স্বপ্নের ফেরিওয়ালা

সালমান শাহের স্মৃতি

Looks like you've blocked notifications!

আমি খুব আড্ডাবাজ মানুষ। যখন সিঙ্গেল ছিলাম, তখন তো কোনো রাত দিন ছিল না। যতক্ষণ সম্ভব এফডিসিতেই থাকতাম। তারপর দল বেঁধে রাস্তায়, পার্কে, কোনো বন্ধুর বাড়িতে অথবা গ্রীন রোডে চন্দ্রশীলা নামক মেসে, যেখানে কেটেছে আমার অনেক আনন্দের দীর্ঘ সময়। 

সেদিন আমি সারা দিন ঘুমিয়ে ছিলাম, সম্ভবত আগের রাতে ঘুমাইনি। বিকেল ৫টার দিকে যখন গর্ত থেকে বেরিয়ে বারান্দায় এসে দাঁড়ালাম তখন একজন মেস মেম্বার আমাকে দেখে হতবাক। নোমান ভাই আপনি এখানে? মানে বুঝতে না পেরে জিজ্ঞেস করি, কেন? সে পাল্টা প্রশ্ন করে, আপনি আজ বের হননি? বললাম, না। সে বলে, হায় হায় বলেন কি! আপনার সালমান শাহ মারা গেল আর আপনি কিচ্ছু জানেন না? তখন আমাদের মোবাইল ফোন ছিল না। আমি বললাম, কী বলেন আপনি! গতকাল সন্ধ্যায় মানে রাত  ১১টারও বেশি পর্যন্ত সে এফডিসিতে ছিল। মেস মেম্বার বলে, আজ সকাল ১০টায় সে মারা গেছে, ফাঁসিতে ঝুলে। আজ সারা দিন সমস্ত দেশ তোলপাড় হয়ে যাচ্ছে আর আপনি কিছুই জানেন না? বিশ্বাস অবিশ্বাসের দোলায় দুলতে দুলতে আমি এফডিসি গেলাম। এভাবে দরজা কখনো বন্ধ থাকে না এফডিসির। পকেট গেটে টোকা দেওয়ার পর দারোয়ান উঁকি মেরে বলে, কোথায় যাবেন নোমান ভাই, ভেতরে তো কেউ নেই। আমি বললাম, তবু আমি যাব। আমার ভালো লাগছে না। আমি আস্তে আস্তে ভেতরে ঢুকছি, স্মৃতিগুলো আমাকে ঘিরে ধরছে। 

স্মৃতি- তেমন কোনো স্মৃতি তার সঙ্গে আমার নেই। খুব সামান্য। ছবির নাম ‘কে অপরাধী’। আমি সহকারী পরিচালক। এটাই তাঁর সঙ্গে আমার প্রথম ছবি। এর আগে শুধু শুনতাম, সালমান কে নিয়ে কাজ করা ঝামেলা, সে সময় মত সেটে আসে না, আবার এসে চলে যাওয়ার জন্য তাড়াহুড়া করে ইত্যাদি। কিন্তু সারা জীবনে আমার বেলায় যেন উল্টোটা হয়। গুলশান ১০০ নম্বর বাড়িতে সুটিং হবে। আগের দিনও সালমান কক্সবাজারে। কথা হচ্ছে সে সকালে আমাদের সুটিং করবে। কেউ বিশ্বাস করে না সালমান দুপুরের আগে সেটে আসতে পারবে। তখন আমি সকাল ৬টার মধ্যে সেটে চলে যেতাম। ১০০ নম্বর বাড়ির ড্রইং রুমে ঢুকে দেখি সোফায় একটি ছেলে শুয়ে আছে, আমি ডাক দিলাম, এই কে ঘুমাচ্ছো এখানে, ওঠো, সেট রেডি করতে হবে। ছেলেটি ঘুরে আমার দিকে তাকিয়ে ঘুমে আড়ষ্ট কণ্ঠে বলে, নোমান ভাই আমি। দেখি সালমান শাহ। হাউসের বয়দের মতো করে শুয়ে আছে। আমি বললাম, আপনি কখন আসলেন? সে বলে, আমি সরাসরি এখানে চলে এসেছি, বাসায় যাইনি। ঘণ্টা খানেক আগে পৌঁছেছি।
আমি বললাম, ঠিক আছে আপনি ঘুমান। থ্রি সিটার সোফায় সালমান শাহ ঘুমায় আর আমি পাশে বসে ভাবি একি সালমান না তার ভূত! এ রকম তো কখনো শুনিনি। 

‘কে অপরাধী’ ছবির - কি ছিলে আমার, বলনা তুমি, আছি তো আগেরই মতো, এখনো আমি..... গানের সুটিং সন্ধ্যার পর থেকে। সবার ধারণা, সালমান হয়তো ৮টার দিকে আসবে। কিন্তু সে চলে এলো বিকেল ৪টায়। মেকআপ রুমে সবাই মিলে সে কি আড্ডা। সন্ধ্যায় যখন সুটিং শুরু হলো, তখন ইউনিটের সবার মধ্যে এমন একটা ভাব তৈরি হলো যেন পুঁতির মালা গাঁথার মতো শর্টের মালা গাঁথা হচ্ছে। ভালো শিল্পী, মনে প্রাণে শিল্পী হলে একজন পরিচালক যে কত ধ্যানমগ্ন হয়ে কাজ করতে পারে, তা সালমানকে নিয়ে যারা কাজ করেছে তারাই উপলব্ধি করেছে।

ওয়াকিল আহমেদ সালমানকে নিয়ে দুটো ছবি করবে, কথা ফাইনাল। একটি ‘ভুলো না আমায়’ অপরটি ‘অধিকার চাই’। আমি সহকারী পরিচালক। ‘অধিকার চাই’ ছবিতে সালমান সারাক্ষণ একটা চশমা পরে থাকবে বলে আমি ঠিক করি। পরিচালকের অনুমতি নিয়ে আমি গেলাম সালমানের কাছে। বললাম, হিরো আমি চাই আপনি একটা চশমা পরে থাকবেন। আমি কিছু ফ্রেম নিয়ে আপনার কাছে আসব, আপনি পছন্দ করে দেবেন। সে বলে নোমান ভাই আপনার আমার কাছে আসা লাগবে না, আপনি আপনার চোখে লাগিয়ে দেখবেন কোনটা আপনাকে ভালো লাগে, কোনটা আপনার পছন্দ, সেটাই আমি পরব পুরো ছবিতে। 

চশমা আমি আমার পছন্দমতোই কিনেছি কিন্তু সালমানকে কেমন লাগে তা আর দেখা হলো না... 

আমাদের চলচ্চিত্র ভালো নেই হিরো। 

তুমি ভালো থেকো।