শাস্তি নয়, স্বস্তি চান সালমানের গাড়িচাপায় আহতরা

Looks like you've blocked notifications!

বলিউডের অভিনেতা সালমান খানের গাড়িতে চাপা পড়া আহত ব্যক্তিরা শাস্তি নয়, স্বস্তি চান। ২০০২-এর ২৮ সেপ্টেম্বরের রাতের সেই দুর্ঘটনার পর থেকে সংবাদমাধ্যমকে বারবার এই কথাই বলে আসছেন আহত এবং নিহতের পরিবারের লোকজন। ১৩ বছর আগের সেই মামলায় গত বুধবার সালমানকে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড দিয়েছেন মুম্বাইয়ের আদালত। আলোচিত ওই সাজার পর ওই  মানুষগুলো আবার পাদপ্রদীপের আলোয় এসেছেন। ভারতীয় সংবাদমাধ্যম টাইমস অব ইন্ডিয়ার কাছে নতুন করে জানান দিলেন তাঁদের চাওয়া।

দুর্ঘটনার পর জীবনটাই পুরোপুরি বদলে গিয়েছিল তাঁদের। দুর্ঘটনায় প্রাণ যায় আমেরিকান এক্সপ্রেস বেকারির কর্মী নুরুল্লাহ মেহবুব শরিফের। গুরুতর আহত হয়েছিলেন আবদুল্লাহ রউফ শেখ, আবদুল্লাহ, মুহাম্মদ কলিম পাঠান, মান্নু খান, মুসলিম শেখ নামে পাঁচজন। দুর্ঘটনার পর এঁদের সবারই ছবি ও সাক্ষাৎকার পত্রিকায় ছাপা হয়েছে অসংখ্যবার। সাংবাদিকদের ভিড়ে অনেকে পালিয়ে আত্মীয়ের বাড়ি গিয়েও থেকেছেন। কিন্তু তাঁদের ভাগ্যের পরিবর্তন হয়নি এতটুকুও।

দুর্ঘটনার পরই এদের আর্থিক ও মানসিক সাহায্যের দরকার ছিল। কিন্তু হাজার ক্যামেরা আর ‘সালমান ভাইকে’ নিয়ে গসিপের ভিড়ে আবদুল্লাহ, মুসলিম শেখদের জীবনধারণের ন্যূনতম চাহিদার দিকে নজর দেওয়ার সময় ছিল না কারোই।

ভাগ্যের সন্ধানে মুম্বাইয়ে পা রেখেছিল ১২ বছরের কিশোর আবদুল্লাহ রউফ শেখ। শুনেছিল, এ মায়ানগরী উদ্যমীদের খালি হাতে ফেরায় না। কাজ জুটিয়ে নিয়েছিল আমেরিকান এক্সপ্রেস বেকারিতে। সেদিনের দুর্ঘটনায় একটি পা হারিয়েছিল ওই কিশোর। ওই ঘটনায় পা হারানো আরেকজন আবদুল্লাহ। তখন তাঁর বয়স ছিল ২২ বছর।

সালমানের শাস্তির ঘটনা সারা ভারতের জনতাকে ব্যাপক আলোড়িত করেছে। কিন্তু গাড়ির চাকায় পঙ্গু হয়ে যাওয়া এই দুজনকে কিন্তু শাস্তির ঘটনা সেভাবে স্পর্শ করতে পারছে না। যদিও সবচেয়ে বেশি খুশি হওয়া উচিত ছিল তাঁদেরই। বর্তমানে ৩৫ বছর বয়সী আবদুল্লাহ উদাস গলায় টাইমস অব ইন্ডিয়াকে বলছেন, ‘সালমান শাস্তি পেয়েছে ঠিক আছে। কিন্তু আরো ভালো হতো যদি আমরা ক্ষতিপূরণ পেতাম।’

এই ‘আমরা’ হলেন দুর্ঘটনার ক্ষতিগ্রস্তরা। সালমানের শাস্তি পাওয়া না পাওয়া নিয়ে যাঁদের তেমন মাথাব্যথা নেই। তাঁরা চেয়েছিলেন ক্ষতিপূরণ; যা দিয়ে টেনে নিয়ে যাওয়া যাবে তাঁদের অভাবের সংসার। যদিও মুম্বাইয়ের দায়রা আদালত জানিয়েছে, আর কোনো ক্ষতিপূরণ দেওয়ার প্রয়োজন নেই। তাই এই মামলার রায়ে উচ্ছ্বসিত নন তাঁরা। 

