ঈদের চলচ্চিত্রের হালচাল

Looks like you've blocked notifications!

কয়েক বছর ধরে দেশি চলচ্চিত্র খারাপ সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল। প্রযোজকরা লগ্নিকৃত টাকা ফেরত পেতে হিমশিম খাচ্ছিলেন। আগে যেখানে বছরে শতাধিক চলচ্চিত্র মুক্তি পেত, এখন সেটা কমে এসে ত্রিশ থেকে চল্লিশের ঘরে পৌঁছেছে। সেইসঙ্গে পাল্লা দিয়ে সিনেমা হল কমছে। তাই এখন ঈদ উৎসবে চলচ্চিত্র মুক্তি দেওয়ার দিকে ঝুঁকছেন সংশ্লিষ্টরা। কারণ, দুই ঈদে মুক্তি পাওয়া চলচ্চিত্রগুলো বেশ ভালো ব্যবসা করে। তারই ধারাবাহিকতায় এবার ঈদুল আজহায় মুক্তি পেয়েছে তিনটি চলচ্চিত্র। এর মধ্যে রয়েছে ভারত-বাংলাদেশ যৌথ প্রযোজনার বড় বাজেটের চলচ্চিত্র ‘রক্ত’। এটি পরিচালনা করেছেন ওয়াজেদ আলী সুমন। এ ছাড়া শামীম আহমেদ রনির ‘বসগিরি’ ও রাজু চৌধুরীর ‘শুটার’ মুক্তি পেয়েছে। তিনটি চলচ্চিত্রের দুটির নায়ক শাকিব খান। বাকি একটি নারীকেন্দ্রিক চলচ্চিত্র হওয়ায় প্রধান ভূমিকায় অভিনয় করেছেন পরী মণি। 

এই ঈদে বাংলাদেশের চলচ্চিত্র একজোড়া নতুন মুখ পেয়েছে। শবনম বুবলী ও রোশান। শবনম বুবলী অভিনয় করেছেন শাকিব খানের বিপরীতে ‘বসগিরি’ ও ‘শুটার’ চলচ্চিত্রে। রোশান অভিনয় করেছেন ‘রক্ত’ চলচ্চিত্রে পরী মণির বিপরীতে। 

এরই মধ্যে ঈদের সপ্তাহখানেক পেরিয়ে গেছে। ঈদের আমেজ কাটতে শুরু করেছে। এখন প্রশ্ন হলো, ঈদের চলচ্চিত্রগুলো কেমন চলছে? নতুন দুই মুখকে দর্শক কতটুকু গ্রহণ করেছে? প্রশ্ন দুটির উত্তর খুঁজতে গিয়েছিলাম কয়েকটি সিনেমা হলে। সেখানে হল ম্যানেজারসহ সাধারণ দর্শকের কাছে বিভিন্ন বিষয় সম্পর্কে জানার চেষ্টা করেছি। 

খুলনার বেশ পুরোনো একটি সিনেমা হল ‘সোসাইটি’। মৃতপ্রায় সিনেমা হলটি চলে জেলা প্রশাসনের আওতায়। নতুন চলচ্চিত্র খুব একটা মুক্তি না পেলেও এই ঈদে মুক্তি পেয়েছে ‘শুটার’ চলচ্চিত্রটি। দুপুরের শো-তে হাজির হলাম সিনেমা হলে। ঘোলা পর্দা আর অস্পষ্ট সাউন্ডে যখন ছবি আরম্ভ হলো, তখন সর্বসাকল্যে দর্শক ১০ জন। সিনেমা শেষে হলের ম্যানেজার বাবুর সঙ্গে কথা বললাম। জানতে চাইলাম চলচ্চিত্রটির সেল রিপোর্ট সম্পর্কে। তিনি জানালেন, ঈদের দিন কিছু দর্শক হলেও এখন আসছে না কেউ। কথায় কথায় তাঁকে ভারতীয় চলচ্চিত্র আমদানি বিষয়ে প্রশ্ন করলাম। তিনি বিষয়টি সমর্থন করে বললেন, “আসলে বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের খারাপ অবস্থার কারণে এ ধরনের (শুটার) সিনেমা দায়ী। দেখেছেন তো দর্শক নেই। তা ছাড়া আমাদের হল চালাতে যত ছবি প্রয়োজন, তত ছবি পাচ্ছি না। সে জন্য ভারতীয় ছবির দিকে ঝুঁকতে হচ্ছে। সামনে কলকাতার ‘লাভ এক্সপ্রেস’ মুক্তি পাবে। ওখান থেকে কিছু আয় করতে পারব। কারণ, ‘কেলোর কীর্তি’ থেকে আমাদের অনেক আয় হয়েছে।”

দৌলতপুর থেকে ‘শুটার’ দেখতে আসা দর্শক তুহিন চৌধুরীর কাছে চলচ্চিত্রটির বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘সিনেমাটিতে কোনো গল্প নেই। শুধু কয়েকটি দৃশ্য জোড়া লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে।’ নতুন মুখ বুবলী কেমন করেছে—জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘মোটামুটি। নতুন হিসেবে খুব খারাপ না, আবার ভালো না।’

সোসাইটির একটু সামনেই শঙ্খ সিনেমা হল। অনেক বছর ধরেই চলছে হলটি। যৌথ প্রযোজনার চলচ্চিত্র ‘রক্ত’ চলছে। হলের বাইরে পরী মণি আর রোশানের বড় বড় পোস্টার। কিছু দর্শক অদ্ভুত মুগ্ধতা নিয়ে দেখছেন পোস্টার। শো আরম্ভ হওয়ার আগে দর্শকের একজনের কাছে সিনেমাটি দেখতে আসার কারণ জানতে চাই। উত্তরে তিনি বললেন, ‘শুনেছি এটা বড় বাজেটের ছবি। টিভিতে গান দেখেছি। ভালো লেগেছে। তাই দেখতে আসছি।’

