মঞ্চ

ভালোমন্দে সমকালীন পাঠ ‘এন্তারনেট’

Looks like you've blocked notifications!

বর্তমান সময়ে এ দেশ ক্রান্তিকালের মধ্য দিয়ে অতিক্রম করছে, এ কথার সঙ্গে একমত হয়তো অনেকেই হবেন। স্বাভাবিকভাবেই রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ও এর বাইরে পড়ে না। আজ প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ নানা বাধানিষেধে আষ্টেপৃষ্ঠে বাধা শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা।

ক্যাম্পাসের সাংস্কৃতিক অঙ্গন যে এর প্রভাবমুক্ত তা-ও হয়তো জোর দিয়ে বলা যাবে না। তাদেরও মোকাবিলা করতে হয় নানা প্রতিবন্ধকতা। নানা নাম ধারণ করে ক্যাম্পাসে অসংখ্য সাংস্কৃতিক সংগঠন থাকলেও তাদের কার্যক্রম খুব একটা চোখে পড়ে না। তাই অল্পবিস্তর যে কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয়, তাতেই সাধারণ শিক্ষার্থীরা হুমড়ি খেয়ে পড়ে। শ্বাসরুদ্ধকর এ রকম পরিস্থিতিতে একটু বিনোদন, মনের খোরাক মেটানোর জন্যই হয়তো তাদের এ ছুটে আসা। তাই হয়তো সম্প্রতি নাট্যজন মলয় ভৌমিকের নির্দেশনায় অনুশীলন নাট্যদলের ৬০তম প্রযোজনা ‘এন্তারনেট’ মঞ্চনাটকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের মিলনায়তনে মঞ্চায়ন হলে তা হাউসফুল হয়।

‘এন্তারনেট’ দেখতে আসা মানুষের আগমন শুধু যে এসব কারণে তা হয়তো নয়, মলয় ভৌমিকের নির্দেশনার প্রতিও রয়েছে দর্শকের দারুণ আগ্রহ। সেই আগ্রহের তৃষ্ণা ‘এন্তারনেট’ কতটা মেটাতে পেরেছে, তা হয়তো দর্শকই ভালো বলতে পারবে।

যেসব কারণে দেশ বিভীষিকাপূর্ণ হয়ে উঠছে, তার কিছু কারণকে ধারণ করেই মঞ্চনাটক ‘এন্তারনেট’। বিষয়টি মলয় ভৌমিকের ভাষায় অনেকটা এ রকম, ‘বৈশ্বিক নানা অভিঘাতী আয়োজন সময় ও চলমান জীবনের ওপর নিরন্তর ক্রিয়াশীল। এর সঙ্গে যুক্ত হয় স্থানীয় সব স্বার্থ-উপাদান। এই নিরিখে বিচার করলে বর্তমান গভীর সংকটের তলার দিককার এক ধরনের চিত্র মেলে। সাধারণ একটা পরিবারের সদস্যদের, বিশেষ করে যুব-মানসের ওপর বর্তমান রাষ্ট্র-রাজনীতি, শিক্ষা-সংস্কৃতি ও সামাজিক-পারিবারিক ব্যবস্থা, আধুনিক যোগাযোগ প্রযুক্তি এবং দেশি-বিদেশি নানা স্বার্থবাদী কার্মকাণ্ড কীভাবে অভিঘাত ও বৈষম্য সৃষ্টি করতে পারে, তার কিছু নমুনা উঠে এসেছে এন্তারনেট-এর ওই সব খণ্ডচিত্রে। স্বীকার করতে দ্বিধা নেই, এন্তারনেট-এ শিল্পের দায়েরের চেয়ে সময়ের দাবির কথাই নাট্যকার ও নির্মাতার মাথায় কাজ করেছে বেশি।’

‘এন্তারনেট’-এ দেখা যায়, বড়মার বয়স অনেক হয়েছে। এই দীর্ঘ জীবনে অনেক কিছুই তার দেখা। জীবন নিয়ে বোঝাপড়াও একেবারে মন্দ নয়। কিন্তু বর্তমান সময়ের ছেলেমেয়েদের ভার্চুয়াল জগতে মজে থাকা, সেসবে প্রভাবিত হয়ে বড্ড বাড়াবাড়ি বড়মাকে বিরক্ত করে। এ নিয়ে তার মনে তাই ক্ষোভেরও অন্ত নেই। হঠাৎ ফুলির সঙ্গে দেখা হয়ে গেলে বড়মা তার ওপর ক্ষোভ ঝারতে শুরু করেন। ফুলির স্বামী-সন্তান নেই। ভাইয়ের সংসারই তার সংসার। তার প্রতি বড়মার ক্ষোভের কারণ, ফুলির ভাতিজাও ওই ভার্চুয়াল দুষ্টু ছেলের একজন। ফুলিও কম নয়। ছেলেমেয়েরা এ বয়সে একটু দুষ্টুমি, হুড়োহুড়ি না করলে কবে করবে, এমন প্রশ্ন ছুড়ে দেন বড়মাকে। শুরু হয় তাদের মধ্যে তর্কের স্বরে কথোপকথন। এর সারমর্ম এ রকম দাঁড়ায়, বর্তমান ছেলেমেয়ে প্রযুক্তির বদৌলতে হয়তো অনেক এগিয়ে। কিন্তু এরাই আবার বলতে পারে না কোন মাসে কী ফসল হয়। প্রযুক্তিতে বুঁদ হয়ে থাকলেও নিজের দেশ-মাটি-মানুষকে জানা থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। হয়ে পড়ছে ছিন্নমূল।

