নজরুল পাশ্চাত্য থেকে সুর গ্রহণ করেছেন: খায়রুল আনাম শাকিল
খায়রুল আনাম শাকিল। বাংলাদেশে নজরুলসংগীতের একজন অনন্য প্রতিভা। নজরুলের অনবদ্য সৃষ্ট সংগীতই এই শিল্পীকে এনে দিয়েছে সেই সুনাম। লন্ডনে প্রকৌশলবিদ্যায় পড়াশোনা করলেও ছোট থেকেই হতে চেয়েছিলেন একজন সংগীতশিল্পী। নজরুলের গান চর্চা এবং তা প্রসারে রয়েছে শিল্পীর অপরিসীম সাধনা, মমতা ও ভালোবাসা। কথা হলো শিল্পীর না-জানা অনেক বিষয় নিয়ে। সে সঙ্গে সমসাময়িক অনেক প্রসঙ্গও স্থান পেল এই সাক্ষাৎকারে। যাঁরা নজরুলের গান ভালোবাসেন, ভালোবাসেন খায়রুল আনাম শাকিলের কণ্ঠে গান, তাঁদের জন্য রইল অনেক অজানা তথ্য।
প্রশ্ন : প্রথমেই জানতে চাইব একজন খায়রুল আনাম শাকিল হয়ে ওঠার পেছনের ইতিহাস সম্পর্কে?
উত্তর : আসলে পারিবারিকভাবেই তো আমাদের সংগীত চর্চাটা সব সময়ই ছিল। আমার বাবা একজন ব্যবসায়ী। যুবক বয়সে তিনি একজন সংস্কৃতিকর্মী ছিলেন। বর্তমানে যেটি শিল্পকলা একাডেমি, সে সময় একে বলত আর্ট কাউন্সিল। তৎকালীন আর্ট কাউন্সিলের তিনি অনারারি সেক্রেটারি ছিলেন। সে সময় বড় বড় অনুষ্ঠানের আয়োজন তিনি করেছিলেন। চলচ্চিত্রের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ‘জয় বাংলা’, ‘সুতরাং’, ‘কাগজের নৌকা’—এই ছবিগুলোর উনি প্রযোজক। পরবর্তী সময়ে তিনি রাজনীতিতে যোগ দেন। গোপালগঞ্জ থেকে উনি পাকিস্তান ন্যাশনাল এসেম্বলির মেম্বার হয়ে আসেন, অর্থাৎ আওয়ামী লীগ থেকে সেই আমলে সত্তর দশকে।
আমার মা-বাবা দুজনই ফরিদপুর সদরের। আর আমাদের জন্ম, বড় হওয়া সবটাই ঢাকায়। আমার জন্ম ১৯৫৮ সালে। ১৬ থেকে ২৬ বছর পর্যন্ত আমি বিলেতে বড় হয়েছি। সেখানে স্কুল-কলেজ, ইঞ্জিনিয়ারিং পড়া সবটাই আমার বাইরেই হয়েছে। কিন্তু ছায়ানটের সঙ্গে সম্পৃক্ততার কারণে দেশে ফিরে আসি। আমার মা-খালারা সেভাবে প্রত্যেকেই গান করেন। দুজন, না আমি বলব তিনজন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা লাভ করেছিলেন। আমার মা সম্পূর্ণটা না করলেও বেশ কিছুটা সময় সে সময়কার পঞ্চাশ দশকের মাঝামাঝি সময়ে বুলবুল ললিতকলা একাডেমিতে ছিলেন। এবং পরবর্তী সময়ে ছায়ানট প্রতিষ্ঠা হওয়ার পর তিনি কিছুদিন ছায়ানটেও শিখেছিলেন। এভাবে আমাদের পরিবারে সংগীত চর্চা শুরু হয়। বাড়িতে আমার মা তখনকার বিখ্যাত ওস্তাদ মুন্সী রইস উদ্দীন খানসাহেবের কাছে গান শিখছিলেন। আমরা ছোটবেলা থেকেই একটা সংগীতের পরিবেশে বড় হয়েছি। আমার খালা তাহমিনা রব্বানী আমাকে প্রায়ই একটা-দুটো করে গান শিখিয়ে দিতেন। আমি নজরুল, রবীন্দ্র, ফোক ইত্যাদি গান শিখতাম খালার কাছে, যার কারণে আমার সংগীতের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা গ্রহণ করার আগেই আমি এক ধরনের শিশু প্রতিযোগিতায় নাম দিই। এ প্রতিযোগিতায় আমি একটি রবীন্দ্রসংগীত গাইলাম। এবং কেমন করে যেন আমি প্রতিযোগিতায় প্রথম পুরস্কার লাভ করি। তাল-ছন্দের একটা সেন্স আমার মধ্যে ন্যাচারালি এবং স্বাভাবিকভাবেই ঢুকে গিয়েছিল।
যেহেতু আমার মা গান করতেন, খালারা গান করতেন, সেভাবে বাড়িতে তবলার ছন্দ, তাল শুনেছি ছোটবেলা থেকেই। তখন কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছাড়াই মোটামুটি তালে গাইতে পারতাম। আর সুরের ব্যাপারটা তো ছিল জন্মগতভাবে মায়ের পেটে থাকতেই। যা হোক, সেই পুরস্কারটা পাওয়ার পর আমার এবং পরিবারের কাছে মনে হলো যে না, বোধ হয় প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাটা নেওয়া যায় এখন। গান যখন করতেই পারি একটু-আধটু, তখন ছায়ানটে ভর্তি হলাম। প্রথম ভর্তি হয়েছিলাম আমার যতটুকু মনে হয় ১৯৬৯ সালে, বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার আগে। এর পর