শো আরম্ভ হওয়ার পর আমি ঠিক সেই দর্শকটির পাশে বসলাম। উদ্দেশ্য, সিনেমা শেষে আবার তাঁর মতামত নেওয়া। সিনেমা শেষে বের হতেই তাঁর কাছে জানতে চাই, কেমন লাগল? জবাবে তিনি বেশ হতাশা নিয়েই বললেন, ‘যা আশা করেছিলাম, তা পাইনি। আশাহত হয়েছি।’ অন্য একজন নারী দর্শককে একই প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করতেই তিনি তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলে বললেন, ‘খুব ভালো সিনেমা এটি। ভালো লেগেছে। বাংলাদেশে এমন আরো ছবি নির্মাণ হওয়া প্রয়োজন।’

ঈদে মুক্তিপ্রাপ্ত আরেকটি চলচ্চিত্রের নাম ‘বসগিরি’। মুক্তির আগে এটি বেশ আলোচনায় ছিল। কারণ, এতে অভিনয় করেছেন ওপার বাংলার জনপ্রিয় অভিনেতা রজতাভ দত্ত। ঈদের দিন থেকে সিনেমাটি ভালো চললেও সময় গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে দর্শকের আগ্রহ কমতে শুরু করে। প্রথম কয়েক দিন সিনেমা হলগুলোতে দর্শকের লম্বা লাইন লক্ষ করা গেছে। 

আজকাল চলচ্চিত্র নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আলোচনা-সমালোচনা হয়। রিভিউসহ বিভিন্ন বিষয়ে আলোকপাত করা হয়। ঈদে মুক্তি পাওয়া তিনটি ছবি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে চলছে আলোচনা-সমালোচনা। চিত্রনাট্যকার মেজবাহ উদ্দিন সুমন ফেসবুকে লিখেছেন, “একটি ভালো কাহিনীর (যদিও ভালো ছবির আদল) অসাধারণ দুর্বল চিত্রনাট্যের সিনেমা ‘রক্ত’ দেখে আসলাম। সিনেমার ডায়ালগ খুব বাজে।”

চলচ্চিত্র সমালোচক তির্থক আহসান রুবেল লিখেছেন, ‘শুটার দেখা মানে পুরো সময়টার মিসইউজ করা।’ মারুফ মুনজির নামে এক ব্লগার ‘বসগিরি’ সম্পর্কে লিখেছেন, ‘সিনেমার কোনো কাহিনী নেই। এখানে যেভাবে প্রেম-ভালোবাসার রসায়ন দেখানো হয়েছে, বাস্তবে তা কখনোই সম্ভব নয়।’ এর বিপরীতে অনেকে প্রশংসাও করেছেন। সেইসঙ্গে বুবলী ও রোশানকে প্রশংসা করেছেন অনেকেই। 

এ ছাড়া ঈদের চলচ্চিত্র সম্পর্কে জনপ্রিয় পরিচালক মোস্তাফিজুর রহমান মানিকের কাছে জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, “এবার ঈদের সিনেমাগুলো গত ঈদের মতো মানসম্মত ছিল না। তবে ‘রক্ত’ কিছুটা ব্যতিক্রম। ‘রক্ত’র মেকিং ভালো, কিন্তু তিনটি সিনেমার গল্পই দুর্বল।”

নতুন মুখ শবনম বুবলী ও রোশান সম্পর্কেও প্রশ্ন করেছিলাম তাঁকে। দুজনকে নিয়ে তাঁর মন্তব্য এমন, ‘রোশান এই ঈদের সবচেয়ে বড় পাওয়া। সারপ্রাইজ বলতে পারেন। তাঁর অভিনয়ে জড়তা ছিল না। তাঁর ভয়েজও মানানসই। আমি অভিভূত। তাঁকে নিয়ে অনেক আশাবাদী। আর বুবলীকে আরো উন্নতি করতে হবে।’

ঈদের চলচ্চিত্র নিয়ে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি থেকে আরম্ভ করে সাধারণ দর্শকের মধ্যে রয়েছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া। মানুষভেদে মতামতের ভিন্নতা থাকা স্বাভাবিক। এসব কিছুর ঊর্ধ্বে হলো ব্যবসা। দিনশেষে চলচ্চিত্র কেমন ব্যবসা করল, সেটাই আসল। বাংলাদেশে চলচ্চিত্র কেমন ব্যবসা করে, সেটার সঠিক হিসাব জানা যায় না তেমন। কারণ, এখানে বক্স-অফিস নেই। বক্স-অফিস থাকলে সাফল্য-ব্যর্থতার সঠিক পরিসংখ্যান জানা যায়। তবে চলচ্চিত্রশিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে দরকার মানসম্মত চলচ্চিত্র। কারণ, দর্শক ভালো মানের চলচ্চিত্র দেখতে চায়। ভালো মানের চলচ্চিত্র নির্মিত হলে অবশ্যই দর্শক হলে যাবে। তা ছাড়া বাঙালি চলচ্চিত্রপ্রেমী জাতি। চমৎকার কিছু চলচ্চিত্রই পারে আবার বাঙালির চলচ্চিত্র প্রেম জাগিয়ে তুলতে।