জন্মদিনে সুচিত্রাস্মরণ

বাঙালির প্রেমাদর্শ উত্তম-সুচিত্রা

Looks like you've blocked notifications!
এক অনুষ্ঠানে সুচিত্রা সেন ও উত্তম কুমার গল্পে মশগুল। ছবি : সংগৃহীত

চল্লিশ, পঞ্চাশ আর ষাটের দশক বাঙালিকে নতুন এক বাস্তবতার সামনে দাঁড় করিয়ে দেয়। দুই বাংলা বিভাজনের সূচনা ও সমাপ্তি ঘটে এ সময়ের মধ্যখানে। মানুষ উদ্বাস্তু হয়ে নতুন অস্তিত্বের অন্বেষণে দিনযাপন শুরু করে। এই ঠিকানা বদলের সময় বাঙালি তাদের প্রেমের কবি রবীন্দ্রনাথকে হারায়। মানবতাবাদী কবি নজরুল বাক হারালেন। দুই বাংলাকে এক করে ধরে রাখার মতো এমন শক্ত সুতো তো তখন আর ছিল না। ঠিক এমনই এক ক্রান্তিকালে—জাতিতে জাতিতে, ধর্মে ধর্মে বিভাজনকালে—দুই বাংলার একটা সেতুযোগ হয়ে এলেন এক নারী আর এক পুরুষ। উত্তম-সুচিত্রা। তাঁদের হাত ধরেই রোমান্টিক সাহিত্যের স্থলে চলে আসে রোমান্টিক শিল্পমাধ্যম—সিনেমা। তাঁদের একজন ছিলেন এপার বাংলার, অন্যজন ওপার বাংলার। সেলুলয়েডের ফিতায় তাঁদের মিলন তো দুই অঞ্চলের মিলনের প্রতীকী বার্তা বয়ে আনে! এ ছাড়া উত্তম-সুচিত্রাকে দুই বাংলার বাঙালির আপন করে নেওয়ার আরো একটি কারণ ছিল। এবং সেটাই মূল কারণ। তাঁরা যুদ্ধ-দাঙ্গা-সংঘাত-বিবাদের মধ্যে প্রেমের বর্ষণ নিয়ে এসেছিলেন। বাঙালি নানা সংঘাত ও সংকটে ‘প্রেম’ শব্দের অর্থ-অনুভূতি ভুলতে বসেছিল। এমনই সময় তাঁরা যেন যুক্তি করে এলেন। আর সহায় হলেন স্বয়ং ঈশ্বর। এ কথা বলছি কারণ, সুচিত্রা সেন প্রথম অভিনয় করেন ১৯৫৩ সালে ‘সাত নম্বর কয়েদী’ ছবিতে। নায়ক ছিলেন সমর রায়। কিন্তু ছবিটি আর আলোর মুখ দেখেনি।

উত্তম কুমার প্রথম ছবি করেন ১৯৪৮ সালে। সেটিও আলোর মুখ দেখেনি। এর পর সুচিত্রার সঙ্গে জুটি বাঁধার আগে যে কটি ছবি করেন, ব্যবসায়িকভাবে মুখ থুবড়ে পড়ে। ১৯৫৩ সালে মুক্তি পায় উত্তম-সুচিত্রার ‘সাড়ে চুয়াত্তর’। এবং বক্স অফিসে বেশ সাড়া জাগায়। তখনই বোঝা যায়, ছলে-বলে উত্তম-সুচিত্রাকে এক করতে কতগুলো কূটকৌশল অবলম্বন করেছিলেন দেবতারা। তাঁদের মনে তখন অন্য কথা ছিল। কী কথা, সেটা আর কারোরই অজানা রইল না। এর পর উত্তম-সুচিত্রা একের পর এক ব্যবসাসফল ছবি উপহার দিতে থাকলেন। অন্যভাবে বলা যায়, দর্শকই অতি উৎসাহের সঙ্গে তাঁদের ছবির আগে ‘ব্যবসাসফল’ তকমাটা সেঁটে দিলেন।