কিছুকাল মুক্তিসংগ্রাম—দেশের এসব কারণে গান গাওয়াটা বন্ধ হয়ে যায়। তার পর আবার একটা সময়ে আমি ছায়ানটে ভর্তি হলাম। সেখান থেকে সংগীত শিক্ষা লাভ করলাম। পাশাপাশি আমি বাড়িতে সংগীতজ্ঞ পত নারায়ণ চন্দ্র বসাকের কাছে শাস্ত্রীয় সংগীতে তালিম নেওয়া শুরু করলাম। কিন্তু সবচেয়ে জরুরি যে কথাটি বলা সেটি হলো, আমার মামা মাহমুদুর রহমান বেণু, তিনিই আসলে আমাদের সেই ছোটবেলা থেকে গুরু। গানের ভালো-মন্দের সব বিষয় তিনিই আমাদের দেখিয়ে দিতেন। ভালো গান শোনা, ভালো মানুষের রচনা এবং সময়োচিত গান শোনা, শাস্ত্রীয় সংগীত, ঠুমরি, দাদরা এর সবই। আমার প্রথম জীবনের সংগীত-গুরু ছিলেন আমার মামা। মামা ১৯৭৩ সালে প্রবাসে চলে গেলেন উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করার লক্ষ্যে। এবং তার পর বছর দুই-এক পরে আমি নিজেও গেলাম পড়াশোনা করার জন্য। সেখানে আমি দীর্ঘদিন থাকার পরও সংগীত চর্চাটা চালিয়ে যেতে পেরেছি। পড়াশোনা শেষ করে আমি দেশে এসে কিছুদিন নারায়ণ বাবুর কাছেই গান শিখেছি। কিন্তু হঠাৎ করেই উনি আমাদের ছেড়ে চলে যান। উনার প্রয়াণের পর আমার কিছুদিন গান শেখা বন্ধ ছিল। তার পর আবার আমি ভারতের প্রখ্যাত ওস্তাদ সারিঙ্গী নেওয়াজ ও ওস্তাদ মোহাম্মদ সগীর উদ্দীন খানসাহেবের কাছে শাস্ত্রীয় সংগীত শিখি, প্রায় সাত-আট বছর হবে। আর নজরুলের গান মূলত মামার কাছে এবং ছায়ানটে শিক্ষা গ্রহণ করি। ছায়ানটে যেসব শিক্ষক ছিলেন, যেমন—সদ্য প্রয়াত সোহরাব হোসেন, শেখ লুৎফর রহমান, অঞ্জলি রায়—উনাদের কাছে নজরুলের গান শিখেছি। পাশাপাশি যেটা আগেই বলেছি নারায়ণ চন্দ্রের কাছে। এভাবেই আমি ধীরে ধীরে গান শিখেছি। খুব অল্প বয়সে আমি টেলিভিশন ও রেডিওতে তালিকাভুক্ত হয়েছিলাম, ১৬/১৭ বছর বয়সে। যার কারণে যখনই আমি প্রবাস থেকে ছুটিতে দেশে ফিরতাম, টেলিভিশন ও রেডিওতে আমি অনুষ্ঠান করতাম। তার পর একটা সময় আমি প্রবাস থেকে দেশে ফিরে এলাম। এর পর ছায়ানটে শিক্ষকতা, এর বাইরে বিভিন্ন রকম অনুষ্ঠানে গান করা—এভাবেই নিজেকে তৈরি করছিলাম এবং এখন পর্যন্ত নিজেকে তৈরি করছি।
প্রশ্ন : এই যে এত ছোট বয়সে একটা পুরস্কার পেলেন, যে পুরস্কার আপনার প্রাতিষ্ঠানিক সংগীত শিক্ষার পথটা খুলে দিল। এখন যদি বলা হয়, সেই পুরস্কার কতটা গুরুত্ব রাখে আপনার জীবনে একজন সংগীতশিল্পী হওয়ার পেছনে?
উত্তর : আসলে ওই বয়সে পুরস্কার পাওয়াটাকে অর্জন হিসেবে কেউ দেখে না। ওই বয়সটার কথা বলছি, ১০/১১ বছর তখন আমার বয়স। সে সময় আসলে পুরস্কার পাওয়াটা সাধারণ আনন্দের একটা বিষয়। মানুষকে বলে বেড়ানোর একটা বিষয়, আমি প্রথম হয়েছি, পুরস্কার পেয়েছি। কিন্তু সে সঙ্গে আমার পরিবারও যে খুব আনন্দ পেয়েছে। সে আনন্দটা তারা সবাই একটু ভিন্নভাবে প্রকাশ করল যে তুমি খুব ভালো করেছ, ভালো হয়েছে, এখন খুব ভালো করে শিখতে হবে। সেই সময়টায় আমাকে একটা ধারণা দেওয়া হলো যে তোমার সংগীত শিক্ষাজীবন কেবল শুরু হলো। যেহেতু পুরস্কার পেয়েছ, এটা তোমার জন্য একটা অর্জন, গুণীজনরা তোমাকে বলে দিল যে তোমার দ্বারা এক ধরনের সম্ভাবনা আছে। পরবর্তীকালে চর্চার মাধ্যমে নিজেকে তৈরির মধ্য দিয়েই কিন্তু সেটা প্রকাশ করার চেষ্টা করে যাচ্ছি। এখনো শেখার অনেক বাকি বলে মনে করি। তার পরও আমি বলব, আমি খুবই ভাগ্যবান যে দর্শক-শ্রোতারা কেউ কেউ আমার গান পছন্দ করেন। সেটাই আমাকে প্রেরণা দেয়। এবং সেটাই আমাকে চালিয়ে যেতে সহায়তা করে। সে সময় সেই পুরস্কার না পেলে সংগীত শিক্ষার বিষয়টি হয়তো অন্যভাবে আসত, তবে পুরস্কারটা আমার প্রাতিষ্ঠানিক সংগীত শিক্ষার দ্বারটা উন্মোচন করে দিয়েছিল।
প্রশ্ন : শিল্পী হয়ে উঠতে পারিবারিকভাবে কার প্রভাব প্রধানত বেশি ছিল?
