বিশেষ প্রতিবেদন

‘এফডিসি একসময় ভূতের বাড়িতে পরিণত হবে’

Looks like you've blocked notifications!

একটা সময় বাংলাদেশ চলচ্চিত্র উন্নয়ন করপোরেশন, এফডিসিতে গেলে এক মাথা থেকে আরেক মাথায় যেতে সময় লাগত ঘণ্টা খানেক। তখন এফডিসির আয়তন বেশি ছিল না ঠিকই, কিন্তু একটু পর পরই দেখা যেত সেট ফেলে চলছে শুটিং। কেউ চাইলেই এক মাথা থেকে অন্য প্রান্তে যেতে পারত না, যতক্ষণ না পর্যন্ত ক্যামেরা বন্ধ না হয়। এখন আর সেই দৃশ্যে চোখে পড়ে না। এর কারণ এফডিসিতে এখন আর শুটিং করতে আগ্রহ দেখান না নির্মাতারা। কেন আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন তারা?

নির্মাতারা জানান, বাইরের থেকে অনেক বেশি ভাড়া গুনতে হয় তাদের এফডিসিতে শুটিং করতে গেলে। সরকারি প্রতিষ্ঠানটি থেকে ক্যামেরা ভাড়া নিয়ে অনেকেই পড়েন বিপদে। এর কারণ শিফট হিসেবে অনেক টাকা দিতে হয়, আর শুটিংয়ে সময়সীমা অতিক্রম করলে সেটা নিয়েও পোহাতে হয় ঝক্কি।

বাংলাদেশ চলচ্চিত্র পরিচালক সমিতির মহাসচিব বদিউল আলম খোকন এনটিভি অনলাইনকে তিনি বলেন, ‘এফডিসিতে এখন আর শুটিং করার পরিবেশ নেই। বাইরের প্রোডাকশন হাউজ থেকে তিনগুণ ভাড়া গুনতে হয় এখানে। বাইরের হাউজ থেকে আমরা ক্যামেরা নিয়ে ঢাকার বাইরে শুটিং করতে গেলে, যাওয়া ও আসার দুদিনের ভাড়া দিতে হয় না। এফডিসতে আমরা এত দিন ধরে ছবি নির্মাণ করছি, সবসময় যাওয়া বা আসার একদিনের ভাড়া দিতে হতো। অথচ এখন যাওয়া ও আসা দুদিনের ভাড়াই দিতে হচ্ছে।’

খোকন আরো বলেন, ‘এমনকি যাওয়া-আসার সময় বেশি শিফট ধরা হয়। গত ১৫ অক্টোবর আমাদের একজন পরিচালক কক্সবাজারে শুটিং করতে যান। তিনি ফেরেন ২৫ তারিখ। কিন্তু ভাড়া দিতে গিয়ে দেখেন ১৫ তারিখ দুই শিফট ও ২৫ তারিখ তিন শিফট ভাড়া ধরা হয়েছে। আমি পরিচালক সমিতির প্রতিনিধি হিসেবে এমডি সাহেবের সাথে কথা বলতে গিয়েছিলাম। তিনি প্রথমে আশ্বাস দিয়েছিলেন একদিনের ভাড়া মওকুফ করা হবে। কিন্তু তা আজও করা হয়নি।’

অথচ এফডিসির নিয়মেই আছে যন্ত্রপাতি জমা না দিয়ে যদি প্রযোজক ও পরিচালক নিজেদের কাছে রেখে দেন তাহলে দুই শিফটের ভাড়া দিতে হবে। আর ঢাকার বাইরে দূরে কিংবা বিদেশে শুটিং করতে গেলে যাওয়া-আসার মধ্যে একদিনের বিল রাখা হবে। খোকন এই বিষয়টি উল্লেখ করে জানান, এফডিসি নিজেদের নিয়মই মানছে না।

খোকন অভিযোগ করেন, ‘এফডিসির এমডি হিসেবে এখন যিনি আছেন তিনি তো আর চলচ্চিত্রের মানুষ নন। যে কারণে চলচ্চিত্রের প্রতি তার ভালোবাসাটা কম। তিনি আমাকে এমনও বলেছেন, প্রয়োজন হলে তিনি চলচ্চিত্রের কাজে কোনো কিছু ভাড়া দেবেন না। বিজ্ঞাপন ও টিভির কাজে যন্ত্রপাতি ভাড়া দিলেই এফডিসি চলবে।’

