চয়নিকা চৌধুরীর উৎকণ্ঠার ৫ দিন ও টেলিফিল্ম উদ্ধারের গল্প!

Looks like you've blocked notifications!
চয়নিকা চৌধুরী

বাংলাদেশের নাটক-টেলিফিল্ম আর চয়নিকা চৌধুরী দীর্ঘদিন ধরেই একে-অপরের পরিপূরক। চিত্রনাট্যের সঙ্গেই তাঁর ঘরসংসার, সত্তার অপর নাম। নাচ-গানেও সমান পারদর্শী।  ঈদ বা বিশেষ দিনের নাটক মানেই চয়নিকা। এ পর্যন্ত নির্মাণ করেছেন ৩৭৫টি নাটক-টেলিফিল্ম। হালের ভাইরাল-প্রিয় নির্মাতা নন তিনি। তাঁর যাত্রাপথ দীর্ঘ। মেধা, পরিশ্রম আর নিরলস সাধনার মধ্য দিয়েই তারকা-নির্মাতা হয়েছেন চয়নিকা চৌধুরী।

একটি টেলিফিল্ম নির্মাণ করতে কত ঘাম-শ্রম ঝরাতে হয়, তা নির্মাতাদের চেয়ে আর কে ভালো জানেন! কিন্তু সেই নির্মিতিই যদি যান্ত্রিক কারণে হারিয়ে যাওয়ার শঙ্কায় থাকে? আবার উদ্ধারের পর নির্মাতার মনোজগৎ কীভাবে উচ্ছ্বাসে ভরে যায়, আজ সেই উৎকণ্ঠার গল্প শুনব আমরা।

গেল ঈদের জন্য একটি টেলিফিল্ম নির্মাণ করেছিলেন চয়নিকা চৌধুরী। ইফফাত আরেফিন তন্বী রচিত টেলিফিল্মটির নাম ‘চাঁদের আলোয়’। এতে অভিনয় করেন শহিদুজ্জামান সেলিম, মাহফুজ আহমেদ, রিচি সোলায়মানের মতো নামি টিভি তারকারা। কিন্তু শুটিং শেষে সম্পাদনা করতে গিয়ে দেখেন হার্ডডিস্ক ক্র্যাশ করেছে। ঈদের ঠিক দুদিন আগে ২০ আগস্ট ডাবিং বসাতে গিয়ে এ দুঃসংবাদ তাঁকে দুঃস্বপ্নের দিকে ঠেলে দেয়! কীভাবে তা উদ্ধার হলো? টানা পাঁচদিন উৎকণ্ঠার ক্ষণগুলো এনটিভি অনলাইনকে জানিয়েছেন নির্মাতা চয়নিকা চৌধুরী।

‘২০ তারিখে যখন ডাবিং যুক্ত করব, ঠিক তখনই আমার চোখের সামনে ক্র্যাশ করল। পরের দিন এলিফ্যান্ট রোডে এক মার্কেটে গেলাম। কিন্তু সবাই বললেন ২১ তারিখ দুপুরের মধ্যে কোনোভাবেই উদ্ধার করা সম্ভব না। কারণ ঈদের ছুটি। সব বন্ধ হয়ে গেছে। তখনই সাইবার নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ তানভীর হাসান জোহার কথা মনে পড়ল। সাথে সাথে ওঁকে ফোন দিলাম। বাটা সিগন্যালে দাঁড়ালাম। আমার তখন মাথায় কাজ করছে না। কাল ঈদ। জোহা বলল, বাংলাদেশে একজন মাত্র আছেন, তিনি আইটি বিশেষজ্ঞ রুম্মন জামিল আহমেদ। তিনি যদি নেন, তাহলে রিকভার হতে পারে। নইলে এটা সম্ভব না।’