উত্তর : আমার মামা মাহমুদুর রহমান বেণুর প্রভাবটা বেশি ছিল। আমি মামাকে অনুকরণ করতাম। একটা পর্যায়ে এসে আমার ছায়ানটের শ্রদ্ধেয় শিক্ষক সোহরাব ভাই একদিন আমাকে বললেন, ‘শোনো, তুমি তো বেণুর গান একেবারে হুবহু অনুকরণ করো, মনে হয় যেন বেণুই গাইছে। তো, এটা ঠিক আছে; কিন্তু তুমি কাউকে অনুসরণ করো, তবে অনুকরণ করো না। তাহলে কিন্তু তুমি নিজে শিল্পী হয়ে প্রতিষ্ঠা লাভ করতে পারবে না কখনো।’ সেই কথাটি আমার সব সময় নিজেকে মনে করিয়ে দেয়, আমার নিজস্ব একটা কিছু নিজেকে তৈরি করতে হবে। তাদের মতো আমার নিজের একটা জায়গা তৈরি করতে হবে। আমার মামা সে সময় অনেক শাস্ত্রীয় সংগীত শুনতেন। ওস্তাদ বারে গোলাম আলী খানসাহেব, বাংলা গানের জ্ঞানেন্দ্র গোস্বামী, আঙ্গুর বালা, ইন্দু বালা, কমলা ঝুলিয়া মানে পুরাতনী শিল্পীদের গান শোনার একটা চল ছিল আমাদের বাড়িতে। যার কারণে আমি বলব, এই কথাটি খুব স্বাভাবিক নয় যে আমি ওই বয়সে জ্ঞানেন্দ্র গোস্বামীর গান শুনব। ওই বয়সে কিন্তু আমাদের বয়সী ছেলেরা এ ধরনের গান শোনে না। কিন্তু কোনো না কোনোভাবে আমি তাঁর গানের মধ্য দিয়ে এমন এক সুরের সন্ধান পেয়েছিলাম যে আমার মনে হয়েছিল, তিনি একজন অসাধারণ শিল্পী। ওস্তাদ বারে গোলাম আলী খানসাহেবের সুর লাগানোর যে ঢং, সেটি আমাকে ভীষণভাবে নাড়া দিয়েছিল সেই ছেলেবেলায়। আমি উনাদের বিভিন্ন রেকর্ড বাজিয়ে সঙ্গে সঙ্গে গাওয়ার চেষ্টা করতাম এবং কঠিন কঠিন অলংকারগুলো কণ্ঠে ধারণ করার চেষ্টা করতাম। ধীরে ধীরে হয়তো সেটা আমাকে নানা সময় সাহায্য করেছে। পরবর্তীকালে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা এবং বিভিন্ন ওস্তাদের কাছ থেকে শিক্ষা গ্রহণে এটি আমাকে অনেকখানি সাহায্য করেছে।
প্রশ্ন : আমরা জানি, আপনি ছায়ানটের একজন মুখপাত্র। ছায়ানটের সঙ্গে এই সম্পৃক্ততা কীভাবে?
উত্তর : আসলে আবার আমার মামার কথাই বলতে হয়। আমার মা যখন ছায়ানটে গান শিখতে শুরু করেন, তখন আমার মামাকে ছায়ানটে সঙ্গে নিয়ে যেতেন। এখন যেমন স্বাধীনভাবে চলাফেরা করা যায়, তখন কিন্তু সেটা ছিল না। সঙ্গে কাউকে নিয়ে যেতে হবে। আমার মা মামাকে সঙ্গে নিয়ে যেতেন, তিনি বাইরে বসে থাকতেন। একটা সময় মামা ভাবলেন, আমিও তো গান শিখতে ভর্তি হয়ে যেতে পারি। উনি ছায়ানটে গান শেখা শুরু করলেন, পাস করলেন এবং পরবর্তী সময়ে সেখানেই শিক্ষকতা শুরু করেন। তখন তিনি তাঁর পরিবারের সব ছেলেমেয়েকে পারুক আর না পারুক, ছায়ানটে ভর্তি করে দেওয়ার উদ্যোগ নিলেন। এভাবেই কিন্তু ছায়ানটে আমার ভর্তি হওয়া। পরবর্তী সময়ে এভাবেই ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে যাই। সে সময় আমাদের ছায়ানটের শ্রদ্ধেয় ওয়াহিদুল হক সাহেব, সন্জীদা আপা, জাহিদুল রহিম এবং যাঁদের কথা আগেই বলেছি, আরো অনেকেই ছিলেন। সে সঙ্গে আজাদ রহমান সাহেব। অনেকেই জানেন না, আজাদ রহমান সাহেব রবীন্দ্রভারতী থেকে প্রথম স্থান পাওয়া একজন শাস্ত্রীয় সংগীতশিল্পী ওই সময়ের। আমার সরাসরি না হলেও আমার মামার গুরু হলেন উনি। মামা উনার কাছ থেকে যা যা শিখেছিলেন বা যে দর্শনটি উনি উপলব্ধি করেছিলেন, তা আমাদের মাঝেও ছড়িয়ে দিয়েছিলেন।
প্রশ্ন : এখন সবাই সস্তা জনপ্রিয়তার দিকে ঝুঁকছে। সেখান থেকে শুদ্ধ সংগীত চর্চা করাটা কতটা সময়োপযোগী বলে আপনি মনে করেন?