পর্দায় উত্তম-সুচিত্রার প্রেম রসায়ন দেখে বাঙালি নতুন করে ভালোবাসতে শেখে। বাঙালির সামনে বহু রাজনৈতিক আদর্শ ছিলেন। কিন্তু কোনো আদর্শ প্রেম ছিল না, জুটিও ছিল না। তাই উত্তম-সুচিত্রার বায়বীয় প্রেম তাদের সামনে একজন স্বপ্নকন্যা ও অন্যজন স্বপ্নপুরুষের কল্পরূপ এঁকে দেয়। প্রেম বলতে বাঙালি বুঝতে শেখে উত্তম-সুচিত্রাকে। একটু আবেগ, একটু খুনসুটি, একটু চপলতা, খানিক মান-অভিমান, আর একটা মিষ্টি হাসি। সঙ্গে সুচিত্রার গভীর চোখ, মাঝারি গড়নের শরীর—ঠিক আদর্শ শরীর বলতে বাঙালি যেমনটি বোঝে, ঘন কালো চুল, বাঁকা হাসি, মায়া-লাগানো কণ্ঠস্বর; আর উত্তমের সুঠাম দেহ, আত্মবিশ্বাসী চলা, হেয়ারস্টাইল, কণ্ঠস্বর, হাসি—সবকিছু মিলে এ দুজন একত্রে প্রেমলীলায় অতিবাস্তব চরিত্র হয়ে দর্শক মনে উপস্থিত হন। তাঁরা মানুষ, আবার ঠিক মানুষ নন যেন। তাঁদের পূজা করা চলে না, আবার আরাধনা করা চলে। তাঁরা যা পারেন, যেভাবে কথা বলেন, যেভাবে চলেন, যেভাবে রাগ করেন, যেভাবে রাগ ভাঙান—সবকিছুই যেন প্রেমিক পুরুষ বা প্রেমিকা নারীর জন্য অনুকরণীয় হয়ে যায়। যেন তাঁরা দুজনে হাতেকলমে বাঙালি নর-নারীকে প্রেমের সাতসতেরো সম্পর্কে পাঠ দিচ্ছেন।

আমাদের এখানে বরাবর প্রচলিত বিশ্বাস হলো, নায়িকাদের বিয়ে করতে নেই। বিয়ে করলে ক্যারিয়ারে ধস নামে। এই বিশ্বাসকে মিথে পরিণত করেছিলেন সুচিত্রা। বেশ কিছুদিন ভালো করে বিয়ে-থা সন্তান-সংসার এসব করে নিয়ে তিনি ক্যারিয়ার শুরু করেছিলেন। সংসারি বাঙালি নারীদের মনে তিনি নতুনভাবে বীজ বপন করেছিলেন। একইভাবে উত্তমেরও আলাদা একটা সংসার ছিল। বস্তুত উত্তম-সুচিত্রার দুটি সংসার ছিল—একটি পর্দার পেছনে, অন্যটি পর্দার সামনে। পর্দার সামনের সংসারটাই দৃষ্টিগোচর হয়েছে, সেটাই দর্শক উপভোগ করেছেন। তবে যেটা নিয়ে তাঁরা আরো বেশি রোমাঞ্চিত হয়ে পড়েন, সেটা হলো পর্দার আড়ালের ওই উত্তম-সুচিত্রার সম্পর্ক নিয়ে। বাঙালি চিরকালই অন্যের জীবনে আড়ি পাততে পছন্দ করে। উত্তম-সুচিত্রার সম্পর্কের রহস্যময় দিকটি তাই তাদের কাছে এত প্রিয় হয়ে ওঠে। বাস্তবে যে এ দুজন মানুষের মাঝে অন্য রকম সম্পর্ক আছে, সেটা আর তাঁদের কষ্ট করে ধরে নিতে হয় না। উত্তম-সুচিত্রাই নানাভাবে বুঝিয়ে দেন। তবে এ ক্ষেত্রে একটা পরকীয়া সম্পর্কে বাঙালি যেভাবে ছিঃ ছিঃ করে ওঠে, সেটা করেনি; বরং উল্টো উত্তম-সুচিত্রার প্রতি আরো সমব্যথী হয়ে পড়ে। কেউ কেউ স্ত্রী ও সুচিত্রার স্বামীর প্রতি অভিশাপও দেওয়া শুরু করে। অর্থাৎ সবখানেই তাঁদের মিলনটা হোক—দর্শকের সেটাই চাওয়া ছিল।

উত্তমের মৃত্যুর পর সুচিত্রার স্বেচ্ছা নির্বাসন জীবন বাঙালিদের সামনে ভালোবাসার ভিন্ন এক অর্থ এনে দেয়। ভালোবাসা শুধু অর্জনের নয়, ত্যাগেরও। উত্তম-সুচিত্রার সম্পর্কের প্রতি আরো শ্রদ্ধাশীল হয়ে পড়ে দর্শক। শুধু সমসাময়িক দর্শক নয়, এখন পর্যন্ত দুই বাংলার অধিকাংশ নর-নারী তাঁদের স্বপ্নকন্যা বা স্বপ্নপুরুষ বলতে উত্তম-সুচিত্রাকেই বোঝেন।