অনন্ত জলিলের ভালোবাসা
এম. এ. জলিল অনন্ত। যিনি অনন্ত জলিল নামেই বেশি পরিচিত। একাধারে তিনি একজন চলচ্চিত্র পরিচালক, প্রযোজক, নায়ক ও বিশিষ্ট ব্যবসায়ী। বাংলাদেশের এ সময়ের জনপ্রিয় নায়কদের একজন তিনি। খুব অল্প সময়ে ঢালিউডের চলচ্চিত্রে বেশ পরিচিতি লাভ করেছেন তিনি। সম্প্রতি তাঁর নানা রঙের ভালোবাসা নিয়ে কথা বলেছেন এনটিভি অনলাইনের সঙ্গে।
মা-বাবা-ভাইয়ের প্রতি ভালোবাসা
পাঁচ বছর বয়সে মাকে হারাতে হয়েছে। মাকে খুব একটা ভালোবাসার সুযোগ পাইনি। কিন্তু মায়ের প্রতি ভালোবাসা সবটুকু জমিয়ে রেখেছি বুকের মধ্যে। মাকে মাঝেমধ্যেই খুব মিস করি। বাবা মারা যান ২০০৮ সালে। আমার বেড়ে ওঠা বাবার স্নেহ, ভালোবাসা, আদর আর শাসনের মধ্য দিয়ে। আমার বড় ভাই আমার চেয়ে ১১ বছরের বড় ছিলেন। তিনিও ২০০৮ সালে এক মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান। যিনি আমার জীবনে ছায়া হয়েছিলেন। প্রচণ্ড ভালোবাসি তাঁদের আর খুব মিস করি।
আমার ছেলেবেলা কেটেছে বাবার কঠোর নিয়মের মধ্যে, চার দেয়ালে বন্দি অবস্থায়। আমার বেড়ে ওঠা ঢাকার শুক্রাবাদে। বিকেলে যখন একটু বাইরে খেলতে যেতাম তখনো ম্যানেজার আঙ্কেল (বাবার ম্যানেজার) সাথে থাকতেন। খেলার সময় শেষ মানেই সময় মতো আবার বাসায়।
ছেলেবেলার কোনো মজার ঘটনা
আমার বাবা একবার আমাকে আর আমার বড় ভাইকে কাকরাইল মসজিদে নিয়ে গিয়েছিলেন। সেখানে নিয়ে আমাদের দুই ভাইকে শপথ করান যে জীবনে কখনো সিগারেট খাব না, কখনো ড্রিঙ্কস করব না এবং কখনো এমন কোনো কাজ করব না যার জন্য পুলিশের কাছে যেতে হয়। ওই ছোট বয়সে আমার করা শপথগুলো আমি খুবই মেনে চলতাম। হঠাৎ একদিন আমি আমার বড় ভাইকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘ভাইয়া, আমার ক্লাসের সবাই তো ড্রিঙ্কস করে তাহলে বাবা আমাকে ড্রিঙ্কস করতে নিষেধ করলেন কেন?’ ভাইয়া তখন আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তোর ক্লাসের সবাই কী ড্রিঙ্কস করে?’ আমি উত্তরে বললাম, ‘সবাই তো কোক, ফান্টা এসব খায়, কিন্তু আমি তো খেতে পারি না।’ আমার এই কথায় ভাইয়া হেসে দিলেন। তখন আমাকে বুঝিয়ে বললেন, ‘এই ড্রিঙ্কস সেই ড্রিঙ্কস না। তুই এসব খেতে পারবি, বাবা আমাদের হার্ড ড্রিঙ্কস খেতে নিষেধ করেছেন। হার্ড ড্রিঙ্কস হলো মদ। এটা তুই আরো বড় হলে বুঝতে পারবি।’ এই ঘটনাটা মনে হলে আজও খুব হাসি পায়।
বর্ষার সাথে আপনার আগে থেকেই পরিচয় ছিল। প্রেম হলো কীভাবে?
বর্ষার সাথে আমার পরিচয় ফিল্ম করার অনেক আগে থেকেই। প্রথমে দুজনের দেখা, তারপর কথা, তারপর বুঝতে পারা এবং সবশেষে প্রেম। এরপর আমরা আর বেশি দেরি করিনি, বিয়ে করে সুখের সংসার করছি।
বিয়ের পর বর্ষার সাথে প্রেম কি কমে গেছে? নায়িকা বর্ষাকে কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?