উত্তর : শুদ্ধ সংগীত চর্চাটা আসলে সব সময়ের জন্যই জরুরি, যে আমলে আমি গান শিখেছি। আমরা যেমন স্বাস্থ্য ঠিক রাখার জন্য ব্যায়াম করি, কণ্ঠ ঠিক রাখার এবং তৈরি করার জন্য শাস্ত্রীয় সংগীত অবশ্যই শিখতে হবে। এটার কোনো বিকল্প নেই। এখনকার ছেলেমেয়েরা এটা কতটা উপলব্ধি করে, আমি জানি না। তবে কারো কারো গানে আমি শাস্ত্রীয় সংগীতের অলংকার পাই। এটা থেকেই আমি ধারণা করি, কেউ কেউ শাস্ত্রীয় সংগীত শিখছে। এ লাইনে যাঁরাই সাফল্য পেয়েছেন, তাঁরা যদি শাস্ত্রীয় সংগীত নাও জানেন, তো আমি বলব যে দেরি হয়ে গেছে—এমনটি ভাবার কিছুই নেই। শিক্ষা যেকোনো বয়সেই গ্রহণ করা যায়। শিক্ষার কোনো বয়স নেই।
প্রশ্ন : একজন ভালো শিল্পী হয়ে ওঠার জন্য কোন কোন গুণ আবশ্যক বলে আপনি মনে করেন?
উত্তর : প্রথমত, কণ্ঠে সাধারণভাবে সুর থাকতে হবে। ছন্দ বা তালজ্ঞান ভেতরে থাকতে হবে। এর পর শিক্ষা গ্রহণ করতে হবে। এবং নিজেকে কখনোই ভাবা যাবে না যে আমি অনেকটা শিখে ফেলেছি। সব সময় নিজের গান নিজের স্টাইলে করতে হবে এবং সেভাবে নিজেকে তৈরি করতে হবে। আত্মসমালোচনা বা নিজে কতটুকু শিখেছি, কতটুকু পারি না সেটা বোঝার ক্ষমতা থাকতে হবে। আমাকে কতটা পথ যেতে হবে, আমি কতটা পারি না বা পারি, সেটা জানতে হবে। এই সবটুকু মিলেই আমার ধ্যানটুকু থাকবে অনুশীলনের ওপর। কীভাবে অনুশীলন দ্বারা নিজেকে তৈরি করতে হবে।
প্রশ্ন : সংগীত শেখার সঠিক বয়স কোনটি?
উত্তর : ইদানীংকালে বিভিন্ন চ্যানেলে ছোট ছোট বাচ্চাকে যে মাপের গান করতে দেখা যায়; আমি কিছুদিন আগে একটি চ্যানেলে দেখলাম, একটি সাত বছরের শিশু গান করছে, যার কণ্ঠ একজন পরিণত লোকের মতো। আমি বলব যে, এই মেয়েটি বা ছেলেটির সে রকম প্রতিভাই আছে, যে প্রতিভা তাকে ওই পর্যায়ে নিয়ে গেছে অনেক আগেই। এগুলো একসেপশনাল বিষয়। তবে সঠিক বয়স বললেই আমি বলব, আমি কথা যখন বলতে পারব, বুঝতে পারব, লিখতে পারব, এই বয়সে যেকোনো মানুষ গান শিখতে শুরু করতে পারে। আমি বলব, পাঁচ/ছয় বছর এ রকম বয়সে। কারণ, আমি নিজেই তো ১০ বছর বয়সে শিশু প্রতিযোগিতায় নাম দিয়েছিলাম। তো, আমি নিশ্চয়ই আরো তিন-/চার বছর বয়স আগে থেকেই টুকিটাকি গান করি। অতএব, পাঁচ/ছয় বছর বয়সেই কিন্তু শিশুরা গান শিখতে পারে। গানের বেসিক যে জিনিসগুলো, যেমন—সারেগামা, স্বর চেনা, স্বর সাধনা ইত্যাদি।
প্রশ্ন : ছায়ানট সংগীত বিদ্যায়তনকে আমরা বাংলাদেশের শান্তিনিকেতন মনে করি। ঢাকায় যাঁরা সংগীত চর্চা করছেন, তাঁরা কিন্তু সরাসরি আপনাদের কাছ থেকে শুদ্ধ সংগীত চর্চার সুযোগ পাচ্ছেন। কিন্তু তৃণমূল পর্যায়ে অনেক প্রতিভা আছে, যাঁরা এ সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। তাঁদের জন্য ছায়ানট কী করছে?
