মঞ্চ আর মায়ানদী নিয়ে মারুফ কবির

Looks like you've blocked notifications!
মারুফ কবির

শেষ হয়ে গেল থিয়েটার সপ্তাহ। রেখে গেল স্মৃতি আর মুহূর্তদের। এবার থিয়েটার সপ্তাহে দ্বিতীয় সন্ধ্যায় 'মায়ানদী' নাটকের উদ্বোধনী মঞ্চায়ন করে থিয়েটার নাটকের দলটি। নাটকটির রচনা ও নির্দেশনা করেছেন মারুফ কবির।

মারুফ কবিরের সঙ্গে আড্ডা জমে উঠেছিল ‘মায়ানদী’ আর থিয়েটার অঙ্গন নিয়ে। তার কিছু অংশ পাঠকের জন্য। আলোকচিত্র ধারণ করেছেন মাহবুব আলম।

‘মায়ানদী’ সৃষ্টির পেছনের কারণটা কী ?

মূলত নাটকটা করার উদ্দেশ্য যেটা ছিল তা হলো, আসলে আমার প্রকৃতির প্রতি একটা ভালোবাসা কাজ করে। প্রকৃতির প্রতি প্রেমকে এ নাটক ধারণ করে। এ দেশ হলো নদীর দেশ। একাত্তরে স্লোগান ছিল আমাদের ‘তোমার আমার ঠিকানা, পদ্মা মেঘনা যমুনা’। দেখুন, নদী কেমনভাবে জড়িয়ে আছে আমাদের মাঝে। কিন্তু এ নদীই হারিয়ে যাচ্ছে। এই যে নদীগুলো আজ নাই হয়ে যাচ্ছে, তার পেছনে অনেক কারণ। এসব ভাবায় আমাকে।

আচ্ছা, বিশ্ব থিয়েটার বিবেচনায় আমরা কোন জায়গায় আছি আজকে? বিশ্ব থিয়েটারের সঙ্গে আমাদের যোগাযোগই বা কতটা আছে?

বৈশ্বিকভাবে কতটা নিজেদের প্রকাশ করতে পারছি, এ ক্ষেত্রে আমাদের ইচ্ছা আছে কি না, তা-ও একটা ব্যাপার। কিন্তু আমাদের নাটকের মান বিশ্ব থিয়েটার বিবেচনায় খুব বেশি পেছনে নয়। আমরা যে সংকট, যে সীমাবদ্ধতা নিয়ে কাজ করি, সে তুলনায় আমরা পিছিয়ে নেই। তবে এখানে ভাষাও একটা ব্যাপার। আমাদের বাংলা ভাষা কিন্তু অনেকেই বুঝবে না। যদিও অনেকে বলে, ভাষা ব্যাপার নয়। আমি সেটা মনে করি না। কারণ, আমার সংলাপ তো নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ।

কিন্তু ধরুন মণিপুরী থিয়েটার মণিপুরের ভাষায় নাটক করছে বা অন্য ভাষার নাটকগুলোও তো আসছে ধীরে ধীরে। সেগুলো কম হলেও দর্শক তো পাচ্ছে?

এটা কিন্তু আরেকটা ব্যাপার। সেখানে আমরা মুভমেন্টের মাধ্যমে সংযোগ স্থাপন করছি, একটা প্রি-কনসিভ আইডিয়া থেকে গ্রহণযোগ্য হচ্ছে হয়তো। আমাদের চেনা নাচ, কোরিওগ্রাফি একটা সংযোগ ঘটায় বটে। তবে আমি এটাকে যথেষ্ট মনে করি না। আমার দর্শন তো আমার ভাষার মাধ্যমেই অধিক প্রকাশ পাচ্ছে, তাই না? এ জন্য বলছি, বাংলা ভাষাভাষী মানুষের সংখ্যা যদি বৃদ্ধি পায় এবং সে মানুষগুলো যদি থিয়েটারের দর্শক হতে আগ্রহী হয়, তবেই বাংলা মঞ্চনাটকের প্রসার বিশ্বব্যাপী সম্ভব।

বাংলাদেশে রেপারেটরি থিয়েটার কি আদতেও আছে বলে মনে করেন? থাকলে পেশাদারি থিয়েটারের ক্ষেত্রে কি এ পদক্ষেপ ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবে?

