থিয়েটারের মানুষ সুদীপ চক্রবর্তী

Looks like you've blocked notifications!

সুদীপ চক্রবর্তী, যে নাম বাংলাদেশের মঞ্চনাটকের অঙ্গনে আজ উজ্জ্বল। কাছের মানুষ যাঁরা চেনেন-জানেন, তাঁরাই বলেন—কাজের নেশায় ছুটে চলা এক দুর্দান্ত মানুষ হলেন এই তরুণ নির্দেশক। আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও যে মানুষটি নিয়ে গেছেন বাংলাদেশের মঞ্চনাটককে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের থিয়েটার অ্যান্ড পারফরম্যান্স স্টাডিজ বিভাগ প্রযোজিত ‘চাকা’, ‘রক্তকরবী’, ‘দ্য লোয়ার ডেপথস্’, ‘থ্রি সিস্টারস্’, সুবচন নাট্য সংসদের ‘মহাজনের নাও’, শূন্যন প্রযোজিত ‘লাল জমিন’, শব্দাবলী বরিশালের ‘ফণা’, পদাতিক নাট্য সংসদ প্রযোজিত উইলিয়াম শেকসপিয়ারের ‘ম্যাকবেথ’সহ কত নাটকের নির্দেশনার গল্পই না গেঁথে আছে এ পথচলায়।

স্বপ্নময় তরুণদের সঙ্গে নিয়ে গড়ে তুলেছেন থিয়েট্রেক্স। সুদীপ চক্রবর্তীর নির্দেশনায় থিয়েট্রেক্সের নাটক ‘দক্ষিণা সুন্দরী’ স্থান করে নিয়েছিল কমনওয়েলথ নাট্য উৎসবের মঞ্চে। সৃষ্টিশীলতার নেশায় মেতে থাকা মানুষটির আজ জন্মদিন। ১০ আগস্টের এই দিনে তাই সুদীপ চক্রবর্তীর সঙ্গেই ক্ষণিক মুহূর্তের এই আড্ডার আয়োজন।

প্রশ্ন : শৈশব ও কৈশোরের জন্মদিন আর আজকের জন্মদিন—দুটো নিশ্চয় আলাদা, কেমনতর আলাদা?

উত্তর : আলাদা সেভাবে নয়। শৈশবে যেমন ছিল, এখনো তেমনই। কখনোই সেভাবে জন্মদিন পালন করা হয়ে ওঠেনি। কৈশোরে দুবার হয়েছিল মনে পড়ে। এই তো।

প্রশ্ন : নাটক নিয়েই বিশেষত কথা বলতে ইচ্ছা হয়। তাই বাংলাদেশের থিয়েটার প্রসঙ্গেই আসি। কী মনে করেন, বিশ্ব নাট্যাঙ্গন বিবেচনায় বাংলাদেশের থিয়েটার কোথায় দাঁড়িয়ে?

উত্তর : বাংলাদেশের থিয়েটার তো আসলে ব্যক্তিগত উদ্যোগে চলছে। নাট্যদলের সঙ্গে যাঁরা জড়িত, তাঁদের চেষ্টা-পরিশ্রমে বা নাট্যদলগুলোর কাজের মাধ্যমে যতদূর যাওয়া সম্ভব, ততদূর এগিয়েছে বটে। কিন্তু সেটা বিশ্ব নাট্যাঙ্গন বিবেচনায় খুব কমই বলব। রাষ্ট্রের সহযোগিতা না পেলে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বাংলাদেশের থিয়েটারকে নিয়ে যাওয়া, বিশ্বের সামনে আমাদের কাজ তুলে ধরা এবং ব্যক্তিগতভাবে এ পথ পাড়ি দেওয়া সম্ভব নয়। রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা এ ক্ষেত্রে অপরিহার্য। 

প্রশ্ন : এই যে শুধু থিয়েটার করে চলার জোর আজো পাওয়া যায় না, এর মূল কারণ কী?

