ডালের পঞ্চনামা
আমাদের কাছে প্রোটিন মানেই তো মাছ, মাংস, ডিম। ডালকে আমাদের মন এখনো কেন জানি না আমিষ মানতে নারাজ। অনেক বাচ্চাই সরলভাবে প্রশ্ন করে বসে, ডাল আবার মাংস হলো নাকি। আসলেই তো। এমনকি সয়ামাংসও নৈব নৈব চ। তবে জাতিসংঘ প্রাণিজ আমিষ নয়, উদ্ভিজ্জ আমিষের ওপর অধিক নির্ভর হওয়ার পরামর্শ দিচ্ছে। উদ্ভিজ্জ প্রোটিন বিশেষত, ডাল বা বিন কেবল মানব-শরীরের জন্যই নয়, উপকারী প্রকৃতির জন্যও। কারণ, ডালে কম কার্বন ও ওয়াটার ফুটপ্রিন্ট থাকায় তা তুলনামূলকভাবে প্রকৃতিবান্ধব। এ জন্যই জাতিসংঘ আগামী বছর, অর্থাৎ ২০১৬ সালকে আন্তর্জাতিক ডালবর্ষ হিসেবে ঘোষণা করেছে।
একটা হিসাব দেওয়া যেতে পারে বরং। গ্লোবাল পালস কনফেডারেশনের তথ্য অনুযায়ী যেকোনো ধরনের ডাল আধা কেজি উৎপন্ন হতে লাগে মাত্র ১৬২ লিটার জল। অথচ সমপরিমাণ গরুর মাংসের জন্য লাগে সাত হাজার লিটার জল। তাই মাংস কম খাওয়া মানে বেশি জলের সাশ্রয়। যেকোনো ধরনের ডাল সংরক্ষণ ও পরিবহনের জন্য কোনো রেফ্রিজারেশন প্রয়োজন নেই। অথচ মাংস সংরক্ষণ ও পরিবহনের জন্য প্রয়োজন রেফ্রিজারেশন। আবার ডাল চাষের ক্ষেত্রে বেশি রাসায়নিক পদার্থের প্রয়োজন পড়ে না। ডাল হচ্ছে লেগিউম-জাতীয় গাছ। এদের শিকড়ে এক ধরনের ব্যাকটেরিয়া গুটি তৈরি করে নাইট্রোজেন সংরক্ষণ করে রাখে। ফলে যে জমিতে ডাল চাষ করা হয়, সেই জমির উর্বরতা বাড়ে। যেকোনো ডাল আর বিন দিয়ে নানা ধরনের পদ রান্না করে সবাইকে চমকে দিয়েছেন অস্ট্রেলিয়ান শেফ সাইমন ব্রায়ান্ট। তাঁর হাতে ডাল মানে অনন্য স্বাদ। বুফেতে প্রাণিজ আমিষ না থাকলেও হয়। অতিথিরা ডাল আর বিনই খুঁজে থাকেন তখন। ‘ভেজিটেবলস, গ্রেইনস অ্যান্ড আদার স্টাফ’ বইয়ের লেখক সাইমনকে আন্তর্জাতিক ডালবর্ষের অ্যাডভোকেট নিযুক্ত করেছে জাতিসংঘ।
আমি মাংসবিরোধী নই। তবে আমরা কেন জানি না অতিরিক্ত প্রাণিজ আমিষ খেয়ে থাকি। সেটা কমানোর একমাত্র উপায় ডাল বা বিন খাওয়া। এমনকি একই পদে দুই ধরনের প্রোটিন মিলিয়েও রান্না করা যায়, বলেছেন সাইমন; তাতে ওই পদের স্বাদও বাড়ে, প্রোটিনের পরিমাণও ঠিক রাখা যায়।
পাঠক, এ ক্ষেত্রে কিন্তু আমাদের ডাল-গোশত আর হালিম যথার্থ উদাহরণ হতে পারে; কী বলেন? এই পদ দুটি একাধারে উপাদেয় আর স্বাস্থ্যকর। আমাদের দেশে ডালের নানা ধরনের ব্যবহার রয়েছে। বিভিন্ন ধরনের পুষ্টিকর বড়া তৈরি করা হয়। যাহোক, পশ্চিমা দেশগুলোতে কিন্তু প্রাণিজ প্রোটিনের চেয়ে উদ্ভিজ্জ প্রোটিনের ওপর নির্ভরতা ক্রমে বাড়ছে। অন্যদিকে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে এই ট্রেন্ড একেবারে উল্টো। