সংগীতের প্রবাদপুরুষ সলিল চৌধুরী

Looks like you've blocked notifications!

'I want to create a style which shall transcend borders - a genre which is emphatic and polished, but never predictable'. —Salil Chowdhury

তিনি একেধারে একজন সংগীত পরিচালক, গীতিকার, সুরকার, কবি ও গল্পকার। মূলত বাংলা, হিন্দি ও মালয়ালাম চলচ্চিত্রে সংগীত পরিচালনা করেছেন তিনি। আধুনিক বাংলা গানের সুরস্রষ্টা হিসেবে এবং গণসংগীতের প্রণেতা হিসেবে তিনি একজন স্মরণীয় বাঙালি। 

তিনি সলিল চৌধুরী, সব গুণগ্রাহীর কাছে যিনি ‘সলিলদা’ নামেই পরিচিত। তাঁর সংগীত প্রতিভা মূলত ভারতীয় চলচ্চিত্রশিল্পেই ব্যাপকভাবে স্বীকৃত। তিনি ছিলেন একজন আয়োজক। বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্র, যেমন : বাঁশি, পিয়ানো, এস্রাজ ইত্যাদি বাজাতে জানতেন তিনি। তাঁর মৌলিক কবিতাগুলোর জন্য তিনি ব্যাপকভাবে নন্দিত ও প্রশংসিত।

দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা জেলার রাজপুর সোনারপুর অঞ্চলের গাজীপুরের এক হিন্দু কায়স্থ পরিবারে সলিল চৌধুরীর জন্ম। তাঁর বাবা জ্ঞানেন্দ্রময় চৌধুরী আসামের লতাবাড়ী চা বাগানে ডাক্তারি করতেন। বাবা মানুষটি ছিলেন একেবারে অন্য ধাতের, যাকে বলে মাটির মানুষ। বাগানের কুলিকামিনদের নিয়ে নাটক করতেন। আর ছিলেন প্রচণ্ড রকমের ব্রিটিশবিরোধী। চা-শ্রমিকদের নিয়ে ছিলেন ভারি উদ্বিগ্ন। বালক সলিল খুব কাছে থেকেই বাবাকে দেখেছিল। জীবনের পরবর্তী ধাপগুলো তাই তৈরি হয়ে যাচ্ছিল তাঁর। 

বাবার কাছেই সলিল চৌধুরীর সংগীত শিক্ষার হাতেখড়ি। বাবার সংগ্রহে থাকা পাশ্চাত্য উচ্চাঙ্গসংগীত তিনি শুনতেন ছোটবেলা থেকেই। পিতৃব্য নিখিল চৌধুরীর কাছেও সংগীতের তালিম গ্রহণ করেন তিনি। মূলত নিখিল চৌধুরীর ঐক্যবাদন দল ‘মিলন পরিষদ’-এর মধ্য দিয়ে শৈশবেই সলিল চৌধুরীর গানের জগতে প্রবেশ। তাঁর শৈশবের বেশির ভাগ সময় কেটেছে আসামের চা বাগানে। আট ভাইবোনের মধ্যে সলিল ছিলেন দ্বিতীয়।
 
দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা জেলার সুভাষ গ্রামে (পুরাতন নাম কোদালিয়া) মামার বাড়িতে থেকে পড়াশোনা করেন সলিল। সেখানকার হারিনাভি বিদ্যালয় থেকে প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিকুলেশন এবং উচ্চ মাধ্যমিক (আইএসসি) পাস করেন তিনি। এরপর বিএ পাস করেন কলকাতার বঙ্গবাসী কলেজ থেকে। ওই সময়েই তাঁর সংগীত জ্ঞানে পরিপক্বতা লাভের পাশাপাশি দ্রুত বামধারার রাজনৈতিক ধারণা জন্মায়। তিনি ছিলেন দারুণ মেধাসম্পন্ন।

১৯৪৪ সালে তরুণ সলিল কলকাতায় আসেন তাঁর স্নাতক পড়াশোনার জন্য। তখনই ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির সাংস্কৃতিক দল ভারতীয় গণনাট্য সংঘ বা আইপিটিএ (ইন্ডিয়ান পিপলস থিয়েটার অ্যাসোসিয়েশন)-এ যোগ দেন তিনি। এ সময় তিনি গান লিখতে ও সুর করতে শুরু করেন। আইপিটিএর সাংস্কৃতিক দলটি বিভিন্ন শহর ও গ্রামগঞ্জে ভ্রমণ করতে থাকে। সেইসঙ্গে সাধারণ মানুষের কাছাকাছি নিয়ে আসে ওই গানগুলো। ‘বিচারপতি’, ‘রানার’ এবং ‘অবাক পৃথিবী’র মতো গান তখন সাধারণ জনতার কাছে ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে।

গাঁয়ের বধূর মতো গান তখন বাংলা সংগীতে একটি নতুন ধারা তৈরি করেছিল, যা মাত্র ২০ বছর বয়সে সুর করেছিলেন সলিল। পশ্চিমবঙ্গে তখনকার প্রায় প্রত্যেক প্রতিষ্ঠিত শিল্পী এসব গান গেয়েছেন। এর মধ্যে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, শ্যামল মিত্র, মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়, প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ উল্লেখযোগ্য।