উত্তর : আসলে এ ধরনের প্রস্তাব আমাদের অনেকেই দিয়েছে। ছায়ানটের আসলে প্রতিষ্ঠান হিসেবে সেই ভাবনা আছে। কিন্তু ছায়ানটের যে স্ট্যান্ডাড বা দর্শন, এটা ঠিক রাখার জন্য অনেক চেষ্টা করে গত ৫০ বছর ধরে রাখতে পেরেছি বলে আমরা মনে করি। এটা আসলে খুবই কঠিন কাজ। একটা ভয় আসলে মনে মনে কাজ করে যে, আমরা যদি খুব বেশি ছড়িয়ে পড়ি, তাহলে এই স্ট্যান্ডার্ডটা আমরা মেইনটেন করতে পারব কি না। যখন আমরা মনে করব, আমরা সেই কাজে হাত দেব। আমাদের সেই চিন্তাভাবনা, পরিকল্পনা রয়েছে। পাশাপাশি ছায়ানটের সঙ্গে যুক্ত অনেকেই কিন্তু ঢাকার বাইরে বিভিন্ন জেলায় সংগীত শেখাতে ব্যস্ত হয়েছেন। যেমন আমরা জানি, রবীন্দ্রসংগীত সম্মিলন পরিষদের অনেক কর্মীই ছায়ানটের সঙ্গে যুক্ত, এর পর বাংলাদেশ নজরুলসংগীত সংস্থাও এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে যে নজরুলের গান ঢাকার বাইরে ছড়িয়ে দেবে। কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা না বিভিন্ন কর্মশালার মাধ্যমে। এই কাজটি আমরা সামনে হাতে নেব। আর সম্মিলন পরিষদের পক্ষ থেকে নজরুলের পুরাতন যেসব রেকর্ড আছে, সেগুলো থেকেই আমরা শুদ্ধচর্চা ছড়িয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা বাস্তবায়নের চেষ্টা করে যাচ্ছি।
প্রশ্ন : বর্তমানে বিভিন্ন ধারার গান ফিউশন হচ্ছে। এই বিষয়টি আপনি কীভাবে মূল্যায়ন করছেন?
উত্তর : আসলে একটি বিষয় হলো এক্সপেরিমেন্ট করা। নানাভাবে, নানা সময় বড় বড় গুণীজন করেছেন। রবীন্দ্রনাথও করেছেন, নজরুলও করেছেন। এখনকার ছেলেমেয়েরাও করছে। মনে করি, একটি ইংরেজি গান ভেঙে বাংলায় অনুবাদ করে একি সুরে যদি গাই, সেটি কিন্তু ফিউশন হলো না। একটি ইংরেজি গান ভেঙে বাংলায় একি সুরে ও একই স্টাইলে গাওয়া হয়, যদি চট করে হঠাৎ করে কেউ আমাকে শোনায়, তো আমি বুঝব এটি একটি বিদেশি গান। কিন্তু আবার শব্দগুলো যখন বলছে, তখন ভাবব, আরে সে তো বাংলা বলছে। আসলে এটি কিন্তু বাংলা গান নয়। রবীন্দ্রনাথ এবং কাজী নজরুল ইসলাম—তাঁরা পাশ্চাত্য থেকে সুর গ্রহণ করেছেন, সুর নিয়ে এটি বাংলা গানের সুরের ধাঁচে মিশিয়েছেন এমনভাবে যে রবীন্দ্রনাথের কোনো গান শুনলে বা নজরুলের কোনো গান শুনলে বাইরে থেকে কখনই মনে হয় না, এটা বাংলা গান নয়। শব্দের সঙ্গে সেই সুরগুলো মিশিয়েছেন। এটাও কিন্তু এক ধরনের এক্সপেরিমেন্ট বা ফিউশন। আসলে ফিউশন কথাটার অর্থটা আমাকে প্রথমে ভালোভাবে বুঝতে হবে। ফিউশন হলো মেশানো। এমনভাবে মেশানো, যাতে আমি আমার সংস্কৃতিটাকে প্রধান রেখে বাইরের যা কিছু ভালো, সেটাকে মিশিয়ে সুন্দর কিছু একটা তৈরি করতে পারি। ফিউশনে বাংলা গানে বিদেশি সুরের ব্লেন্ডিংটা এমনভাবে হবে যেন তা বাংলা বলেই মনে হয়।
প্রশ্ন : তাহলে কি আমরা বলতে পারি, রবীন্দ্রনাথ বা নজরুল এখন জীবিত থাকলে এসব যন্ত্রের এক্সপেরিমেন্ট করতেন?