এরপর দ্রুত রুম্মনের সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগ করেন চয়নিকা চৌধুরী। রুম্মন চয়নিকাকে বললেন, তিনি কোথায় আছেন তা বলতে। বাইক চালিয়ে দ্রুতই তাঁর কাছে যাওয়ার কথা জানান। চয়নিকা বলেন, ‘এটাও বা কয়জন করে? আমার কাছে এটা বড় পাওয়া মনে হলো।’ তারপর তাঁরা একসঙ্গে রওনা হলেন।

‘আমার গাড়ি যাচ্ছে, ওঁরও বাইক যাচ্ছে। কিন্তু শিশুপার্কের সামনে বিশাল জ্যাম। এক ঘণ্টা বসে থাকলাম। ঈদের আগের দিন, গরুর হাট… এর ওপর বৃষ্টি। ভাবলাম সন্ধ্যে হয়ে গেল, আমার পক্ষে তো বসে থাকা সম্ভব না। সঙ্গে ছিল আমার অ্যাসিসটেন্ট সুব্রত মিত্র। ও আমাকে এক মুহূর্তের জন্যও ছেড়ে যায়নি। হার্ড ড্রাইভটি পলিথিনে মুড়িয়ে বুকে নিয়ে সুব্রতকে নিয়ে হাঁটা শুরু করলাম। শিশুপার্ক থেকে শ্যামলী, কল্যাণপুর, দারুসসালাম... তারও অনেক ভেতরে, যেখানে গাড়ি তো দূরের কথা, একটা রিকশাও প্রবেশ করতে পারে না। বাজারের ভেতরে তাঁর বাসা। সেখানে যখন পৌঁছালাম তখন রাত ৯টা ২০ মিনিট। বললেন, রেখে যান, আমি দেখছি।’

পরের দিন ঈদ। নির্মাতা চয়নিকা চৌধুরী সারাদিন প্রার্থনা করতে থাকলেন। ঈশ্বরের কাছে মানত করলেন। খাওয়া-দাওয়ার পাঠ চুকে গেছে। বাসায় সোফায় বসেই কাটিয়ে দিলেন দিন। ডাটা রিকভারি বিশেষজ্ঞ রুম্মন জামিল আহমেদকে ফোন দেননি। ফোন দেননি পরের দিনও, যাতে কাজে ব্যাঘাত না ঘটে।

চয়নিকা বলেন, ‘ঈদের দ্বিতীয় দিন রাতে তাঁকে ফোন দিলাম। তিনি আমাকে একটি টেক্সট পাঠালেন যে, আপা আমি কাজ করছি। ঈদের তৃতীয় দিন শুক্রবার ছিল। আমি রাতে এনটিভিতে আসলাম। কারণ আমি খুব চিন্তিত ছিলাম। এর মধ্যে সবাই জেনে গেছে হার্ড ড্রাইভ নষ্ট হওয়ার কথা। সবাই বলল, এটা দ্রুত উদ্ধার করা সম্ভব হবে না। এক-দুই মাস লেগে যাবে। কিন্তু আমার হাতে খুব কম সময়। দুদিনের মধ্যে আমাকে পেতে হবে। না হলে টেলিফিল্মটি অন-এয়ার হবে না।’

চারদিন পর ২৫ আগস্ট সকালে রুম্মন জানালেন, প্রজেক্ট পুরো পাওয়া গেছে। কিন্তু ফুটেজের পুরোটা পাওয়া যায়নি। ফুটেজ পাওয়া না গেলে কী করবেন চয়নিকা! বলেন, ‘এনটিভিতে গেলাম। কামাল আঙ্কেল (এনটিভির অনুষ্ঠান-প্রধান মোস্তফা কামাল সৈয়দ) আমাকে বললেন, তোমাকে একমাত্র বাঁচাতে পারেন আল্লাহ। আমি নামাজে তোমার জন্য দোয়া করেছি। রুম্মনের সঙ্গে আমাকে একটু কথা বলিয়ে দাও। কথাও বললেন। রাত ১১টায় আমি প্রজেক্টসহ সবকিছু পেলাম। এরপর প্যানেলে গেলাম। ২৫ তারিখ সারারাত, ২৬ তারিখ সারাদিন-সারারাত কাজ করলাম। পরের দিন ২৭ আগস্ট, ভোর ৬টায় টেলিফিল্মটি জমা দিলাম। এদিনই টেলিফিল্মটি অন-এয়ারে যায়।’

