অজানা সালমানকে মেলে ধরলেন মতি
ঢাকাই চলচ্চিত্রের তুমুল জনপ্রিয় নায়ক সালমান শাহর ২২তম মৃত্যুবার্ষিকী আজ। তাঁরই স্মরণে নিজের মেয়েকে দিয়ে কোরআন খতম করিয়েছেন সালমান শাহর একসময়ের ঘনিষ্ঠ সহকারী মোহাম্মদ মতি। নিজের দৈন্যদশার ভেতরও বাসায় মিলাদের আয়োজন করেছেন তিনি। প্রথমবারের মতো কবর জিয়ারত করতে আগামীকাল সিলেট যাচ্ছেন মতি, সঙ্গে থাকবে ১১ বছর বয়সের মেয়ে আকলিমা মিম আর ছেলে সাত বছরের ইসমাইল হোসেন। সিলেটে যাওয়ার আগে আজ বৃহস্পতিবার এনটিভি অনলাইনের সঙ্গে সালমানকে নিয়ে স্মৃতির ভাণ্ডার খুলে বসেন মতি।
মতি বলেন, “ভাই যখন মারা যান, তখন আমি কক্সবাজারে ছিলাম। সেখানে ‘চাওয়া থেকে পাওয়া’ ছবির গানের শুটিং হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু হঠাৎ করেই খবর পাই, ভাই মারা গেছে। আমি সকালে একজনের কাছ থেকে একশ টাকা নিয়ে অনেক কষ্ট করে বাসে, ট্রেনে করে ঢাকায় আসি। ভেঙে ভেঙে আসতে দুই দিন লেগে যায়। এসে আমি আর লাশ দেখতে পারিনি। বিষয়টি নিয়ে এত মন খারাপ হয় যে আমি আর কোনো দিনই ভাইয়ের কবর জিয়ারত করতে সিলেট যাইনি। তখন নিয়ত করেছিলাম, আমি তো আর কোরআন পড়তে পারি না। আমার যখন সন্তান হবে, তাকে দিয়ে কোরআন খতম করাব। তারপর সন্তানকে নিয়ে কবর জিয়ারত করব।”
নিজের অর্থনৈতিক অবস্থা ততটা ভালো নয়। তারপরও সালমানকে মতি রেখেছেন মনে মণিকোঠায়। তাই নিজের সামর্থ্য অনুযায়ী আজ বাদ আসর মিলাদের আয়োজন করেছেন মতি। বলেন, ‘আমার তো আর টাকা নাই, তাই জিলাপি দিয়েই মিলাদ পড়াব। আর আগামীকাল ছেলেমেয়েকে নিয়ে ভাইয়ের কবর জিয়ারত করতে যাব।’
সালমান শাহর সঙ্গে পরিচয় পর্ব নিয়ে মতি বলেন, “ভাইয়ের দ্বিতীয় ছবি ‘স্নেহ’। এই ছবিতে আমি প্রোডাকশন-বয় হিসেবে কাজ করেছি। প্রথম দিন শুটিংয়ের সময় ভাইকে আমি পানি দিতে গেলে আমাকে দেখে অবাক হন। তখন জানতে চান, আমি এখানে কী করছি। তখন আমার বয়স ছিল মাত্র ১২ বছর। আবার দেখতেও আমি অনেক ছোট। তারপর ভাই আমাকে ডেকে বললেন, এখন থেকে তিনি যে যে ছবিতে কাজ করবেন, তুমিও আমার সঙ্গে সেই ছবিতে কাজ করবে। সেই থেকেই ভাইয়ের সঙ্গে ছিলাম।”
সালমান শাহর স্মৃতিচারণ করে মতি বলেন, ‘ভাই গাড়ি চালাতে অনেক ভালোবাসতেন। শুটিং শেষ করে রাত ২টা-৩টা পর্যন্ত গাড়ি নিয়ে ঘুরতেন। উত্তরা গিয়ে এক দোকান থেকে চিতই পিঠা খেতেন। আবার নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর ঘুরতে চলে যেতেন। তবে অনেক জোরে গাড়ি চালাতেন, আমার ভয় লাগত। সে সময় এফডিসিতে সবাই বলত, সালমান শাহ যেকোনো সময় গাড়ি অ্যাকসিডেন্টে মারা যাবে।’
সালমানকে নিয়ে মতির গল্প যেন শেষ হয় না। ঢাকা থেকে এবার তিনি ছোটেন বান্দরবানে। বলেন, ‘আমরা একটি ছবির গানের শুটিং করতে বান্দরবান যাচ্ছিলাম। আমি, ভাই ও ছটকু আহম্মেদ স্যার। এমনভাবে গাড়ি চালাচ্ছিলেন যে আমি সিট থেকে নেমে নিচে বসেছিলাম। চট্টগ্রাম গিয়ে আমি আর ছটকু স্যার নেমে যাই, কারণ এত জোরে গাড়ি চালালে আমরা তাঁর সঙ্গে যাব না। তারপর অনেক বুঝিয়ে সালমান ভাই আমাদের আবার গাড়িতে তোলেন।’
অভিনয় করার সময় নায়িকারা কেন, নায়করাও চড়া মেকআপ নেন। কিন্তু সালমান শাহ ছিলেন ব্যতিক্রম। মতি বলেন, “ভাই কখনো মেকআপ নিতেন না। আমার কাছে একটা ফ্লাস্ক থাকত, সেটার মধ্যে একটা ভেজা কাপড় থাকত। শটের আগে শুধু মুখটা ভালো করে মুছে নিতেন। চরিত্রের প্রয়োজনে গেটআপ নিতেন, কিন্তু মেকআপ নিতেন না। তবে প্রথম ছবি ‘কেয়ামত থেকে কেয়ামত’ ছবিতে তিনি মেকআপ নিয়ে অভিনয় করেছিলেন।”
সালমান শাহর আরো একটি মজার ঘটনা বলেন মতি। পকেটমার ধরার কাহিনী। মতি বলেন, ‘একদিন ভাইসহ আমরা এফডিসি আসছিলাম। তখন দেখি, গেটে কোনো একটা সমস্যা হয়েছে। কী হয়েছে জানতে চাইলে দারোয়ান জানান, গেটে কয়েকজনের মানিব্যাগ চুরি হয়েছে। দর্শনার্থীদের ভেতরেই পকেটমার ছিল। এ কথা শুনে আমরা শুটিংয়ে চলে যাই। সারা দিন ভাই খবর নিয়েছেন, এই এলাকায় কারা পকেট মারে, তাদের কোথায় পাওয়া যাবে। সন্ধ্যার পর ভাই আমাকে নিয়ে কারওয়ান বাজার রেললাইনে যান। সেখানে গিয়ে তিনজন পকেটমার ধরেন। নিজের পকেট থেকে তাদের টাকা দিয়ে বলেন, চুরি না করে তারা যেন ব্যবসা করে।’
১৯৯৩ সালে সোহানুর রহমান সোহান পরিচালিত ‘কেয়ামত থেকে কেয়ামত’ ছবির মাধ্যমে সালমান শাহ চলচ্চিত্রে অভিনয় শুরু করেন। তাঁর অভিনীত ২৭টি ছবিই দর্শকপ্রিয় হয়। ১৯৯৬ সালের ৬ সেপ্টেম্বর রহস্যজনকভাবে তাঁর মৃত্যু হয়। এর পর ২২ বছর কেটে গেলেও উন্মোচন হয়নি তাঁর মৃত্যুর রহস্য।