উত্তর : হয়তো করতেন, হয়তো করতেন না। রবীন্দ্রনাথের সময় কিন্তু তাঁর বাড়িতে পিয়ানো ছিল। তিনি পিয়ানো বাজাতে পছন্দ করতেন। কিন্তু উনি একটি কথা বলে গেছেন যে, আমার গানে যেন অতিরিক্ত বাদ্যযন্ত্রের ব্যবহার না হয়। বড়জোর একটি তানপুরা এবং সে সঙ্গে একটি এসরাজ। অর্থাৎ উনি গানটিকে প্রাধান্য দিয়েছেন সব সময়। এমন কোনো যন্ত্র বা এমন কিছু শব্দও যেন না থাকে গানের মধ্যে, যাতে শিল্পী যে গাইছেন, তাঁর ধ্যান যেন নষ্ট না হয় এবং যে শুনছেন, তাঁর ধ্যানও যেন নষ্ট না হয়। আজকাল এমন অনেক গান আমি শুনতে পাই, যার কথাও আমি বুঝতে পারি না। কারণ, মিউজিকটা হয়ে গেছে প্রধান, গানটা চলে গেছে ব্যাকগ্রাউন্ডে; বাণীটা হারিয়ে গেছে। আবার বাণীটাও যদি কখনো শুনি, সেখানেও অনেক সেনটেন্স কনস্ট্রাকসন, অর্থ সব মিলিয়ে খুব ভালো কিছু একটা দাঁড়ায় না। সে জন্য আমি বলি যে আমাদের যে ঐতিহ্য, সেটা আগে ভালোভাবে জানতে হবে। কাজী নজরুল ইসলাম, রবীন্দ্রনাথ, ডি এল রায়, রজনীকান্ত সেন, অতুলপ্রসাদ—এঁরা কীভাবে গান বেঁধেছেন। এঁদের বাণীগুলো, সুরগুলো যদি ভালোমতো শুনি, সেখান থেকে যদি আমি নতুন কিছু তৈরি করতে পারি তো, করব। যেমন পরবর্তী সময়ে আমাদের এই গানকে আরো নতুন করে তৈরি করেছেন সলিল চৌধুরী। আমাদের দেশেও অনেক বড় শিল্পী, যেমন—খান আতাউর রহমান সাহেব, খন্দকার নুরুল কবির, লেখকদের মধ্যে আবু হেনা মোস্তফা কামাল, গাজী মাজহারুল আনোয়ার—তাঁরা প্রত্যেকেই কিন্তু ভিন্ন ধাঁচের। তাঁদের রবীন্দ্রনাথও পড়া আছে, নজরুলও পড়া আছে। কিন্তু তাঁদের যে সৃষ্টিশীল জীবন সেটাকে তাঁরা তৈরি করেছেন। অতএব, আমাদের ঐতিহ্যটাকে আগে ভালো করে জেনে নিয়ে নতুন কিছুর সৃষ্টিতে হাত দেব। তাহলে সেই সৃষ্টিটা থেকে একটা ভালো কিছু বের হয়ে আসবে। এটা খুব জরুরি।
প্রশ্ন : নজরুল চর্চায় কেন এলেন? ছোটবেলায় তো অনেক ধারার গান করতেন। কোন বয়সটায় প্রকৃতভাবে নজরুলের গানে প্রভাবিত হয়েছিলেন?
উত্তর : আসলে ছেলেবেলায় জ্ঞানেন্দ্র গোস্বামীর গানে আমার ভালো লাগা শুরু হয়েছিল। এবং আমি শাস্ত্রীয় সংগীত শিখেছি। একটা পর্যায় ছিল যখন আমি কাজী নজরুল ইসলামের রাগপ্রধান গানই করতাম। কিন্তু আর একটা পর্যায়ে এসে আমি দেখলাম যে কাজী নজরুল ইসলামের গানে আরো অনেক কিছু আছে। একদিকে আমাদের যে শাস্ত্রীয় সংগীতের ধারা খেয়াল, ধ্রুপদ, ঠুমরি, গজল, কাজরি এবং নানান ধরনের ঋতুভিত্তিক গান, এর সবটাই যদি আমরা খুঁজি তো কাজী নজরুল ইসলামের গানে পাব। সে সঙ্গে তিনি বাংলা গানের ধারাও যুক্ত করেছেন, যেমন—লোকগানের ধারা। তিনি তাঁর বাণী দিয়ে এর সবটাই বেঁধেছেন। একটি বিষয় হলো, আমি রাগ সংগীত শিখেছিলাম, আরেকটি হলো যখন বুঝলাম কাজী নজরুলের অনেক দিকে বিচরণ রয়েছে, আমি তখন সেগুলো শেখার চেষ্টা করলাম। সত্যিকার অর্থেই নজরুল একজন অনন্য প্রতিভা। বিশেষ করে সংগীতের জগৎকে উনি সমৃদ্ধ করে দিয়ে গেছেন। রাগ সংগীতের প্রতি ভালোবাসা প্রথমে নজরুলের রাগপ্রধান গানের দিকে আমাকে আকৃষ্ট করে এবং পরে আমি সব ধরনের গানই গাওয়ার চেষ্টা করেছি।
প্রশ্ন : স্যার, আপনার প্রাপ্তি সম্পর্কে জানতে চাই?
