অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা : যেতে হবে বহুদূর
সেপ্টেম্বরের শেষের দিকে ঢাকার আবহাওয়া বেশ গরম। তবে দীর্ঘ বিমানযাত্রার পর জার্মানির হামবুর্গ আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে বের হয়েই দেখলাম উল্টো চিত্র। সেখানে হাড় কাঁপানো শীত।
জার্মানিতে আসার উদ্দেশ্য ‘গ্লোবাল ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিজম’ কনফারেন্সে অংশ নেওয়া। শহরের হাফেনসিটি ইউনিভার্সিটিতে চার দিনের এ আয়োজনকে মহাসম্মেলন বলাই ভালো। কারণ, বিশ্বের ১৩০টি দেশের প্রায় এক হাজার ৭০০ রিপোর্টার, এডিটর ও মিডিয়া বিশেষজ্ঞ এখানে জমায়েত হন। বলা হয়, অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের এটি বিশ্বের সবচেয়ে বড় সম্মিলন।
এত বড় আয়োজনে শেখা ও জানা-বোঝার অপার সম্ভাবনার হাতছানি চারপাশে। নানা দেশের নানা মানুষের বিচিত্র সব অভিজ্ঞতা, চ্যালেঞ্জ। অনুসন্ধানী সাংবাদিকতায় কারো কারো অভিজ্ঞতা গল্প-সিনেমাকেও হার মানায়। এই আন্তর্জাতিক সম্মেলন থেকে যতটুকু শিখেছি সেখান থেকে কয়েকটি বিষয় এখানে উল্লেখ করছি—
১. সাংবাদিক হিসেবে নিজেকে সবার কাছে উপস্থাপন করতে পারা একজন অনুসন্ধানী সাংবাদিকের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। নিজেকে গুটিয়ে রেখে কোনো কিছু অর্জন করা সম্ভব নয়। সম্মেলনে অংশ নেওয়া একজন মডারেটরের ভাষায়, ‘যখন আপনি সাংবাদিক, কিন্তু কারো সঙ্গে সমন্বয় করছেন না, আপনি পেছনেই পড়ে থাকবেন। কিন্তু সব সময় সবকিছুর সমন্বয় করাটাও যে বেশ কঠিন, সেটিও উঠে আসে এই আলোচনায়।’
২. মানুষ ভুল থেকে শিক্ষা লাভ করে। পেশাগত জীবনে এই ভুলগুলো একজন সংবাদকর্মীকে আরো সমৃদ্ধ করে। সম্মেলনের একটি বিষয়ের শিরোনামই ছিল Sharing Your Mistake, যেখানে বিশেষজ্ঞ, সাংবাদিক ও অন্যরা তাঁদের সাংবাদিকতার ভুলগুলো তুলে ধরেন, যা ভবিষ্যতে অংশগ্রহণকারীদের সতর্ক করবে।
৩. অনুসন্ধানী সাংবাদিকতায় প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা পেতে নানা ধরনের চ্যালেঞ্জের কথাও উঠে আসে। নাইজেরিয়ার এক অনুসন্ধানী সাংবাদিকের অভিজ্ঞতা এ রকম যে—ক্রিমিনাল জাস্টিস সিস্টেম নিয়ে কাজ করতে গিয়ে তাঁকে দুই সপ্তাহ জেল খাটতে হয়। তবে এটা আপাতদৃষ্টিতে তাঁর জন্য কষ্টকর হলেও গ্রেপ্তার হওয়ার পর থেকে জামিন পাওয়া পর্যন্ত প্রত্যেকটি বিষয়ে প্রত্যক্ষভাবে দেখা এবং এই পুরো প্রক্রিয়ায় অব্যবস্থাপনার বিষয়গুলো সম্পর্কে সরাসরি তাঁর যে অভিজ্ঞতা হয়েছে, সেটি তাঁর ক্যারিয়ারে একটা নতুন অধ্যায় যুক্ত করেছে।
৪. সংবাদের উৎস বা সেগুলোর ব্যবহারে অনুসন্ধানী সাংবাদিককে যে বেশ কৌশলী হতে হয়, এই সম্মেলনে উঠে আসে সে কথাও। পুরোনো সেই কথাটিই নতুন করে বললে এ রকম—সংবাদের সোর্স বা সূত্রের সঙ্গে সাংবাদিকের সম্পর্ক হবে বন্ধুত্বের। কাউকে চাপের মুখে ফেলে নয়, বরং সাবলীলভাবে সাংবাদিককে সঠিক তথ্যটি বের করে আনতে হয়। সেইসঙ্গে উৎস থেকে নির্ভুল তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ এবং সেটিকে কত সুন্দরভাবে এবং নতুন ভঙ্গিতে উপস্থাপন করা যায়, সেদিকেও জোর দেওয়া হয়। সূত্রের প্রতি পক্ষপাত নয়, বরং তথ্য সংগ্রহ করে তাঁর নিরপেক্ষ বিশ্লেষণের ওপরেই বেশি জোর দেওয়া উচিত বলে অংশগ্রহণকারীরা মনে করেন।
৫. সাংবাদিক হিসেবে নিজেকে নির্ভুল ও নির্ভরযোগ্য হিসেবে সবার সামনে উপস্থাপনের বিষয়টি অনেক গুরুত্বপূর্ণ। নিজের ওপর বিশ্বাস স্থাপন এবং অন্যের কাছে আস্থাশীল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার কাজটি যে সহজ নয়, সে কথা মনে রেখেই এ বিষয়ে তৎপর থাকা। অনুসন্ধানী সাংবাদিক হিসেবে নিজেকে বিশ্বাসযোগ্য, নির্ভরশীল এবং পক্ষপাতমুক্ত প্রমাণ করাটা খুব জরুরি। সংবাদটি যেন সংশ্লিষ্ট মহলে আলোড়ন তুলতে পারে, সে বিষয়েও নতুন আঙ্গিক ও কৌশল ভাবনায় রাখা দরকার।
৬. সাংবাদিক হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে সততার ওপর জোর দিয়েছেন সবাই। অংশগ্রহণকারী একজন বিশেষজ্ঞের মতে, ‘The battle for truth is the battle of our generation. With technology, as the accelerant, a lie told a million times becomes a fact. Without facts we don’t have truth. Without truth, there is no trust.’ কোনো বিষয়ে তদন্ত যেন সংবাদকর্মীকে সঠিক পথ থেকে বিচ্যুত না করে, সেদিকেও লক্ষ রাখা জরুরি।
৭. মোবাইল সাংবাদিকতা, সংক্ষেপে যেটি মোজো নামে বেশ জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে, তার আদ্যোপান্ত উঠে আসে এ সংক্রান্ত দুটি সেশনে। অস্ট্রেলিয়ার একজন সিনিয়র সাংবাদিকের মতে, ভবিষ্যতে মোবাইল সাংবাদিকতা বিশ্বব্যাপী সাংবাদিকদের মাঝে সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয় হয়ে উঠবে।
৮. যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বিশ্বব্যাপী অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা এগিয়েছে অনেকটা। তবে এতে ঝুঁকি যেমন বেড়েছে, তেমনি বেড়েছে প্রযুক্তির ব্যবহার। বাস্তবতা হচ্ছে, এ দুটির সঙ্গে সমন্বয় করে পেশাগত উৎকর্ষ অর্জনের পথে বাংলাদেশের সাংবাদিকদের হাঁটতে হবে আরো অনেক পথ।
লেখক : স্টাফ রিপোর্টার, চ্যানেল টোয়েন্টিফোর