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, এফডিসিতে রেড স্কারলেট ক্যামেরার ভাড়া প্রতি শিফট সাড়ে চার হাজার টাকা। এই টাকার মধ্যে ক্যামেরার মূল অংশ, লেন্স ও ট্রাইপডের জন্য আলাদা আলাদা হিসাবে ভাড়া ধরা হয়। একদিনে দুই শিফট হিসেবে এই ক্যামেরার ভাড়া দাঁড়ায় নয় হাজার। তা ছাড়া রাত ১১টার পরে শুটিং করলে প্রতিঘণ্টার জন্য অতিরিক্ত টাকা গুনতে হয় প্রযোজকের। আর রাত ১১টার পর যদি তিন ঘণ্টা পেরিয়ে যায় তাহলে এক শিফটের ভাড়া সাড়ে চার হাজার টাকা বেশি দিতে হয়। কারো যদি পুরো দিন গড়িয়ে রাত দুটা পর্যন্ত শুটিং চলে তাহলে তার ক্যামেরার ভাড়া পড়ে  সাড়ে ১৩ হাজার টাকা। অথচ বাইরের যেকোনো প্রোডাকশন হাউজ থেকে ২৪ ঘণ্টার জন্য এই রেড স্কারলেট ক্যামেরা ভাড়া পাওয়া যায় সাড়ে চার হাজার থেকে পাঁচ হাজার টাকায়। এফডিসিতে ১৬ ঘণ্টাতেই দিতে হচ্ছে নয় হাজার টাকা। আর ১৯ ঘণ্টা ব্যবহারে খরচ পড়ছে সাড়ে ১৩ হাজার টাকা। এফডিসিতে সকালে অফিস খোলার পর ক্যামেরা বের করতে করতে বেজে যায় সকাল ৯টা। প্রথম শিফট শেষ হয় বিকেল ৪টায়। ৪টা থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত দ্বিতীয় শিফট ধরা হয়। দ্বিতীয় শিফট অতিক্রম করলেই বাড়তি টাকা যোগ করতে হয় ভাড়ার সঙ্গে।

এদিকে, সনি এফ-৫৫ ক্যামেরার জন্য এফডিসি ভাড়া নিচ্ছে শিফট প্রতি সাড়ে পাঁচ হাজার টাকা, একদিনে অর্থাৎ সকাল ৮টা থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত ঘণ্টায় এই ক্যামেরার ভাড়া পড়ছে ১১ হাজার টাকা। কিন্তু ক্যামেরা কখনোই সকাল ৮টায় বের করা যায় না। এর কারণ দাপ্তরিক অনুমোদন ও ক্যামেরা তৈরি করে বের করতে এক ঘণ্টার মতো সময় লেগে যায়। এখানেও ক্ষতিগ্রস্ত হন প্রযোজকরা। এফডিসির এক শিফটের ভাড়া দিয়েই বাইরে থেকে সনি ক্যামেরা ভাড়া নেওয়া যায় ২৪ ঘণ্টার জন্য। বাইরে এই ক্যামেরার ভাড়া পড়ে ২৪ ঘণ্টায় ছয় থেকে সাত হাজার টাকা মাত্র। রেড ড্রাগন ক্যামেরার জন্য এফডিসি নিচ্ছে সাড়ে ছয় হাজার টাকা প্রতি শিফট, দুই শিফটে (১৬ ঘণ্টা) এর খরচ পড়ে ১৩ হাজার টাকা। সেখানে একই ক্যামেরা বাইরে খরচ পড়ে ২৪ ঘণ্টার জন্য মাত্র আট হাজার টাকা। তাহলে নির্মাতারা কেন এফডিসি থেকে ক্যামেরা ভাড়া নেবেন। এ বিষয়ে এনটিভি অনলাইনের সঙ্গে কথা হয় এফডিসির সহকারী পরিচালক (শিডিউল) খন্দকার মশিউল আলমের সঙ্গে।   

মশিউল আলম বলেন, ‘আমাদের নিয়ম অনুযায়ী যাওয়া-আসার মধ্যে একদিনের ভাড়া ধরা হয়। গত মাসে ওয়াহিদুল হক ডায়মন্ড সাহেব একটি শুটিংয়ে গিয়েছিলেন গত মাসের ১৫ তারিখ, ক্যামেরা জমা দিয়েছেন ২৬ তারিখ সকালে। আসলে তিনি যদি ভোর ৪টায় ঢাকায় ফেরেন। আমরা ক্যামেরা জমা নিই সকাল ৮টায় অফিস খোলার পর, যে কারণে আরেক দিনের ভাড়া এখানে যুক্ত হয়ে গেছে। আমাদের হিসাব হচ্ছে রাত ১২টা পাড় হলেই আরেক দিন শুরু হয়ে যায়।’