উত্তর : প্রাপ্তি। ওই যে বললাম, ছোটবেলায় একটা পুরস্কার পেলাম, যেটা এই পথচলা শুরু করল। আর পুরস্কারের মধ্যে চ্যানেল আই অ্যাওয়ার্ড শ্রেষ্ঠ নজরুল সংগীতশিল্পী হিসেবে ২০০৯-এ। এ ছাড়া বিভিন্ন সংগঠন থেকে সম্মাননা। বিভিন্ন সংগঠনে গেলে তারা সম্মাননা দেয়। দেশে-বিদেশে গান করতে যাই নিয়মিত। পশ্চিমবঙ্গের টেলিভিশন চ্যানেলগুলো থেকে আমন্ত্রণ পাই। অনেক গান আমি করেছি সেখানে। নজরুলের গান তুলে ধরার ব্যাপারে কিছুটা হলেও সার্থক হয়েছি আমি। বিদেশেও নজরুলের গান করি। প্রায় এক বছর অন্তর অন্তর যাওয়া হয় আমার বড় বড় অনুষ্ঠানে গান করার জন্য। ছেলেমেয়েদের গান শেখাই। ছায়ানটে শিক্ষকতা করছি। পাশাপাশি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংগীত বিভাগেও আমি শিক্ষকতা করছি। শিল্পকলা একাডেমির এক্সিকিউটিভ বোর্ডে রয়েছি, নজরুল ইনস্টিটিউটের ট্রাস্টি বোর্ডে রয়েছি। আমি সামান্য একজন সংস্কৃতিকর্মী। ভালো কিছু করার বিভিন্ন চেষ্টা করছি। মূলত আমার চেষ্টা, আমি কিছু ভালো শিল্পী তৈরি করতে চাই, যারা আমাদের কাজটাকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাবে।
প্রশ্ন : বাইরের দেশের অনুষ্ঠান নিয়ে অভিজ্ঞতা জানতে চাই। কখনো কি মনে হয়েছে, যদি দ্বিতীয় কোনো দেশে থাকার কথা বলা হয় তো কোন দেশের প্রতি ভালো লাগার কথা বলবেন?
উত্তর : আমার দেশের চেয়ে ভালো কোনো জায়গা নেই। আমি সব সময় বলব, আমার দেশের মাটি, আমার দেশের মানুষ, আমার দেশ এবং ‘আমার দেশ’—এই কথাটি বলতে আমার অনেক ভালো লাগে। অপশন হিসেবে বিদেশে থাকার কথা কখনো ভাবিনি। সে কারণেই তরুণ বয়সে দেশে ফিরে এসেছি। অনেক মানুষই চলে যায়, বসবাস করছে। কিন্তু আমি মনে করি, এই দেশকে যদি কেউ ভালোবেসে কিছু যদি দিতে পারে তো, সেটাই একটা বড় পাওয়া জীবনে। তবে বিদেশে গান করতে গিয়ে কিছু ভালো অভিজ্ঞতা হয়েছে। একবার কলকাতায় (পশ্চিমবঙ্গ সরকারের আমন্ত্রণে) ‘বাংলা উৎসব’-এ গান করতে গিয়েছিলাম। সেখানে এক ভদ্রলোক মঞ্চের কাছে এসে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিলেন। আমার মনে পড়ে, ‘পদ্মার ঢেউ রে...’ গানটি আমি গেয়েছিলাম। এই গানটি বাংলাদেশেও বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছে। একুশে টেলিভিশনের মাধ্যমে প্রচার হয়েছিল সে সময়। এই গানটি করার পর ওই ভদ্রলোক মঞ্চের সিঁড়ির গোড়ায় দাঁড়িয়ে ছিলেন। আমি মঞ্চ থেকে নামার পরে ওই লোকটি আমাকে দেখে কাঁদছেন। আমি ভাবলাম, কী ব্যাপার, উনি কেন এমন করছেন? লোকটি আমাকে বললেন যে, বাবা, আমি তোমাকে একটু বুকে জড়িয়ে ধরে রাখতে চাই। কাঁদছেন এবং বলছেন, ‘বাবা, তুমি এই পদ্মার গান যে গাইলা, আমার তো দেশ বাবা পদ্মার পাড়ে, আমার সেই ছোটবেলার কথা মনে নেই। তোমার সুরটা আমার মনে খুবই স্পর্শ করেছে। পদ্মাপাড়ের দেশের বাড়ির কথা মনে পড়ে গেছে। এই অভিজ্ঞতার কথা আমি সারা জীবন ভুলব না। আমার গান যে তাঁকে কাঁদিয়েছে, এক ধরনের ব্যথা আবার এক ধরনের আনন্দ, এ দুটোর মিশ্রণ কিন্তু তাঁর। একটি হলো তাঁর ছেলেবেলার কথা স্মৃতিচারণ করতে পেরেছে সরাসরি, অন্যটি হলো তিনি যে মাটি ছেড়ে চলে গেছেন অন্য জায়গায় সেই ব্যথাটা ওই গান শোনার মধ্য দিয়ে উপলব্ধি করলেন। লোকটি আমার গান শুনে অঝোরে কাঁদলেন। এটা আমি মনে করি যে এটা আমার জন্য খুব বড় একটা প্রাপ্তি।
প্রশ্ন : স্যার, আপনার নিজের জীবন নিয়ে কিছু বলুন?
