সোনার কন্যা ও উড়াল পঙ্খী এলো যেভাবে
আশির দশকের পর সুবীর নন্দীর সংগীতজীবনের দ্বিতীয় ইনিংস শুরু হয়। ‘একটা ছিল সোনার কন্যা’ এবং ‘ও আমার উড়াল পঙ্খী রে’ দিয়ে আবারও শুরু হয় তাঁর সংগীতের নতুন জীবন।
প্রয়াত কিংবদন্তি কথাশিল্পী হুমায়ূন আহমেদের ‘শ্রাবণ মেঘের দিন’ (১৯৯৯) ছবিতে ‘একটা ছিল সোনার কন্যা’ গানটি গেয়ে সেরা সংগীতশিল্পী হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পান সুবীর নন্দী। ‘চন্দ্রকথা’ (২০০৩) ছবিতে সুবীর নন্দীর গাওয়া ‘ও আমার উড়াল পঙ্খী রে’ গানটিও হয় ব্যাপক জনপ্রিয়। হুমায়ূন আহমেদের লেখা এই গান দুটির সুর ও সংগীত পরিচালনা করেন বরেণ্য সুরকার এবং সংগীত পরিচালক মকসুদ জামিল মিন্টু। গান দুটি তৈরির পেছনের গল্প নিয়ে এনটিভি অনলাইনের সঙ্গে কথা বলেছেন মকসুদ জামিল মিন্টু।
‘একটা ছিল সোনার কন্যা’
হুমায়ূন ভাই (হুমায়ূন আহমেদ) ‘একটা ছিল সোনার কন্যা’ গানটির লিরিক আমাকে দিয়ে এর সুর করতে বলেন। সুবীর নন্দী গানটি গাইবেন, এটাও চূড়ান্ত হয়। কিন্তু কী মনে করে এই গানটির সুর করতে আমি একদম ভুলে গিয়েছিলাম। নির্ধারিত সময় অনুযায়ী হুমায়ূন ভাই আমাকে ফোন করে বলেছিলেন, ‘মিন্টু ভাই, গানটির কি সুর হয়েছে? আমি স্টুডিওতে বসে আছি, আসো।’ উত্তরে আমি বলেছিলাম, ‘হয়েছে সুর। আসতেছি ভাই।’ আসলে তখনো সুর করি নাই। প্যান্টের পেছনের পকেটেই ছিল ‘একটা ছিল সোনার কন্যা’র গানের লিরিকের কাগজ। সবকিছু অসম্পূর্ণ থাকলেও বাসা থেকে বের হয়ে স্টুডিওতে যাই। সেখানে অপেক্ষা করছিলেন হুমায়ূন আহমেদ ও সুবীর নন্দী। এটাই ছিল সুবীর নন্দীর সঙ্গে আমার প্রথম কাজ, প্রথম গানের রেকর্ডিং। গানটি সম্পর্কে সুবীর নন্দী বলেছিলেন, ‘কথাগুলো অসাধারণ।’ এরপর যখন রেকর্ডিং শুরু হবে সুবীর নন্দী আমার কাছে এসে বললেন, ‘মিন্টুদা, সুর হয়েছে?’ আমি বললাম, ‘চলেন আমার সাথে।’ এরপর কন্ট্রোল রুম থেকে আমি গানের একটা লাইন গাই, এরপর সুবীর নন্দী সেই লাইনের গান রেকর্ডে তোলেন। যেহেতু আগেই গানের সুর করি নাই, তাই এই পন্থা অবলম্বন করি আমি। এভাবেই শেষ করি আমরা সেদিন গানের রেকর্ডিং। সুবীর নন্দী একবারে কখনো গান রেকর্ডিং করে তৃপ্তি পেতেন না। অনেকবার টেক নিয়ে গান রেকর্ডিং করতেন তিনি। ‘একটা ছিল সোনার কন্যা’ গানের রেকর্ডিং শেষ করে সুবীর নন্দী বলেছিলেন, ‘প্রথমে গানের সুর সাধারণ লেগেছিল। পরে মনে হলো সুর অনেক জটিল।’ গানটি কিন্তু প্রথমে ‘শ্রাবণ মেঘের দিন’ ছবিতে ব্যবহার করার কথা ছিল না। ছবিতে গানটি শোনার পর শ্রোতারা ব্যাপক পছন্দ করেন। সুবীর নন্দী তখন আমাকে বলেছিলেন, ‘মিন্টুদা, তুমি আমার জীবনের দ্বিতীয় ইনিংস দিলা।’ আসলে সুবীর নন্দী ১৯৯৬ সালে একবার গুরুতর অসুস্থ হয়েছিলেন। ভেবেছিলেন, আর গান গাইতে পারবেন না। পরে ‘একটা ছিল সোনার কন্যা’ এবং ‘ও আমার উড়াল পঙ্খী রে’ গান দুটি তাঁর ক্যারিয়ারের মোড় ঘুরে দেয়। এ দুটি গানই হয়েছিল তখন সুপার হিট।
‘ও আমার উড়াল পঙ্খী রে’
হুমায়ূন আহমেদ এই গানটির সুর আমাকে যখন করতে বলেন, তখনই আমি মনে মনে গায়ক হিসেবে সুবীর নন্দীকে চিন্তা করি। হুমায়ূন আহমেদও আমাকে জিজ্ঞাসা করেন, ‘শিল্পী হিসেবে কাকে নেওয়া যায়?’ তখনই আমি তাঁকে বলি, ‘এটা একটু ফোক ধরনের গান। সুবীর নন্দীর কণ্ঠে ভালো মানাবে।’
এরপর সুবীর নন্দীকে দিয়েই গানটি করানো হয়। সুবীর নন্দী এই গানের রেকর্ডিংয়ের পর বারবার শুনেছেন। আমাকে বারবার বলেছিলেন, ‘গানের এই নোটটা দারুণ হয়েছে, আমাকে মিন্টুদা আরো একবার দেখাও তো।’
সুরকারদের প্রতি শ্রদ্ধা আমি সুবীর নন্দীর মধ্যে যা দেখেছি, এখনকার অনেক শিল্পীর মধ্যে আমি সেটা দেখতে পাই না। টিভি লাইভ কিংবা কনসার্টে সুবীর নন্দী গান গাওয়ার আগে খুব যত্ন করে গীতিকার ও সুরকারের নাম বলতেন। গান রেকর্ডিংয়ের সময় বারবার ভাবতেন, সুরকারের চাওয়া পূর্ণ হচ্ছে কি না। ব্যক্তিগতভাবে আমাকে অনেক শ্রদ্ধা করতেন সুবীর নন্দী। যেকোনো টিভি অনুষ্ঠানে আমি যদি তাঁর সঙ্গে গিটার বাজাতাম, তিনি দর্শকের সঙ্গে আমাকে পরিচয় করিয়ে দিতেন এভাবে, ‘আমাদের সঙ্গে গিটারে আছেন বাংলাদেশের স্বনামধন্য সুরকার মকসুদ জামিল মিন্টু।’
দুই মাস আগে সুবীর নন্দীর সঙ্গে আমার শেষ দেখা হয়। তাঁর মৃত্যু সংগীত ভুবনে অপূরণীয় ক্ষতি।