেঁধে রাখি’ গানটি গাওয়ার পেছনে আপনার জীবনে একটা গল্প আছে। সেটা যদি বলতেন...

মিতালী মুখার্জি : এটা আমার অন্তরাত্মার মিশ্রিত কথার একটা গান। অনেক ইমোশনাল গান। আমরা সাত ভাইবোন। আমার বড় ভাই প্রদীপ মুখার্জি এই গান লিখেছেন। তাঁর কিডনির অসুখ হয়েছিল। মুম্বাইতে এসে আমার বাসা থেকেই দাদা চিকিৎসা করিয়েছিলেন। বাবার পর আমাকে খুব বেশি স্নেহ করতেন আমার সেই ভাই। যখন ভাই মারা যায়, তখন আমি বিশ্বাস করতে পারিনি। তাঁর চলে যাওয়া মানতে পারিনি এখনো। ভাইকে ভেবে গানটির সুর আমি করেছিলাম। মুম্বাইতে গানটির রেকর্ড করা হয়েছিল। মনে পড়ে, একদিন রাস্তায় চলন্ত গাড়িতে বসে গানটির ডামি সুর আমি করেছিলাম। আমার ভাই আমাকে মিতু বলে ডাকত। আমি ঢাকায় এলে সবাইকে বলত, ‘মিতু ঢাকায় আসছে।’ আজ আমি ঢাকায়, কিন্তু আমার ভাই নেই।

আপনাদের বাড়িতে তো সংগীত ও সাহিত্যচর্চা হতো নিয়মিত...

মিতালী মুখার্জি : হ্যাঁ, আমরা সবাই খুব সংস্কৃতিমনা ছিলাম। আমাদের বাসায় প্রচুর বই ছিল। সব বিখ্যাত লেখকের লেখা বই আমাদের বাসায় ছিল। আমার মা কল্যাণী মুখার্জি ও বাবা অমিয় মুখার্জি। তাঁরা আমাকে গানের রেওয়াজের জন্য ভোর ৫টায় ঘুম থেকে তুলে দিতেন। সবাই ঘুমিয়ে থাকত আর আমি উঠতাম। আমি কাঁদতাম বসে বসে। আমার মা তখন বলতেন, একদিন যখন তোমার নামডাক হবে, তখন আমাদের কথা মনে থাকবে না।

আমার আরেক ভাই দিলীপ মুখার্জি ভালো তবলা বাজাতেন। আমার সংগীতশিল্পী হয়ে ওঠার পেছনে ওর অবদান অনেক। ও সব সময় বলত, এই শিল্পীর গানটা মনোযোগ দিয়ে শোন, এই ক্ল্যাসিক গানটা কর, আরো অনেক কিছু।

আপনার গাওয়া জনপ্রিয় রোমান্টিক একটা গান ‘যেটুকু সময় তুমি থাকো পাশে’। আপনার কাছে প্রেমের অর্থ কী?

মিতালী মুখার্জি : ‘প্রেম’ শব্দের অর্থ আমার কাছে বিশাল। কৈশোরের প্রেম আমার অন্য রকম ছিল। তখন ভালো লাগার বিষয়টুকুই ছিল। এখন ভালোবাসার সংজ্ঞা আমার কাছে অনেক কিছু। আমি বলব, নিঃস্বার্থ প্রেম বলে বক্তৃতা দেওয়া সহজ, আর সেটা করে দেখানো আসলেই খুব কঠিন। যদি সত্যিই নিঃস্বার্থ প্রেম করা যায়, তাহলে ভালোবাসাও পাওয়া যায়। আমি বাংলাদেশে বহুদিন পর এসেছি। অনেক কাছের মানুষ আমাকে এসে জড়িয়ে ধরেছেন। আমি তাঁদের বলব, তোমরা যদি থাকো পাশে, মিতালী মুখার্জি সারাজীবন থাকবে। সবার এখন যান্ত্রিক জীবন। ক্যারিয়ার নিয়ে সবাই ব্যস্ত। সত্যিকারের মানুষ সব সময় সবার ভালো চায়, পাশে থাকে।

আপনি তো বাংলা, হিন্দি, তামিল, পাঞ্জাবিসহ আরো অনেক ভাষায় গান গেয়েছেন। একজন বাংলাদেশি হিসেবে দেশের বাইরে যখন কনসার্ট করেন, তখন কেমন লাগে আপনার?