এখানেই গল্পের শেষ নয়। টেলিফিল্মটি এনটিভিতে প্রচারিত হলেও অনলাইনে দেওয়া হয়নি। কারণ, মিউজিক তাড়াহুড়া করে করা হয়েছিল। ভালো হয়নি। গতকাল (২৯ আগস্ট) পুনরায় মিউজিক করতে হয় নির্মাতা চয়নিকা চৌধুরীকে। বলেন, ‘রিকভারি করতে মোট ৪০ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। নিজের টাকা খরচ করে স্টুডিও ভাড়া করে মিউজিক করেছি। ফাহমিদা নবী আপু গান গেয়েছেন। সারারাত মিউজিক শেষ করে ভোরে বাসায় ফিরেছি। এত টাকা খরচ হওয়ার পরও প্রযোজক কাজী নয়নকে ফোন দিয়ে জ্বালাতন করিনি।’

‘চাঁদের আলোয়’ টেলিছবিটি চয়নিকা চৌধুরীর ৩৭৫তম। এ টেলিছবিটির শুটিং হয়েছে ফরিদপুরে। টানা ছয়দিন শুটিং করেছেন। স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেনের বাড়িতে শুটিং করেন তিনি। জানান, ফরিদপুরবাসী পুরো টিমকে সহায়তা করেছে। সেজন্য তিনি কৃতজ্ঞ।

পুরো টিমকেই কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন এ নাট্যনির্মাতা। বিশেষ করে, প্রযোজক কাজী নয়নকে। বলেন, ‘হার্ডড্রাইভ ক্র্যাশ করার পর প্রযোজক আমাকে ফোন করেননি, আমি যেন বিরক্ত না হই। আর ডাটা রিকভারি বিশেষজ্ঞ রুম্মন জামিল আহমেদের কাছে আজীবন কৃতজ্ঞ আমি।’ অভিনেতা মাহফুজ আহমেদের প্রতিও কৃতজ্ঞতা জানান তিনি।

এবার মানতের গল্প। চয়নিকা চৌধুরী মানত করেছিলেন টেলিফিল্মটি রিকভার হলে সিলেটে হজরত শাহজালাল (রহ.) ও হজরত শাহ পরানের (রহ.) মাজার জিয়ারত করবেন। নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁ উপজেলার বারদীতে লোকনাথ ব্রহ্মচারীর আশ্রমে গিয়েও প্রার্থনা করবেন। বলেন, ‘আগামী শনিবার সকালে সিলেট যাব। মাজার জিয়ারত করব। আর আগামী মাসে অভিনেতা মাহফুজ আহমেদ দেশে ফিরলে ফরাশগঞ্জের এক অনাথ আশ্রমে যাব। সেখানে ১০০ জন এতিম শিশুকে খাওয়াব।’

১৮ বছর ধরে চিত্রনাট্য লেখা ও নাটক নির্মাণ করছেন চয়নিকা চৌধুরী। কাজপাগল মানুষ। সবাই তাঁকে ভালোবাসেন। বলেন, সবার প্রার্থনায় তিনি টেলিফিল্মটি উদ্ধার করতে পেরেছেন। আগামীকাল শুক্রবার এনটিভি অনলাইনের ইউটিউব চ্যানেলে ‘চাঁদের আলোয়’ টেলিফিল্মটি প্রচারিত হবে। সবাই যেন এনটিভির ইউটিউব চ্যানেলে গিয়ে নাটকটি দেখেন। তাইলেই তাঁর কষ্ট স্বার্থক হবে।