দুর্ঘটনায় নিহত নুরুল্লাহ মেহবুব শরিফের স্ত্রী বলেন, ‘আমাদের বলা হয়েছিল ১০ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে। কিন্তু এখনকার দিনে এই টাকায় কী হয়?’ নিহতের স্ত্রী বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমকে বারবার আকুতি জানিয়েছেন, ‘আমার ছেলে একটা চাকরি পেলে সংসারটা বেঁচে যেত।’

একই কথা বলেছেন আহত মুহাম্মদ কলিম পাঠান। উত্তরপ্রদেশের সুলতানপুরের আসরোগা গ্রাম থেকে কাজের সন্ধানে মুম্বাই এসেছিলেন ২২ বছরের কলিম। দুর্ঘটনায় হাতে-পায়ে এবং পিঠে মারাত্মক চোট পান তিনি। এর পর থেকে বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে পারেন না তিনি। তাই কাজ ছেড়ে গ্রামে ফিরে যান।

সালমান খানের শাস্তির দিনে গ্রামের বাড়ির দাওয়ায় বসে কলিম বলেন, ‘সালমানের শাস্তি আমার কিছুই বদলাতে পারবে না। আমরা ক্ষতিপূরণ চেয়েছিলাম, যাতে আমাদের জীবনে কিছুটা স্বস্তি আসে। যদি ক্ষতিপূরণই না পেলাম, তা হলে সালমান শাস্তি পেলেন, না ছাড়া পেলেন, তাতে আমার কিছু যায়-আসে না।’

কলিম আরো বলেন, দুর্ঘটনার পর দেড় লাখ টাকার একটা ক্ষতিপূরণ পেয়েছিলাম। সবই চিকিৎসায় খরচ হয়ে গিয়েছে।

২০০৭ সালে তিন লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ পেয়েছিলেন আবদুল্লাহও। তিনি জানান, যে আইনজীবী তাঁকে ক্ষতিপূরণ পেতে সাহায্য করেছিলেন, তিনিই নিয়েছেন এক লাখ ২০ হাজার টাকা। ৩৬ বছরের আবদুল্লাহর কথায়, ‘এই ১৩ বছরে সাংবাদিকরা কেবল সাক্ষাৎকার নিতেই এসেছেন। কীভাবে আমার পেট চলছে সে ব্যাপারে কেউ খোঁজ নিতে আসেননি। স্ত্রী ও পাঁচ সন্তানের পরিবার কীভাবে যে চালাচ্ছি, তা শুধু আমিই জানি। সালমানের শাস্তিতে আমার পাও ঠিক হবে না, আমার পেটের ভাতও জোগাড় হবে না।’

সেই রাতে আবদুল্লাহ, নুরউল্লাহ ও কলিমের পাশে ফুটপাথে শুয়েছিলেন উত্তরপ্রদেশের বাসিন্দা মান্নু খান, মুসলিম শেখও। ঘড়ির কাঁটা তখন ২টা থেকে ৩টার মাঝামাঝি। পাঁচজনই চাপা পড়েছিলেন। আবদুল্লাহর মনে পড়ে, ‘হঠাৎ একটা প্রচণ্ড আওয়াজ। সঙ্গে সঙ্গে দেখলাম আমরা একটা গাড়ির নিচে। লোকজন চিৎকার করে বলছিল, ‘সল্লু গাড়ি চাপা দিয়েছে।’

পাঁচজনকেই ভর্তি করা হয়েছিল ভাবা হাসপাতালে। সবচেয়ে বেশি আঘাত পেয়েছিলেন নুরুল্লাহ। হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার কিছুক্ষণ পরই মারা যান তিনি। গুরুতর আঘাত পেয়েছিলেন আবদুল্লাহ এবং মুসলিম। মান্নু এবং মুসলিম পরে গ্রামের বাড়িতে ফিরে যান। ছয় মাস পরে মুম্বাইয়ে ফিরে বান্দ্রা স্টেশনের কাছে একটি বেকারিতে কাজ নিয়েছেন আবদুল্লাহ। কিন্তু টানা কাজ করতে পারেন না। কিছুদিন পর পর অসুস্থ হয়ে যান। তাই ছুটি নিতে হয়।

এত কিছুর পরও সালমানের ওপর রাগ নেই আবদুল্লাহর। প্রতিবেদককে হাসিমুখে বলেন, ‘এ মাসেও হলে গিয়ে ভাইয়ের (সালমানের) ছবি দেখে এসেছি।’