উত্তর : আমার স্ত্রী কল্পনা আনাম, সে ছায়ানটে শিক্ষকতা করে। রেডিও, টেলিভিশনেও গান করে। আমার দুই ছেলে লালমোহন স্কুল অব ইকোনমিকসে পড়ে। এবার ফাইনাল ইয়ার। পাস করে যাবে। ছোট ছেলে ক্লাস এইটে পড়ে সানবিম স্কুলে। আমার বাবা-মা দুজনই আছেন। আমরা এই একই ভবনে থাকি সেই পুরাতনী স্টাইলে। আগেকার দিনে যেমন সবাই একসঙ্গে মিলেমিশে থাকত, ঠিক সেভাবে। পারিবারিভাবেই আমরা ব্যবসায়ী। বাবার একটা ঢাকা রেকর্ড নামে কোম্পানি ছিল। উনি ওটার পার্টনার ছিলেন। সেই ঢাকা রেকর্ড কোম্পানি থেকে বঙ্গবন্ধুর বিখ্যাত এবং ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ প্রকাশ হয়েছিল। এবং প্রকাশ হয়েছিল বলেই আমরা মুক্তিযুদ্ধের সময় বজ্রকণ্ঠটি শুনতে পেরেছিলাম। আমি খুবই ভাগ্যবান। আমার মা-বাবা, আমরা দুই ভাই, দুই বোন। বড় বোন গত হয়েছেন কিছুদিন আগে কিডনি-সংক্রান্ত জটিলতায়। ছোট বোন ইকোনমিস্ট, বিলেতে থাকেন। ছোট ভাই ব্যবসায়ী, ফিন্যান্সিংয়ে পড়েছেন। আমি বেসিক্যালি একজন প্রকৌশলী। কিন্তু ইঞ্জিনিয়ারিং লাইনে আমার কর্মজীবন খুবই ছোট। আমি সংস্কৃতি চর্চা করব বলে ৯টা থেকে ৫টা অফিস করতে আগ্রহী ছিলাম না। আর আমি পাঞ্জাবি পরতে খুব ভালোবাসি, যদিও সব ধরনের পোশাকই পরি। ভাত, মাছ, ডাল, ভর্তা আমার প্রিয় খাবার। নজরুলের রাগাশ্রয়ী গান গাইতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি। খন্দকার নুরুল আলম সাহেব, আমার কাকা সত্য সাহা, খান আতাউর রহমান সাহেব, আহমেদ ইমতিয়াজ সাহেব—এঁদের সুরগুলো আমার কাছে খুব ভালো লাগে। এ ছাড়া বাংলা গানকে যাঁরা সমৃদ্ধ করেছেন, যেমন—সলিল চৌধুরী, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, সতীনাথ মুখোপাধ্যায়। যাঁরা সুর দিয়ে গেছেন বিভিন্ন সময়, তাঁদের প্রত্যেকের সুরের গান গাইতে আমার ভালো লাগে।
নজরুলের গানের মধ্যে ‘মেঘে মেঘে অন্ধ অসীম আকাশ’ গানটি ভালো লাগে, জয়জয়ন্তীর ওপর বাঁধা গানটি। এমন সুন্দর বন্দিশে জয়জয়ন্তীর বাঁধা গান খুব কম পাওয়া যায়। এ ছাড়া হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের অনেক গানই আমার ভালো লাগে। যেমন—আমায় প্রশ্ন করে নীল ধ্রুবতারা বা এতদিন পরে এলে একটু বসো, মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের আমি এত যে তোমায় ভালোবেসেছি, তালাত মাহমুদের ঘুমের ছায়া চাঁদের চোখে, কে এ কে কুন্দলাল অনেক আগে গেয়েছিলেন নাই বা ঘুমালে প্রিয় এখনো রজনী বাকি—এই গানগুলো আমার ভালো লাগে।
প্রশ্ন : এ পর্যন্ত আপনার কতগুলো সিডি বেরিয়েছে? এখন কি নতুন কোনো অ্যালবামের কাজ করছেন?
উত্তর : বেঙ্গল থেকে আমার পাঁচটি সিডি বেরিয়েছে। সব মিলিয়ে সিডির সংখ্যা বারো-তেরোটা হবে। এর মধ্যে নজরুল, দেশাত্মবোধক গান, দুটো সিডি আমি এবং আমার স্ত্রীর যৌথ। পুরোনো দিনের বাংলা চলচ্চিত্রের গান। বাংলাদেশি সুরকার, গীতিকারদের গান। সিডি দুটি ওয়ার্ল্ড মিউজিক থেকে বেরিয়েছে। দেশের গান বেরিয়েছে মৃত্তিকা নামে। আর দুটো নজরুলের গানের লেজার ভিশন থেকে। কিছুদিন আগেই তো বেণুকা নামে একটা সিডি বের হলো। ২০১৩ সালের মাঝামাঝি সময়ে।
প্রশ্ন : আপনার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী?
উত্তর : ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা আমার নিজেকে তৈরি করা আরো বেশি করে। যাতে করে আমি কাজী নজরুল ইসলামের গান আরো একটু ভিন্ন মাত্রায় নিয়ে যেতে পারি। আর দ্বিতীয়ত, কিছু ছাত্রছাত্রী তৈরি করা। এটি আমি খুব সিরিয়াসলি করি। আমি চাই যে অন্তত কুড়ি-পঁচিশজন ছেলেমেয়ে যদি তৈরি করতে পারি, যারা কাজী নজরুল ইসলামের গানকে একটা ভিন্ন মাত্রা দিতে পারবে। এবং নজরুলের দর্শক-শ্রোতা বাড়াতে পারবে আরো। এটা আমি খুব সিরিয়াসলি গান শেখাই। আর আমার শেখাতে খুব ভালো লাগে। আমার পনেরোজন ছাত্রছাত্রীকে নিয়ে অরুণ-রঞ্জণি নামে একটা সিডির কাজ করেছি। আর এই প্রজন্মের কে কেমন গাইছে, সেই স্বাদটা যদি কেউ পেতে চায় তো অরুণ-রঞ্জণি যদি শোনে তো বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে যাবে। আমি মনে করি, সিডির কাজটা খুব ভালো হয়েছে। আপাতত এভাবেই সামনে এগিয়ে যেতে চাই।