ক্যামেরার ভাড়া এফডিসিতে এত বেশি কেন জানতে চাইলে মশিউল আলম বলেন, ‘আসলে একটা ক্যামেরার মূল্য পড়ে দুই কোটি টাকা। সেটি যদি দুই বছর চালানো যায়, তা হলে প্রতিদিন কত ভাড়া পড়ে? আমরা এসব হিসাব করে টাকাটা নির্ধারণ করেছি? আমাদের একটি বোর্ড আছে, সেখানেই ভাড়াগুলো নির্ধারণ করা হয়। যে কারণে এখানে আমাদের কিছু করার নেই।’

বাইরের হাউজগুলো কীভাবে কম ভাড়ায় একই ক্যামেরা ভাড়া দিচ্ছে, এমন প্রশ্নের জবাবে মশিউল আলম বলেন, ‘আসলে বাইরে প্রোডাকশন হাউজগুলো ব্যক্তি মালিকের, এখানে তিনি চাইলে কাউকে টাকা ছাড়াও ক্যামেরা দিয়ে দিতে পারেন। তাদের সাথে আমাদের হিসাব মিলবে না।’

শিফট প্রতি বেশি ভাড়া ও নানা রকম নিয়মের বাড়াবাড়ির কারণে অনেক নির্মাতাই এখন আর এফডিসি থেকে ক্যামেরা ভাড়া নিতে চান না। জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারপ্রাপ্ত ক্যামেরাম্যান মাহফুজুর রহমান মনে করেন, এফডিসির উচিত ভালো ছবি তৈরিতে সাহায্য করা, অথচ তারা ব্যবসা করছে। তিনি বলেন, ‘এফডিসি তৈরি হয়েছে আমাদের ভালো চলচ্চিত্র নির্মাণে সহযোগিতা করার জন্য। অথচ এখন তারা ব্যবসা শুরু করে দিয়েছে। যখন বাইরের হাউজ থেকে সেটাপ নিয়ে শুটিং করি, তখন খরচ অর্ধেক হয়ে যায়। শুটিং করার সময় আমাদের মাথায় সময় থাকে না। শুটিং তো আর ৯টা ৫টা চাকরির মতো নয়। কিন্তু দেখুন এফডিসির সেটাপ নিয়ে শুটিং করার সময় মাথায় অনেক কিছু রাখতে হয়। যে কারণে এখন যে কাজগুলো হচ্ছে, তারা এফডিসির বাইরে থেকে সেটাপ নিয়ে শুটিং করছে। আমিও বাইরে থেকেই জিনিসপত্র ভাড়া নিই।’

মাহফুজুর রহমান আরো বলেন, ‘এফডিসির সেটাপ নিয়ে শুটিং করার ঝামেলা অনেক। ধরেন আমরা সূর্য উদয়ের একটা শট নেব। কিন্তু এফডিসি থেকে ক্যামেরা নিতে গেলে ক্যামেরা হাতে পাব সকাল ৯টায়। সারাদিন ক্যামেরা নিয়ে ভাড়া গুনতে হবে। পরের দিন ভোরে শট নেওয়ার পর আবারও সকাল ৯টার পর জমা দিতে হবে। তখন ভাড়া গুনতে হবে চার শিফটের। ক্রিয়েটিভ কাজ কি অফিসের সময় ধরে হয়?’

এফডিসির সমালোচনা করে মাহফুজুর রহমান আরো বলেন, ‘এফডিসিকে হতে হবে সেবামূলক প্রতিষ্ঠান। এখানে বাইরের প্রতিষ্ঠান থেকেও কম মূল্যে সব কিছু পাওয়া যাবে। অফিশিয়াল টাইম হিসাব করে ক্যামেরা, লাইট, টেকনিক্যাল সাপোর্ট কি দেওয়া যায়? আর এমডি হিসেবে দায়িত্ব নিতে হবে চলচ্চিত্রের মানুষকে। সেবার নামে ব্যবসা করলে এফডিসি একসময় ভূতের বাড়িতে পরিণত হবে, যা এরই মধ্যে হওয়া শুরু হয়েছে।’