পর্দার পেছনে

সিনেমার শুটিংয়ে অস্ত্র আসে কোথা থেকে?

Looks like you've blocked notifications!
মোহম্মদ কামরুজ্জামান দীর্ঘদিন ধরেই এফডিসিতে প্রপস ভাড়া দেওয়ার ব্যবসা করছেন। ছবি : মোহাম্মদ ইব্রাহিম

নায়ক দৌঁড়াচ্ছে। পেছনে পুলিশের একটি দল। তাদের হাতে পিস্তল ও বন্দুক। গুলি ছুড়ছে পুলিশ। নায়কও ছুটছে। হঠাৎ করেই নায়কের পিঠে গুলি লাগল। ফিনকি দিয়ে রক্ত বেরুল। সঙ্গে ধোঁয়া। ঢাকাই চলচ্চিত্রের অ্যাকশন দৃশ্যে এমন গোলাগুলির দৃশ্য প্রায়ই দেখা যায়। অনেক দর্শকই মনে করেন ছবিতে ব্যবহৃত অস্ত্রগুলো বোধহয় সত্যিকারের। কিন্তু চলচ্চিত্রের ভাষায় এগুলোকে বলে প্রপস। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এসব প্রপস বা আগ্নেয়াস্ত্রগুলো থাকে নকল, কিন্তু দেখতে একেবারে আসলের মতো। এনটিভি অনলাইনের চলচ্চিত্র বিষয়ক ধারাবাহিক ‘পর্দার পেছনে’ চলুন আজ জেনে নেওয়া যাক ছবিতে এই আগ্নেয়াস্ত্রগুলো কোথা থেকে আসে। আর এটিকে কেন্দ্র করে যারা জীবিকা নির্বাহ করে তাদের আয় রোজগারই বা কেমন।

মোহম্মদ কামরুজ্জামান দীর্ঘ দিন ধরেই এফডিসিতে প্রপস ভাড়া দেওয়ার ব্যবসা করছেন। ১৯৯২ সাল থেকেই তিনি শুটিংয়ের জন্য অস্ত্র ও পোশাক সরবরাহ করে আসছেন। নিজে একটি ছবিতে অভিনয়ও করেছিলেন, পুলিশের চরিত্রে। সেটি অবশ্য প্রপসের ব্যবসা শুরুর আগে ১৯৮৮ সালে। এরপর থেকেই প্রোডাকশন ম্যানেজার আলি আজাদের সঙ্গে সহকারী হিসেবে চার বছর কাজ করেন কামরুজ্জামান। তার কাছ থেকেই মূলত কামরুজ্জামান প্রপসের ব্যবসা শেখেন এবং একপর্যায়ে তার কাছ থেকে সবকিছু কিনে নেন। স্বতন্ত্রভাবে তিনি ব্যবসা শুরু করেন ১৯৯২ সালে। তখন থেকেই তিনি শুধু অস্ত্র ও পোশাক সরবরাহ করতে থাকেন শুটিং ইউনিটগুলোতে।

‘ক্যাপ্টন খান’ ছবির দৃশ্যে শাকিব খান ও  ‘দাগ হৃদয়ে’  ছবির দৃশ্যে বাপ্পী-আঁচল। ছবি : আফতাব

এনটিভি অনলাইনকে মোহম্মদ কামরুজ্জামান জানান তার সংগ্রহে থাকা বিভিন্ন ধরনের নকল অস্ত্রের কথা। তিনি বলেন, ‘আমার কাছে থ্রি নট থ্রি রাইফেল, পিস্তল, এ কে ৪৭ রাইফেলসহ চার থেকে পাঁচ ধরনের অস্ত্র রয়েছে। সাধারণত আমরা সিনেমার শুটিংয়ে এসব অস্ত্র দিয়ে থাকি। পিস্তল ও এ কে ৪৭ এগুলো বেশি নেয় শুটিংয়ে, থ্রি নট থ্রি শুধু  মুক্তিযুদ্ধের ছবিগুলোতে ব্যবহার করা হয়।’

কত টাকায় এসব ভাড়া দেওয়া হয় জানতে চাইলে কামরুজ্জামান বলেন, ‘আমার সব অস্ত্রের ভাড়াই এক। দুইশত টাকা করে আমরা ভাড়া দিয়ে থাকি। আর পুলিশের পোশাক যদি কেউ নেয়, অস্ত্রসহ ভাড়া পড়ে ৪০০ টাকা। তবে কেউ যদি এফডিসির বাইরে গিয়ে শুটিং করে, সেক্ষেত্রে আমরা যাওয়া-আসার ভাড়া নেই।’