বাণিজ্যিক দৃষ্টিভঙ্গিতে নেই, তবে গ্রুপ থিয়েটারের এক্সটেনশন হিসেবে বিবেচনা করলে আছে। এবং এটা পেশাদারি থিয়েটার গঠনে ভূমিকা অবশ্যই রাখবে। তবে থিয়েটার কোম্পানি বলে যে জিনিস, তা কিন্তু বাংলাদেশে নেই। আজ যা হয় তা হলো, ২০ জন ছেলেমেয়ে কয়েকটা দল থেকে একত্র হয়ে একটা কাজ করছে। এখন রেপারেটরি থিয়েটার আর থিয়েটার কোম্পানির মধ্যকার পার্থক্যটা বুঝতে হবে। থিয়েটার কোম্পানি থাকার মানে হলো থিয়েটার করে বাঁচা যাবে, জীবিকা নির্বাহ করা যাবে। কিন্তু আজ পেশাদারি থিয়েটার আসবে কী করে, তা বলা খুব জটিল। বাস্তবসম্মত কথা হলো, বর্তমান অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে পেশাদারি থিয়েটারের কথা দর্শকের দর্শনীর বিনিময়ে গড়ে তোলা বেশ কষ্টসাধ্য বিষয়।

শিল্পকলার ভূমিকা কী হতে পারে এখানে?

যতই রেপারেটরি থিয়েটার হোক আর যাই হোক, দর্শকের মননের জায়গায় আঘাত হানতে না পারলে কিছু হওয়া সম্ভব না আজ দাঁড়িয়ে। যদি জি-বাংলা, স্টার প্লাস বেশি আকৃষ্ট করে মানুষকে, তবে মঞ্চনাটকের দর্শক তো কমবেই। মানুষের মনস্তাত্ত্বিক অবস্থার পরিবর্তন ঘটতে হবে।

মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক নাটক মঞ্চস্থ করতে হলে দেখা যাচ্ছে পুরোনো নাটকগুলোই ঘুরেফিরে আসছে। মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক নতুন নাটক নির্মাণ কি কম হচ্ছে? হলে কেন?

মূল কারণ দর্শনগত দিক থেকে মুক্তিযুদ্ধকে বিবেচনা করতে আমরা অক্ষম। কিন্তু বাস্তবতার ভেতরেও একটা বাস্তবতা আছে। কোন দর্শন নিয়ে আমরা যুদ্ধ করেছিলাম, যুদ্ধের ফলে আমাদের মনোজগতে জাতি হিসেবে কী পরিবর্তন ঘটেছে এবং যুদ্ধের ফলে আমরা কী পেয়েছি—এ সবকিছু নিয়ে সে অর্থে কোনো কাজ কিন্তু হয়নি। আবার এটাও সত্যি, এই জাতি দীর্ঘ একটা সময় পর্যন্ত এটা নিয়ে কাজ করতেও পারেনি। আমরা বিশাল ক্যানভাসজুড়ে কাজ করি, কিন্তু মনোজগৎ নিয়ে কাজ করতে আগ্রহী হই না। মুক্তিযুদ্ধের সময় হয়তো কোনো চিত্রকর ছবি আঁকতে পারেননি, কোনো লেখক লিখতে পারেননি, কোনো নাট্যকার নাটক লেখেননি। এসব নিয়ে আমরা কোনো নাটক লিখি না। এ জন্যই মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে সে রকম লেখাও নেই।

ইদানীং আর কী ভাবছেন মঞ্চনাটক নিয়ে?

এতদিন ‘মায়ানদী’ নিয়েই ব্যস্ত ছিলাম, নাটকটি মঞ্চস্থ হলো। দেখা যাক দর্শক কীভাবে গ্রহণ করেন এই প্রযোজনা। তার পর না হয় ভাবব নতুন কিছু নিয়ে।