মিতালী মুখার্জি : অসাধারণ। আমি অনেক গর্বিত, আমি বাংলাদেশি। আমি সবকিছু বাংলা ভাষায় ভাবি। ওখানে তো অনেকে বলেন, ‘আপ ব্যাঙ্গল স্যায় আয়া। আপ কালচারালি বহুত রিচ হু।’ ‘সা রে গা মা পা’ অনুষ্ঠানে শানকে আমি বলেছিলাম, আমি ময়মনসিংহের মেয়ে। আমি আগে জানতাম না, আমার জামাই সংগীতশিল্পী হবেন এবং তাঁর নামের শেষে একটা সিং থাকবে। আমার বর ভূপিন্দর সিং আর আমার সম্পর্ক সাধারণ দম্পতিদের মতোই। আমরা একসঙ্গে ঝগড়া করি, বাইরে ঘুরতে বের হই। অনেক ভালো আছি আমরা।

দেশের বাইরে আপনি কোন নামে কনসার্ট করেন—মিতালী মুখার্জি নাকি মিতালী সিং?

মিতালী মুখার্জি : গুজরাটে একটা কনসার্ট করেছিলাম। ওই কনসার্টটি মিতালী মুখার্জি নামে হয়েছিল। কারণ, অনেক মিতালী আছে। কেউ তো বুঝবে না। নামের পদবিও আমার পরিচয়। এটা আমরা এড়িয়ে যেতে পারি না। তবে এখন আমি সব জায়গায় মিতালী সিং মুখার্জি লিখি।

একটা ঘটনা বলি, একটা তামিল গান রেকর্ডের পর গানের পরিচালক আমাকে বলেছিলেন, তোমার নাম কী দেবো? আমি শুধু মিতালী রাখতে চাই। কারণ, নামের শেষে পদবি দিলে মানুষ বিচার করতে পারে না যে তুমি পাঞ্জাবি নাকি বাঙালি।

আর একটা ঘটনা বলি, বিশ্ব নারী দিবস উপলক্ষে একবার আমি পুরস্কৃত হয়েছিলাম। তখন আয়োজকরা পুরস্কারে আমার নামের পদবি রাখেননি।

আপনার জনপ্রিয় একটা গান আছে ‘জীবন নামের রেলগাড়িটা, পায় না খুঁজে স্টেশন’। আপনার কাছে জীবনের দর্শন কী?

মিতালী মুখার্জি : মানুষকে বেশি বিচার না করে একটু ভালোবাসলে হয়। একটু ভালো খাওয়া, ভালো থাকা, বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে ঘোরাফেরা করা। এই তো জীবন। জীবনে পয়সা দরকার আছে। তবে এমন যাতে না হয়, শুধু পয়সার পেছনে ছোটা। আনন্দ হচ্ছে, মাটিতে গড়াগড়ি করা, হৈচৈ করে সময় কাটানো। আর সুখ হচ্ছে, নিজের মধ্যে চেপে রাখা অনুভূতি। এসিরুমে বসে থাকা নিজেকে ভালো রাখা। আমি আসলে আনন্দে থাকতে চাই। সবাইকে একদিন পৃথিবী ছেড়ে যেতে হবে। আমি মানুষের ভালোবাসা পেতে চাই। মিতালী মুখার্জি মিতালী মুখার্জি হতো না, যদি সে ভালো গীতিকার ও সুরকার না পেত। আমি মনে হয়, ভীষণ ভাগ্যবতী।

সংগীতকে আপনি কীভাবে দেখেন?

মিতালী মুখার্জি : গান একটা থেরাপি, বিরাট জিনিস ও অগাধ সমুদ্র। গান কিন্তু অন্যান্য বিষয়ের মতো নয়। মাস্টার্স করলাম, পিএইচডি করলাম, শেষ হয়ে গেল। আমি গান আজও শিখছি।

আপনি কাদের আইডল ভাবতেন?

মিতালী মুখার্জি : আমার আইডল ছিলেন রুনা আপা, সাবিনা আপা ও শাহনাজ আপা।

অবসরে আপনার সময় কীভাবে কাটে?

মিতালী মুখার্জি : আমি রান্না করতে ভালোবাসি। বাগান করি। গল্পের বই পড়ি। মুম্বাইতে আমার কিছু বান্ধবী আছে, তাঁদের সঙ্গে গল্প করেও সময় কাটাই।