সলিল চৌধুরীর প্রথম বাংলা চলচ্চিত্র ‘পরিবর্তন’ মুক্তি পায় ১৯৪৯ সালে। তাঁর ৪১টি বাংলা চলচ্চিত্রের সর্বশেষ চলচ্চিত্র ছিল ‘মহাভারতী’, যা ১৯৯৪ সালে মুক্তি পায়।
১৯৫৩ সালে বিমল রায় পরিচালিত ‘দো বিঘা জামিন’ চলচ্চিত্রে সংগীত পরিচালক হিসেবে হিন্দি চলচ্চিত্রশিল্পে অভিষেক ঘটে সলিল চৌধুরীর। সলিল চৌধুরীর ছোটগল্প ‘রিকশাওয়ালা’ অবলম্বনে এই চলচ্চিত্র নির্মিত হয়। এই চলচ্চিত্র তাঁর কর্মজীবনে যোগ করে নতুন মাত্রা। এটি প্রথমে ফিল্মফেয়ার সেরা চলচ্চিত্র পুরস্কার এবং পরে ফ্রান্সের কান চলচ্চিত্র উৎসবে আন্তর্জাতিক পুরস্কার জিতে নেয়।

বাংলা ও হিন্দি চলচ্চিত্রে ২০ বছর কাজ করার পরে সলিল চৌধুরী ১৯৬৪ সালে ‘চিম্মিন’ দিয়ে প্রবেশ করেন মালয়ালাম চলচ্চিত্রে। চলচ্চিত্রটি সফলতার মুখ না দেখলেও তাঁর মালয়ালাম গানগুলো পেয়েছিল দারুণ জনপ্রিয়তা। প্রায় ৭৫টির বেশি হিন্দি চলচ্চিত্র, ৪০টির বেশি বাংলা চলচ্চিত্র, প্রায় ২৬টি মালয়ালাম চলচ্চিত্র এবং বেশ কিছু মারাঠি, তামিল, তেলেগু, কান্নাড়া, গুজরাটি, ওড়িয়া এবং অসামিয়া চলচ্চিত্রে সংগীত পরিচালনা করেন তিনি।

সলিল চৌধুরীর সংগীতে লক্ষ করা যায় পশ্চিমা এবং ভারতীয় উচ্চাঙ্গসংগীতের সমান মিশ্রণ। তাঁর পাশ্চাত্য উচ্চাঙ্গসংগীতের সরাসরি অভিযোজনগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ‘ছায়া’ চলচ্চিত্রে মোৎজার্টের সিম্ফোনি নং ৪০-এর ওপর ভিত্তি করে ‘ইতনা না মুঝে তু পেয়ার বাড়া’, ‘অন্যদাতা’ চলচ্চিত্রে চোপিন-এর কাজের ওপর ভিত্তি করে ‘রাতো কি সায়ে ঘানে’ ইত্যাদি।

একটি ঘটনার কথা বলে লেখাটির ইতি টানা যাক। মধ্য পঞ্চাশের পর ভারত কাঁপাতে বোম্বে যেতে আগ্রহী হলেন সলিল। তারপরই খুলে গেল আরেক সুরের দুয়ার। সর্বভারত দেখল বাঙালির প্রতিভা। আগেই অবশ্য শাস্ত্রীয় সংগীতের জগতে আলাউদ্দীন খাঁ, রবিশঙ্কর প্রমুখের বাদনে মুগ্ধ হয়েছিল। এবার দেখল এক বাঙালি সুরকারের ফিল্মি গানের চমক। বোম্বের জীবনে প্রথম প্রথম মনে হয় খানিকটা স্ট্রাগল ছিল সলিলের। বাঙালি-বিদ্বেষ রাহুল দেববর্মনের জীবনকে কীভাবে বিপর্যস্ত করে দিয়েছিল, সেসব কথা আমরা অনেকেই জানি। যাক। সেসব অবশ্য আরো পরের কথা। 

বোম্বে যাওয়ার পর সলিল শুনলেন এক প্রডিউসার নতুন ছবিতে হাত দেবেন। সলিল কাজ চাইলেন। প্রডিউসার আমতা আমতা করলেন। দুজনে নাকি সন্ধ্যার পর সাদা রঙের অ্যাম্বাসাডর গাড়ির ভেতরে বসেছিলেন। তখন বর্ষাকাল। ঝরঝর বৃষ্টি। গাড়ির জানালার কাচে বৃষ্টি। সলিল কৌতুক করে বললেন, ‘আমি তো আপনার ছবি হিট করাব বলে আগেভাগেই সুর তৈরি করে রেখেছি।’ প্রডিউসার অবাক হয়ে বললেন, ‘বলেন কী? সুর তৈরি করে রেখেছেন! আচ্ছা, শোনান তো।’ সলিল সুর ভাঁজলেন। প্রডিউসার কেঁপে উঠলেন। অভিভূত। সলিলের হাত ধরে কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বললেন, ‘গানটা আর কাউকে দিয়েন না প্লিজ...।’ 

সলিল হেসে বললেন, ‘আরে, আপনার গান অন্যকে দেবো কেন?’ 
কোন গানটা? 

লতার গাওয়া ‘না যেও না/ রজনী এখনও বাকি...’

তারপর সবটুকু ইতিহাস।