উত্তর : জীবিকার তাগিদ। মানুষ তার পছন্দ থেকে ভালোবাসার জিনিসের কাছ থেকে সরে আসতে তখনই বাধ্য হয়, যখন জীবিকা নিয়ে সংকটের মুখোমুখি হয়। আমি বারবার সে জন্যই বলি, জাতীয় নাট্যদল থাকা খুব দরকার। জাতীয় নাট্যদল গঠনের মধ্য দিয়েই এ সমস্যার সমাধান করা সম্ভব। এ ছাড়া আমাদের স্কুল-কলেজে শুধু নাটক নয়, চারুকলা, সংগীত, নৃত্য এ বিষয়গুলো পাঠ্যসূচির অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। তাহলে শৈশব-কৈশোর থেকেই সমৃদ্ধ মন-মানসিকতা নিয়ে গড়ে উঠবে ছেলেমেয়েরা।

প্রশ্ন : থিয়েটারে রাজনীতি। এই যে সিনিয়র-জুনিয়র দ্বন্দ্ব, দলে কর্তৃত্ব ধরে রাখার রাজনীতি, কোন্দল। এ ব্যাপারে কিছু বলবেন?

উত্তর : ‘থিয়েটারে রাজনীতি’ শব্দ দুটো আপনি যে অর্থে বলছেন, এটা খুব ক্ষুদ্র পরিসরে বিরাজমান। দেখুন, প্রতিটি নাট্যদলেরই রাজনৈতিক চিন্তা-মতাদর্শ থাকবে। সময়কে ছুঁয়ে দেখা, যে সময়ের মধ্য দিয়ে দেশ-সমাজ-রাষ্ট্রের পারিপার্শ্বিক অবস্থাকে উপলব্ধি করা যায়, সে সময়কে নিজের ভাবনা দিয়ে ফুটিয়ে তোলা। কাহিনীতে, সংলাপে, অভিনয়ে সময়কে উপস্থাপন করা। এটা হলো থিয়েটারে রাজনীতি। আর আপনি যে সমস্যার কথা বলছেন এর কারণ, এখনো আমাদের দেশে বেসরকারি উদ্যোগে ব্যক্তিগতভাবে থিয়েটার চর্চা হচ্ছে। জাতীয় নাট্যদল হলে বা পেশাদারিত্বের ভিত্তিতে কাজ হলে তখন দায়িত্বই প্রধান এবং মুখ্য বিষয় হিসেবে বিবেচিত হবে। তখন আর এসব হীনমন্যতা স্থান পাবে না। 

প্রশ্ন : আমাদের শিল্পকলা একাডেমিতে এখন তো নৃত্য ও সংগীত ভবন, চলচ্চিত্রশালা আছে। কিন্তু দেখা যায়, ফিল্ম ফেস্টিভাল হচ্ছে অথচ মঞ্চকর্মীরা জানেন না, অনুরূপ ফিল্মমেকাররা জানেন না নাট্য উৎসবের খবর। এক ক্ষেত্রের সঙ্গে অন্য ক্ষেত্রের যোগাযোগ খুব কম, এ নিয়ে আপনার মন্তব্য কী?

উত্তর : এ জন্য দায়ী তরুণদের উৎসাহের অভাব। এটা রাষ্ট্রের দায়িত্ব নয় কিংবা চলচ্চিত্র সংগঠন অথবা নাট্যদলগুলোর দায়িত্ব নয়, ব্যক্তিগতভাবে যোগাযোগ রক্ষা করা। এখন তো ইন্টারনেট আছে। হাতের কাছে ফেসবুক, ইউটিউব, টুইটার, গুগল সব আছে। কয়জন গান শোনে? কবিতা-গল্প-উপন্যাস পড়ে? কয়জন মুভি দেখে খুঁজে খুঁজে? আমাদের দেশে তো চারুকলা প্রদর্শনীগুলো দর্শনী ছাড়াই দেখা যায়, চলচ্চিত্রশালায়ও বিনামূল্যে চলচ্চিত্র প্রদর্শিত হচ্ছে ইদানীং।

আন্তর্জাতিক পত্রপত্রিকা অনুসরণ করলে বিভিন্ন দেশের সমকালীন কবিদের কবিতা পড়া যায় সহজেই। কিন্তু কয়জন এ সম্পর্কে সচেতন আমাদের সমাজে। আমি দেখেছি, এক দলের নাট্যকর্মীরাই অন্য দলের নাটক দেখতে যান না।