বিয়ের পর বর্ষার সাথে প্রেমটা আরো গভীর হয়েছে। দুটি আত্মা যেন এক হয়ে গেছে। নায়িকা বর্ষার মূল্যায়ন আসলে আমার চাইতে বর্ষার দর্শক-ভক্তরা বেশি করতে পারবেন। তবে চিত্রনায়ক হিসেবে বলব, বর্ষা খুব গোছালো একজন অভিনেত্রী। বর্ষা কখনো একটি শট পুরোপুরি না বুঝে দেয় না। চরিত্রের গভীরে গিয়ে তারপর প্রতিটি শট দেয়।
অন্য নায়িকাদের সাথে বর্ষার তুলনা
ডেফিনিটলি বর্ষা অনেক ভালো এবং গুণী অভিনেত্রী। আর কারো সাথে আসলে কারো তুলনা হয় না, কারণ প্রতিটি মানুষ তার নিজের বৈশিষ্ট্যকেই ধারণ করে।
সন্তানের প্রতি ভালোবাসা
সন্তানের প্রতি ভালোবাসাটা ভাষায় প্রকাশ করা অনেকটাই অসম্ভব। এই ভালোবাসা শুধু অনুভবই করা যায়। মনে হয় সন্তান যেন আরেকটা পৃথিবী, যার জন্য সবকিছু। যাকে ঘিরেই সব স্বপ্ন, আশা। সবাই দোয়া করবেন আমাদের সন্তান যেন শুধু শিক্ষিত না হয়, সে যেন সুশিক্ষিত হয়ে তার জ্ঞানকে মানুষের কল্যাণে ব্যবহার করতে পারে।
প্রতিষ্ঠানে কর্মচারীর প্রতি ভালোবাসা
প্রকৃত অর্থে আমি নিজেকে কখনো মালিক বলে মনে করি না। প্রতিদিন সকালে অফিসে আসার পথে আমি সৃষ্টিকর্তার উদ্দেশে একটা কথাই বলি, ‘হে খোদা, তুমি তো সবকিছুর মালিক আর তুমি আমাকে যোগ্য মনে করে তোমার এই সবকিছুর যথাযথ দেখাশোনার দায়িত্ব আমাকে দিয়েছ মাত্র। যার উছিলায় হাজার হাজার মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে। তুমি আমাকে আমার দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করার তৌফিক দান কর।’
আমার প্রতিষ্ঠানে বর্তমানে প্রায় সাড়ে আট হাজার মানুষ কর্মরত আছেন। আমি তাঁদের সব সময় যে কথাটা বলি, তা হলো এই প্রতিষ্ঠান তোমাদের সবার। কর্মচারীদের প্রতি ভালোবাসা থেকেই তাঁরা তাঁদের সুখে-দুঃখে প্রতিটি মুহূর্তে আমাকে কাছে পায়। আমার সাথে প্রতিটি কর্মকর্তা ও কর্মচারীর মধ্যে নিবিড় সম্পর্ক ও ভালোবাসাই আজ আমাদের প্রতিষ্ঠানকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। ইনশাআল্লাহ এই ভালোবাসা নিয়ে আরো দূর এগিয়ে যাব।
সমাজের প্রতি ভালোবাসা
সমাজের প্রতি ভালোবাসা আর দায়িত্ববোধ থেকে আমি সবসময় চেষ্টা করি গরিব, দুঃস্থ, অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়াতে। সেই দায়িত্ববোধ থেকেই আমার এজে ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠা করা, যেখান থেকে বিভিন্ন সময় সমাজের গরিব, দুঃস্থ, অসহায় মানুষদের বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করি। একইসাথে আমি ব্যক্তিগতভাবে চারটি এতিমখানার সাথে সম্পৃক্ত, যেখানে প্রায় আড়াই হাজারের মতো এতিম থাকে। ব্যক্তিগত উদ্যোগে সাড়ে আটাশ বিঘা জায়গার ওপর একটি বৃদ্ধাশ্রম নির্মাণ করছি। আমি আপনাদের মাধ্যমে সমাজের সামর্থ্যবান সব ব্যক্তির প্রতি বিনীত আহ্বান জানাতে চাই, আপনার চারপাশে যে অসহায় মানুষগুলো আছে প্লিজ সামর্থ্য অনুযায়ী তাদের পাশে দাঁড়ান। ভালোবাসুন মানুষকে।
দেশের প্রতি ভালোবাসা