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে গতানুগতিকভাবে ডাল রান্না না করে বরং রেসিপিতে নানা ধরনের বৈচিত্র্য আনা হচ্ছে। ডাল দিয়ে কোপ্তা, ফলাফল হচ্ছে। ডাল দিয়ে তৈরি ফ্রোজেন ফুডের সংখ্যাও এখন আন্তর্জাতিক বাজারে ক্রমবর্ধমান।
সয়ামাংসের মতো বিকল্প মাংসের প্রতি আগ্রহ বিভিন্ন দেশেই বাড়ছে। আমেরিকা আবার এই দৌড়ে এগিয়ে রয়েছে। সেখানকার একাধিক কোম্পানি মাংসের কাছাকাছি স্বাদ ও সৌরভের উদ্ভিজ্জ প্রোটিন বাজারে ছেড়েছে। এসব প্রোটিন দিয়ে চমৎকার প্যাটি তৈরি করা হচ্ছে বার্গারের জন্য। এদের লক্ষ্য উভয়বিধ। উদ্ভিজ্জ প্রোটিনের ওপর নির্ভরশীল করার মাধ্যমে প্রাণিজ প্রোটিনের ওপর চাপ কমানো।
তবে এই উদ্যোগের বিপরীতেও মত আছে। অজি নিউট্রিশানিস্ট ডা. রোজমেরি স্ট্যান্টনের ভাষ্য, ডাল ও বিন থেকে মাংসের বিকল্প খাদ্য তৈরি করতে গিয়ে যে প্রচুর পরিমাণে অ্যাডিটিভস ব্যবহার করা হচ্ছে, যেটার দিকে কারো নজর নেই। তাঁর মতে, মধ্যপ্রাচ্য, ভারতীয় উপমহাদেশ আর ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের খাদ্যাভ্যাস শ্রেয়তর এবং কার্যকর। কারণ, এসব অঞ্চলের খাদ্যে কেবল প্রাণিজ প্রোটিন নয়, উদ্ভিজ্জ প্রোটিন, কার্বোহাইড্রেট আর অন্যান্য পুষ্টি উপাদান থাকে। তা ছাড়া সব উদ্ভিজ্জ প্রোটিনই সম্পূর্ণ নয়। অর্থাৎ প্রয়োজনীয় অ্যামাইনো অ্যাসিডের সব বিদ্যমান থাকে না।
আমরা প্রচুর পরিমাণে উভিজ্জ প্রোটিন গ্রহণ করে থাকি। ডাল ছাড়া তো আমাদের একবেলাও চলে না। যদিও এর পুষ্টিগুণ নিয়ে কতটা মাথা ঘামানো হয়, সেটা তর্কের বিষয়। অবশ্য আমরা জানি কি না, তা-ও স্পষ্ট নয় যে আগামী বছর জাতিসংঘ আন্তর্জাতিক ডালবর্ষ হিসেবে ঘোষণা দিয়েছে। এ ক্ষেত্রে কিন্তু চমৎকার একটা উপায় হতে পারে। বাংলাদেশ সরকার আগামী বছর পর্যটন বর্ষ হিসেবে ঘোষণা দিয়েছে। এই অবকাশে বাংলাদেশের বিভিন্ন পর্যটন অঞ্চলের পরিচিত ডাল বা বিনজাতীয় খাদ্য উপাদান এবং তা দিয়ে তৈরি ওই এলাকার জনপ্রিয় ডিশকে প্রমোট করা যেতে পারে। ওই পর্যটন এলাকার হোটেল ও রেস্তোরাঁগুলোকে এ ব্যাপারে নির্দেশনা দেওয়া যেতে পারে। তাতে করে আমাদের ডিশগুলোও জনপ্রিয় হবে। পর্যটন করপোরেশন ও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় এবং বাংলাদেশের ট্যুর অপারেটর কোম্পানিগুলোও বিষয়টি ভেবে দেখতে পারে।
লেখক : সাংবাদিক ও লাইফস্টাইল প্রফেশনাল