বিশ্ববিদ্যালয়ে নাটক নিয়ে যাঁরা পড়াশোনা করছেন, তাঁদের ক্ষেত্রেও কথাগুলো একইভাবে প্রযোজ্য। নাট্যচর্চাটা কোথাও পৌঁছানোর সিঁড়ি হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে অথবা সময় অতিবাহিত করার মাধ্যম হিসেবে। নিজেকে সমৃদ্ধ করার মাধ্যম হিসেবে যেদিন নাট্যচর্চার গুরুত্ব বুঝবেন তরুণরা, সেদিন এ সমস্যাগুলো থাকবে না। নিজের অভিজ্ঞতাকে সমৃদ্ধ করতে হবে। মুখস্থ দৃশ্য নির্মাণের জায়গা থিয়েটার নয়।

আমার সামনে দিয়ে যে নদী বয়ে চলেছে তার জল, ভেসে যাওয়া খড়কুটো, নৌকা, বাতাস যদি আমি স্পর্শ করতে না পারি, তবে সে নদীর চিত্র আঁকব কী করে? থিয়েটার যিনি করছেন বা যিনি কবিতা লিখছেন, তিনি যদি তাঁর সময়কে অনুভব করতে না পারেন, তবে কী করে সময়কে কাজের মধ্যে ধরে রাখবেন? এই অনুভবেরই অভাব দেখা যাচ্ছে আজকাল খুব।

প্রশ্ন : যাঁরা নাটক করতে আসছেন, ইদানীং তাঁদের পড়াশোনা কেমন? আপনি তো তরুণদের নিয়েই কাজ করেন?

উত্তর : পড়াশোনা একদমই নেই। খুব কমে গেছে। বিশ্ববিদ্যালয়েও যাঁরা পড়তে আসেন, সবাই নয়, তবে বেশির ভাগই কেবল পড়ার জন্যই পড়েন। 

প্রশ্ন : নির্দেশক হিসেবে তরুণ বয়সে বেশ কিছু কাজ করেছেন, যেগুলো উল্লেখযোগ্য। এ ছাড়া প্রায়ই এমন উদ্যোগ নিয়ে থাকেন, যাতে বিশ্ব নাট্যাঙ্গনের সঙ্গে তরুণ নাট্যকর্মীদের যোগাযোগ ঘটে। যেমন—বাইরের দেশের নাট্যকর্মীদের এখানে আনার ব্যবস্থা করা, সেমিনার কিংবা প্রদর্শনীর আয়োজন করার চেষ্টাও থাকে আপনার। এই যে এ সময়ের মঞ্চে উল্লেখযোগ্য একটি নাম সুদীপ চক্রবর্তী, কেমন লাগে বিষয়টি?

উত্তর : ভালো, তবে আমার মনে হয়, অনেক কম কাজ করতে পেরেছি সময়ের বিবেচনায়। যে গতি সময়ের, সে গতিকে আমি স্পর্শই করতে পারিনি। এমন কোনো আউটস্ট্যান্ডিং কাজ আমি করতে পারিনি এখনো। আগে যাঁরা কাজ করে গেছেন, তাঁদের উত্তরসূরি হিসেবে সময়কে ছুঁয়ে দেখার চেষ্টা করে চলেছি কেবল।

প্রশ্ন : তৃষা ভট্টাচার্য, আপনার স্ত্রী, দুজনই শিল্পচর্চা করেন। তিনি তো বিশিষ্ট সংগীতশিল্পী অনুপম ভট্টাচার্যের মেয়ে। নিজেও রবীন্দ্রসংগীতশিল্পী। কতটা মিল বা অমিল আছে, চিন্তায় বা আদর্শে?

উত্তর : মিল আর অমিল সমানে সমান। গানের পছন্দে আমাদের খুব মিল আর যেকোনো নাটক দেখে বের হওয়ার পর দেখি, অভিব্যক্তিগুলো বেশ মিলে যায়।

আর জীবন ও বোধের ক্ষেত্রে দুজন পৃথক মানুষ বলেই স্বতন্ত্র আমরা। এ কারণেই গতি থাকে সম্পর্কে, সম্পর্ক এগিয়ে যায়। তবে কাজের ক্ষেত্রে ওর উৎসাহ আর অনুপ্রেরণাই আমার শক্তি।

প্রশ্ন : জন্মদিনে কী কী করবেন আজ?

উত্তর : ক্লাস আছে, ক্লাস নিতে যাব। যেভাবে প্রতিদিন কাটাই। বিশেষ কিছু করি না কখনো।