এ জন্য ফুলিকে বলতে হয়, এ সময়কার শিশুরা কেনই বা এমন হবে না। এখন কোন বাড়িতে একটা ভাঙা হারমোনিয়ামও পাওয়া যায় না। গান হয় না। সংস্কৃতি চর্চা হয় না। বড়মাকে উদ্দেশ করে ফুলি আরো বলে, তোমার বই পড়া দেখে আমরা বই পড়তে শিখেছি। জ্ঞানার্জনের আনন্দে মেতে উঠেছি। কিন্তু বর্তমান সময়ের ছেলেমেয়েরা স্কুল-কলেজে কী যে শেখে, তা ফুলির মাথায় ধরে না।

তবে ফুলির ভাইয়ের বড় ছেলে মহান শিক্ষায় শিক্ষিত হচ্ছে। এই মহান শিক্ষা নিতে গিয়ে মাস ছয়েক ধরে সে বাড়ির কোনো খোঁজখবর নেয় না। কোথায় আছে, কেমন আছে—সেসবের কোনো খোঁজ নেই। ফুলি এমন ‘মহান’ শিক্ষারও কোনো অর্থ খুঁজে পায় না। এই মহান শিক্ষায় শিক্ষিত করতে যে লোকটা ভাইয়ের বড় ছেলেকে নিয়ে গেছে, তিনি নিজেকে সরবরাহকারী হিসেবে দাবি করেন। যার আচরণ অনেকটা যন্ত্রের মতো। দেখতে মানুষ হলেও ঠিক যেন মানুষ নয় এমন। তিনি পুলিশের সঙ্গে গোলাগুলি করে মানুষ মারা যাবে এমন মানুষ যেমন, তেমনই কাউকে গুলি করে হত্যা করতে হবে সেই মানুষও সরবরাহ করেন। মানুষ মেরে বেহেশতে যাবে এমন মানুষও। ফুলির ভাইয়ের ছেলে যে এমন ‘মহান’ শিক্ষায় শিক্ষিত হতে গেছে, তা তার পাঠানো চিঠির মাধ্যমে জানা যায়। পরে ইন্টারনেটের মাধ্যমে সংবাদ পায় ‘মহান’ শিক্ষায় শিক্ষিত বড় ছেলে জঙ্গি হামলা চালিয়ে মানুষ হত্যা করেছে। ‘এন্তারনেটে’ তার ছবিও এসেছে।

‘এন্তারনেট’-এ মধ্যস্বত্বভোগী ওই সরবরাহকারীর সন্ধান মিললেও মেলে না তাকে কে বা কারা ব্যবহার করছে, কীভাবে করছে। তাই ‘জঙ্গি’ সৃষ্টি, মানুষ হত্যা, মদ-গাঁজার ব্যবসা থেকে শুরু করে সব ধরনের অপকর্মের দায় গিয়ে পড়ে অনেকটাই এই মধ্যস্বত্বভোগীর ঘাড়ে। ফলে এই মধ্যস্বত্বভোগীদের নিয়ন্ত্রণকারী বা মূল হোতারা রয়ে যায় বরাবরের মতোই আড়ালেই। তাই এই সমাজ-ধর্ম-রাষ্ট্র, আধিপত্যবাদীরা দেশের বিদ্যমান সহিংসতা নিয়ে যে ঘোলাটে পরিবেশ তৈরি করেছে, তার উন্মোচন করতে পারে না এই ‘এন্তারনেট’ও।