তবে ইদানীং অস্ত্র ভাড়া নেওয়া কমে যাচ্ছে জানিয়ে কামরুজ্জামান বলেন, ‘এখন সিনেমার শুটিং কমে গেছে। বিজ্ঞাপন ও নাটকেও আমরা অস্ত্র  ভাড়া দিয়ে থাকি। আগে মাসে ৪০ হাজার টাকা কামাই করতে পারতাম। এখন ২০ হাজার টাকার মতো কামাতে পারি। আমাদের এই অস্ত্রগুলো পুরাতন, এখন সময়ের প্রয়োজনে আধুনিক অস্ত্র ব্যবহার করতে হয়, সেগুলো আমাদের সেট ডিরেক্টরদের ডিজাইন দিয়ে দিলে আমরা বানিয়ে দেই।’

আধুনকি অস্ত্রের নকশা অনুযায়ী নকল অস্ত্র বানাতে পারদর্শী সেট ডিরেক্টর মোহাম্মদ মোখলেসুর রহমান। তিনি জানালেন কীভাবে এই কাজটি তারা করেন। তিনি বলেন, ‘আধুনিক পিস্তল বানাতে গেলে আমরা যাত্রাবাড়ী থেকে বানিয়ে আনি। যে ডিজাইনই দেন না কেন, আমরা সেটাই বানিয়ে দিতে পারব। বেশ কিছু সিনেমার জন্য আমি পিস্তল ও শটগান বানিয়ে দিয়েছি। দুটোর জন্যই ডাইস বানাতে হয়, যে কারণে টাকা একটু বেশি প্রয়োজন হয়। আমরা প্রত্যেকটা পিস্তল বানানোর জন্য  নিয়ে থাকি দুই হাজার টাকা। আর শটগানের জন্য আমরা চার হাজার টাকা নিয়ে থাকি। তবে এখন অনেক পরিচালক অস্ত্র বানানোর চেয়ে মার্কেট থেকেই কিনে ফেলেন।  খেলনা অস্ত্র কিনতে পাওয়া যায়।’

‘অন্ধকার জগৎ’ ছবির দৃশ্যে ডি এ তায়েব, মাহি ও মৌমিতা মৌ। ছবি : আইয়ুব আকন্দ

পুরোনো আমলের অস্ত্র এখন আর চলচ্চিত্রে সেভাবে ব্যবহার হয় না। তাই এ সময়ের পরিচালকদের পছন্দ আধুনিক অস্ত্র। তবে দামের দিকটাও তাদের নজরে রাখতে হয়। পরিচালক শফিক হাসান তাই বলেন, ‘ছবিতে আমাদের এখন আধুনিক অস্ত্র প্রয়োজন হয়। সেটা বানিয়ে নিলেও অনেক খরচ পড়ে যায়। যে কারণে মার্কেট থেকে কিনে ফেলাই সহজ কাজ। এখন বসুন্ধরা মার্কেট থেকে এক হাজার ২০০ টাকা দিয়ে সুন্দর পিস্তল কিনতে পাওয়া যায়। আর খেলনা শটগান পাবেন আড়াই হাজার টাকায়। সেগুলো দেখতে একেবারেই আসল পিস্তলের মতো। আবার কিছু পিস্তল আছে যেগুলো দিয়ে গুলির খোসা বের হতে দেখা যায়, সেগুলো ব্যাংকক থেকে আনাতে হয়।’

‘ধুমকেতু’ ছবিতে শাকিব খান যে পিস্তলটি ব্যবহার করেছেন, সেটি ব্যাংকক থেকে আনানো বলে জানান শফিক হাসান। তিনি বলেন, ‘শাকিব খানের ব্যবহৃত ওই পিস্তলটা আনাতে খরচ পড়েছিল মোট তিন হাজার টাকা। দেখলে মনে হয় একেবাইরে আসল পিস্তল। তবে এখন শুটিং করতে গেলে অনেকেই আসল অস্ত্রও ব্যবহার করে থাকে।’

পরিচালক বদিউল আলম খোকনও জানান, এফডিসি থেকে তারা অস্ত্র ভাড়া করেন, তবে শুটিংয়ের প্রয়োজনে কখনো সেটা বাইরে থেকেও কিনতে হয় তাদের। বলেন, ‘আমরা এফডিসির কামরুজ্জামানের কাছ থেকে অস্ত্র নিয়ে শুটিং করে থাকি। বিশেষ কারণে আমাদের অস্ত্র কিনেও ব্যবহার করতে হয়।’

আসল অস্ত্র ব্যবহার প্রসঙ্গে প্রযোজক মোহাম্মদ ইকবাল বলেন, “‘শ্যুটার’ ছবিতে আমি আসল অস্ত্র ব্যবহার করেছি। আমার দুটি লাইসেন্স করা শটগান আছে, বন্ধুদেরও আগ্নেয়াস্ত্র আছে। সেগুলোই ব্যবহার করেছি। মানুষ এখন অনেক আধুনিক,  নকল কিছু দেখতে চায়না, তা ছাড়া দেখতে ভালোও লাগে না, যে কারণে নকল অস্ত্র ব্যবহার করিনি। তবে নায়ক ছাড়া অন্যদের হাতের অস্ত্রগুলোর ক্ষেত্রে এফডিসির অস্ত্রই ব্যবহার করি।’