শুভ জন্মদিন ফরীদি ভাই
১৯৮৮ কিংবা ১৯৮৯ সালের কথা। আমি তখন এলিফ্যান্ট রোডে থাকি। রাত প্রায় আড়াইটার দিকে ঝনঝন করে টেলিফোন বেজে উঠল। অ্যানালগ ফোন। ফোন বেজেই চলেছে। আমি অন্ধকারে হাতড়ে বেডসাইড টেবিল থেকে ফোনের রিসিভার তুলে বলি, হ্যালো। অপর প্রান্ত থেকে একটি উদ্বিগ্ন কণ্ঠ : আরে শোন, এটা কি কাওসারের বাসা? আমাকে কোনো উত্তর দেওয়ার সুযোগ না দিয়ে আবারও ঝড়ের গতিতে প্রশ্ন : আরে আমাদের কাওসার, নাগরিকের কাওসার! কী, বুঝতে পারছ? আরে, তুমি কি কাওসার বলছ?
ততক্ষণে আমার তো ঘুমটুম ভেঙে একাকার!
স্পষ্টতই বুঝতে পারছি অপর প্রান্তে ফরীদি ভাইয়ের কণ্ঠ! তার পরও নিশ্চিন্ত হওয়ার জন্য জিজ্ঞেস করি, ফরীদি ভাই বলছেন? উত্তর : আরে হ্যাঁ, ঠিক ধরেছ; আমি ফরীদি। কাওসার, একটা কাজ করো তো; আগে লাইটটা জ্বালাও!
আমি বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞেস করি, কেন ফরীদি ভাই?
ফরীদি ভাই আছেন তাঁর বাসায়, আর আমি আছি আমার বাসায়, এর মাঝে আমার বাসায় লাইট জ্বালালে উনার কী লাভ বুঝতে না পেরে আবার জিজ্ঞেস করি, আমাকে লাইট জ্বালাতে বলছেন ফরীদি ভাই?
একটু উষ্ণভাবে উনি বলেন : আরে কানে কম শোনো নাকি মিয়া, লাইট জ্বালাও!
একটু ধরুন বলেই আমি রিসিভার রেখে অন্ধকারে উঠে গিয়ে লাইট জ্বালাই। তার পরে এসে রিসিভার তুলে বলি, জি ফরীদি ভাই, লাইট জ্বালাইসি, বলেন।
ফরীদি ভাই : তোমার বেডরুমে দেয়াল ঘড়ি আছে না?
আমি : হ্যাঁ, আছে তো। বিস্ময়ের ঘোর কাটে না আমার!
ফরীদি ভাই : দেখো তো ঘড়িতে কটা বাজে?
আমি : দুইটা পঁয়ত্রিশ মিনিট।
ফরীদি ভাই : আরে, এত রাত হইয়া গেছে!
আমি : মানে?
ফরীদি ভাই : না, মানে আমার আশপাশে কোনো ঘড়ি নাই তো, এ জন্য তোমারে একটু কষ্ট দিলাম সময়টা জানার জন্য। যাও, এবার ঘুমাও গিয়া! ঘুমাও, ভালো কইরা ঘুমাও! আর শোনো, ঘুমানোর আগে লাইটটা অফ করে দিও। বিদ্যুতের অপচয় করাটা ঠিক না!
এবার আমার মেজাজ খারাপ করার পালা।
আমি বলি : ফরীদি ভাই, এসবের মানে কী? রাতদুপুরে ফোন কইরা মানুষের ঘুম ভাঙাইয়া জিগাইতেছেন, কটা বাজে! তার পরে আবার কন, ঘুমাও গিয়া! অহন আমার ঘুম আইব কোত্থেইকা! ঘুমের চৌদ্দগুষ্টি ছুইটা গেছে আমার! আপনি আমার ঘুম ফেরত দিয়া যান!
ফরীদি ভাই বলেন : আরে মিয়া, আমার কাছে কি ঘুমের আড়ত আছে নাকি? এক কাম করো। আমি যেভাবে তোমারে ঘুম ভাঙাইলাম, তুমিও আমাদের নাটকের বন্ধুদের কারো ঘুম ভাঙাইয়া জিজ্ঞেস করো আপনার ঘড়িতে কটা বাজে! কিংবা বলো, এত রাত পর্যন্ত ঘুমান নাই! আহারে, শরীর খারাপ করবে তো; তাড়াতাড়ি শুইয়া পড়েন। হা হা হা...। আরে মিয়া, this is call life, জীবনটারে enjoy করতে শেখো! মরার পরে দীর্ঘদিন ঘুমানোর সুযোগ পাইবা। এখন জীবনের এপিঠ-ওপিঠ দেখে নাও মিয়া!
এর পরে তাঁর সেই খসখসে অট্টহাসি আর থামে না। আমিও আরো কিছুক্ষণ কথা বলে অন্য আর একজনকে ফোন দিয়ে ঘুম ভাঙিয়ে চলি!
এই ছিলেন ফরীদি ভাই!
প্রচণ্ড উদার মনের মানুষ। বয়স নির্বিশেষে চলচ্চিত্র ও নাটকের সব কর্মী ছিলেন তাঁর নির্জলা বন্ধু। জীবনের ‘এপিঠ-ওপিঠ’ enjoy করেছেন ইচ্ছামতো। খুব অল্প সময়ে অভিনয়ের ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে কাঁপিয়ে দিয়ে বিদায় নিয়েছেন ঝট করে। ধুঁকে ধুঁকে নির্যাতিত হননি ফরীদি ভাই। রাজপুত্রের মতো চলে গেলেন সবাইকে শোকের সাগরে ভাসিয়ে।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে মাস্টার্স করা, মুক্তিযোদ্ধা, অসীম সাহসী এ মানুষটির জন্য বুকের বাঁ দিকে খুব ব্যথা হয়। শকুন্তলার সেই তক্ষক, মুনতাসীর ফ্যান্টাসির মিস্টার মুনতাসীর, কীর্তনখোলার ছায়ারঞ্জন, ভাঙ্গনের শব্দ শুনি’র সেরাজ তালুকদার, অযাত্রার সেই স্কুল শিক্ষক কিংবা সংশপ্তকের রমজান—কোনটা ফেলে কোন চরিত্রের কথা বলি! সবকটাতেই তো ‘তিনিই রাজা’!
ফরীদি ভাই, অনেক কষ্ট হয় আপনার জন্য। অনেক ভালোবাসি ফরীদি ভাই আপনাকে। যেখানেই থাকুন, অনেক ভালো থাকুন, সুন্দর আর নির্মল থাকুন। রাতে আমাদের সবার ঘুম ভাঙিয়ে বলুন, আরে মিয়া, this is call life, জীবনটারে enjoy করতে শেখো! মরার পরে দীর্ঘদিন ঘুমানোর সুযোগ পাইবা। এখন জীবনের এপিঠ-ওপিঠ দেখে নাও!
ফরীদি ভাই, শুভ জন্মদিন, ভালো থাকুন।