নাটকে দেখা যায়, পুলিশ কর্মকর্তা ‘বিপজ্জনক’ বইয়ের সন্ধান করছেন। আর তাতে সহযোগিতা করছে এক সহকারী। বইগুলোর মধ্যে একটি বই সহযোগী পুলিশের পছন্দ হলে তিনি সেটা নিজের কাছে রেখে দিতে চান। কিন্তু ওই বইটা স্যারকে দেখাতে রাজি নয় সহযোগী। আর এতেই ওই পুলিশ কর্মকর্তা ধরে নেন ‘আসল’ বইটা তিনি পেয়ে গেছেন। ফোন দেন ওপরমহলে, ‘বিপজ্জনক’ বইটা পাওয়া গেছে এবং সেটা তিনিই উদ্ধার করেছেন। পরে ‘ওপরওয়ালা’ বইয়ের নাম জানতে চান এবং নাম শুনে বুঝতে পারেন এটি একটি প্রেমের বই। ‘ওপরওয়ালা’ ধমক দেন ওই পুলিশ কর্মকর্তাকে। এর মধ্য দিয়ে নির্দেশক তুলে ধরেন, এ দেশের পুলিশ প্রশাসন যে অনেক ক্ষেত্রে শুধু ওপরমহলের নির্দেশই বিবেক-বোধহীনভাবে পালন করে সেই বিষয়টি। জনগণের যে টাকায় তাদের বেতন হয়, দায়িত্ব পালনের সময় সেই মানুষগুলোর কথা মনে রাখে না পুলিশ। পালন করে শুধু ওপরের নির্দেশ। দেশের বর্তমান সংকটময় পরিস্থিতির জন্যও হয়তো এই বিবেক-বোধ ও দায়িত্বহীনভাবে ক্ষমতার লেজুড়ভিত্তিই অনেকাংশে দায়ী।

‘বিপজ্জনক’ বইয়ের সন্ধান করতে ওই পুলিশ কর্মকর্তা বদ্ধপরিকর। তল্লাশি চালান ফুলির ভাইয়ের বাসায়। তার বাড়িতে লাল বই রয়েছে এমন তথ্য রয়েছে পুলিশ কর্মকর্তার কাছে। ফুলির ভাই বলেন, তিনি কৃষক। এখন আর লাল বই পড়েন না। আগে পড়তেন। বইগুলো পড়ার পর যে আদর্শ জীবনের শুরুতে তার মধ্যে গড়ে উঠেছিল, তা তিনি এখনো ধারণ করেন। সে জন্যই এখনো তিনি ধনী-গরিব, নারী-পুরুষ, সাদা-কালো নির্বিশেষে সবাইকে মানুষ হিসেবে মূল্যায়ন করতে পারেন, করেন। সমতায় বিশ্বাস করেন। তখন ওই পুলিশ কর্মকর্তা জিজ্ঞাসা করেন, তাহলে লাল বইয়ের দোষ কোথায়? তার পরও তিনি বাড়িতে লাল বইয়ের সন্ধান করেন। এভাবে নাট্যকার মলয় ভৌমিক পুলিশের দিনতা তুলে ধরেন ‘এন্তারনেট’-এ।

নাটকের সামগ্রিক বিষয় নিয়ে কথা হচ্ছিল এক দর্শকের সঙ্গে। তার মতে, সামগ্রিক দিক থেকে দেখলে অভিনয় খুব একটা প্রাণবন্ত হয়নি। নির্দেশক নাটকে যা ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করেছেন, তা নাটকের সঙ্গে জড়িত যারা, তাদের পক্ষে বোঝা সম্ভব হলেও সাধারণের পক্ষে তা একটু কষ্টকরই বটে। মলয় ভৌমিকের মতো নাট্যকারের কাছে এর চেয়ে আরো ভালো নির্দেশনা প্রত্যাশা করেছিলেন বলেও ওই দর্শক জানান।

‘এন্তারনেট’-এর প্রথম প্রদর্শনী ছিল এটি। অভিনেতাদের অধিকাংশই নতুন। তাই অভিনয়ে যে কিছু দুর্বলতা ছিল, তা সংশ্লিষ্টদেরই কেউ কেউ স্বীকার করেছেন। এরপর নাটকটির আরো বেশ কয়েকটি প্রদর্শনী হবে। চর্চার মধ্য দিয়ে দুর্বল দিকগুলো কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা থাকবে বলেও জানান তাঁরা। সঙ্গে নানা সংযোজন-বিয়োজন তো থাকছেই।

এতে অভিনয় করেছেন হাসি চক্রবর্তী, তানজিদা নাহার জুঁই, সাজ্জাদ হোসেন, খাইরুল ইসলাম, তানভির অর্ক, লিমন বিশ্বাস, রায়হান উদ্দিন, শাহরিয়ার তারেক, জামান শরিফ, মইনুল ইসলাম, অর্জুন দাস, হৃদয় সাহা, মো. স্বাধীন খান, নাজমুল হাসান, সীমান্ত দাস, মো. আরিফুল ইসলাম। নাটকের নেপথ্যে কণ্ঠ দিয়েছেন মলয় ভৌমিক। নৃত্য নির্দেশনায় ল্যাডলী মোহন মৈত্র, মঞ্চসজ্জায় কনক কুমার পাঠক ও মনির উদ্দিন টভেল, সংগীতে শৌভিক রায় ও শিলাদিত্য বৈরাগী, আলোকসজ্জায় ছিলেন আল জাবির।