দেশের প্রতি ভালোবাসা মুখে প্রকাশের বিষয় নয়, দেশপ্রেম প্রকাশ পায় কাজের মধ্য দিয়ে। আমি আমার দেশটাকে কতটুকু ভালোবাসি তা আমার কাজকর্মেই প্রকাশ পাবে। দেশের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ আর ভালোবাসা থেকেই আমি আমার প্রতিটি কাজে আমার প্রিয় এই দেশটাকে তুলে ধরার চেষ্টা করি। আমার ব্যবসায়িক কার্যক্রমের মাধ্যমে বাংলাদেশের মান বিশ্বের দরবারে আরো উঁচু করার চেষ্টা থাকে সব সময়। আর কিছু করতে পেরেছি বলেই গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার আমাকে একাধিকবার বাংলাদেশের একজন সিআইপি হিসেবে সম্মানিত করেছে। এমনকি আমি আমার প্রতিটি চলচ্চিত্রে দেশকে নিয়ে, দেশের মানুষকে নিয়ে বার্তা দেওয়ার চেষ্টা করি। সবকিছু মিলিয়ে বলব, এই দেশ আমার, এই দেশ আমাদের, আমরাই পারি যার যার জায়গা থেকে সম্মিলিতভাবে আমাদের দেশকে আরো উন্নত করতে।
চলচ্চিত্রের প্রতি ভালোবাসা
চলচ্চিত্রের প্রতি ভালোবাসা থেকেই আমার চলচ্চিত্রের সাথে সম্পৃক্ততা। বাংলা চলচ্চিত্রের যখন করুণ পরিস্থিতি ঠিক তখনই আমার প্রথম মুক্তিপ্রাপ্ত চলচ্চিত্র ‘খোঁজ-দ্য সার্চ’ একটা পরিবর্তন নিয়ে আসে। পরবর্তীকালে একে একে মুক্তি পায় ‘হৃদয় ভাঙ্গা ঢেউ’, ‘দি স্পিড’, ‘মোস্ট ওয়েলকাম’, ‘নিঃস্বার্থ ভালোবাসা’ এবং ‘মোস্ট ওয়েলকাম ২’। আমার অভিনীত চলচ্চিত্রগুলো দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে বিদেশেও মুক্তি পায় এবং সব জায়গায় সমানভাবে প্রশংসিত হয়। চলচ্চিত্রের প্রতি প্রবল ভালোবাসা থেকেই বাংলা চলচ্চিত্রকে বিশ্বের দরবারে নিয়ে যাওয়ার আমার আপ্রাণ চেষ্টা আজও অব্যাহত আছে। আর এ ক্ষেত্রে আমি আন্তরিকভাবে কৃতজ্ঞ আমার সব ভক্ত, দর্শক ও শুভাকাঙ্ক্ষীদের কাছে। যাদের ভালোবাসা আর উৎসাহ আমার সবচেয়ে বড় অনুপ্রেরণা, চলচ্চিত্রকে নিয়ে সামনে এগিয়ে যাওয়ার।
দর্শকদের প্রতি ভালোবাসা
এক কথায় যদি বলতে হয়, তাহলে বলব আমি আমার ভক্ত দর্শকদের সাথে প্রতারণা করতে চাই না। তাই আমি কখনো ডামি ব্যবহার করি না। কারণ দর্শকরা নিজের পকেটের টাকা খরচ করে সিনেমা হলে যায় আমাকে দেখতে, আমার ডামিকে না। আমি ডামি ব্যবহার করব আর দর্শকভাববে আমাকেই দেখছে এ ধরনের প্রতারণা আমি আসলে আমার দর্শকদের সাথে করতে চাই না এবং পছন্দ করি না।
এনটিভি অনলাইনের প্রতি ভালোবাসা
এনটিভি বাংলাদেশের স্বনামধন্য অন্যতম শীর্ষ টেলিভিশন চ্যানেল। সুদীর্ঘ এক যুগ ধরে এনটিভি তার প্রায় প্রতিটি সংবাদ এবং অনুষ্ঠানের গুণগত মান বজায় রেখে সম্প্রচার করে কোটি দর্শকদের মনে স্থান করে নিয়েছে। সম্প্রতি এনটিভি অনলাইন চালু হয়েছে। আমি এনটিভির এই উদ্যোগকে সাধুবাদ জানাই। বর্তমানে অনলাইন প্রতিটি মানুষের হাতে হাতে। এনটিভি অনলাইন নিউজের মাধ্যমে এখন শুধু প্রতিটি মানুষের ঘরেই শুধু না, প্রতিটি মানুষের হাতে হাতে সংবাদকে পৌঁছে দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছে। সত্যিই এটা প্রশংসার দাবি রাখে।
একজন চলচ্চিত্র ব্যক্তিত্ব হিসেবে এনটিভি অনলাইনের কাছে আমার চাওয়া থাকবে যে আপনারা আপনাদের সংবাদের মাধ্যমে আমাদের বাংলা চলচ্চিত্রকে আরো সমৃদ্ধ করে বিশ্বের দরবারে তুলে ধরুন।