করোনার মধ্যে ডেঙ্গুর আবির্ভাব, চাই মশার সফল নিয়ন্ত্রণ

দেশে বৈশ্বিক মহামারি কোভিড-১৯-এর দুর্যোগ চলছে। লকডাউন করে পরিস্থিতি মোটামুটি সামাল দিলেও শিথিল করলে কী যে হবে কে জানে। এমনিতেই করোনা আতঙ্কে আমাদের নাভিশ্বাস উঠে গেছে, এর মধ্যে আবার ডেঙ্গুর হাতছানি। বৃষ্টির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে মশা। ডেঙ্গু ভাইরাসের বিস্তার শুরু হয়ে গেছে। ইতোমধ্যে দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে প্রায় দুইশর বেশি ডেঙ্গু রোগী ভর্তি হয়েছে, যা সত্যিই এলার্মিং। আমাদের হাসপাতালগুলো এখন করোনা রোগী নিয়েই হিমশিম খাচ্ছে। যদি এর সঙ্গে ডেঙ্গু ভাইরাস যোগ হয় তাহলে অবস্থা কোথায় গিয়ে দাড়াঁবে, তা বলাই বাহুল্য। মরার উপর খড়ার ঘার মতো অবস্থা হবে হয়তো।
হাসপাতালগুলোতে করোনা ও ডেঙ্গু রোগী একসঙ্গে ভিড় করলে অবস্থা খুবই ভয়াবহ হতে পারে। গেল বছর ডেঙ্গু মশা আমাদের ব্যাপক ভুগিয়েছিল। প্রায় এক লাখেরও বেশি ডেঙ্গু রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিল এবং ১৬৪ জনের প্রাণহানি ঘটেছিল। ২০১৯-এর জুলাই-আগস্ট-সেপ্টেম্বর, এই তিন মাস ডেঙ্গু ভাইরাসে আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা ছিল সর্বোচ্চ। আর এ বছর এপ্রিলেই ডেঙ্গু রোগীর ছড়াছড়ি। আগামী দিনগুলোতে কী যে হবে! আমরা সচরাচর মশা নিয়ন্ত্রণের চেয়ে ডেঙ্গু চিকিৎসায় বেশি মনোযোগ গিয়ে থাকি। কিন্তু এবার দেশের প্রেক্ষাপট ভিন্ন। ডেঙ্গুর চেয়ে ভয়ানক করোনাভাইরাস আমাদের তাড়া করছে। তাই সার্বিক দিক বিবেচনায় এ বছর ডেঙ্গু রোগের প্রতিকারের চেয়ে মশার শক্ত প্রতিরোধ করাটাই শ্রেয় হবে। মশা নিয়ন্ত্রণ ঠিকমতো করতে পারলে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা কমবে এবং হাসপাতালে চাপ কম পড়বে। তাই সরকারকে মশা নিয়ে এখনই সিরিয়াসলি ভাবতে হবে। মশা দমনে নিতে হবে আগাম, কার্যকর ও সমন্বিত পদক্ষেপ।
এখন প্রায় প্রতিদিনই বৃষ্টি হচ্ছে। বৃষ্টির পানি আমাদের চারদিকে বিভিন্নভাবে (পুরাতন বালতি, টব, ডাবের খোসা, পলিথিন ইত্যাদি) জমে থাকছে। আর এই জমা পানিতে দু-তিন দিনের মধ্যেই জন্ম নিচ্ছে মশার লার্ভা। গত বছর মশা বিভিন্ন স্থানে অসংখ্য ডিম পেড়ে রেখেছিল আর সেগুলো ফুটে এখন লার্ভা বেরোচ্ছে এবং মশার বংশবৃদ্ধি হচ্ছে। সুতরাং বৃষ্টির পানিতে এভাবে লার্ভা জন্ম নেওয়াকে বাধাগ্রস্ত করতে হবে। লার্ভা জন্মানোর উৎসগুলো ধ্বংস করতে হবে অর্থাৎ সোর্স রিডাকশন করতে হবে। আর জন্ম নেওয়া লার্ভা ধ্বংস করার জন্য লার্ভিসাইডিং কার্যক্রম পরিচালনা করতে হবে। আর এজন্য গণসচেতনতা বৃদ্ধি করে সাধারণ মানুষের করণীয় নিশ্চিত করতে হবে। আগামী ভরা বর্ষা মৌসুমে (আগামী তিন মাস পর অর্থাৎ জুন-জুলাই-আগস্টে) মশা যাতে ব্যাপক আকার ধারণ করতে না পারে, তাই এখনই সচেতন হতে হবে। সেজন্য মশার সারভিলেন্স (ডিম, লার্ভা ও পূর্ণাঙ্গ মশা) পরিচালনা করতে হবে এবং সে অনুযায়ী পদক্ষেপ নিতে হবে।
লার্ভার উৎস ধ্বংসকরণ (সোর্স রিডাকশন) কার্যক্রমে সাধারণ জনগণকে সম্পৃক্ত করতে হবে। লার্ভা জন্ম নেওয়ার মূল জায়গাগুলো (বাসাবাড়ির সামনে পানি জমে থাকে এ রকম কিছু) কিংবা নির্মাণাধীন বাড়ি, পরিত্যক্ত বাসাবাড়ি, ডোবা, ছোট জলাশয় ইত্যাদি চিহ্নিত করে লার্ভার উৎস নিয়মিত ধ্বংস করতে হবে। বৃষ্টির পানি যাতে কোথাও জমতে না পারে তাতে বিশেষ নজরদারি বাড়াতে হবে। প্রয়োজনে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণসহ কঠোর মনিটরিং করতে হবে। গত বছর লার্ভার উৎস ধ্বংসকরণে কর্তৃপক্ষ নজর দিয়েছিল, কিন্তু তা অনেক দেরিতে। তত দিনে মশা ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছিল। তাই এ বছর যেন আর অবহেলা না হয়। লার্ভার উৎস ধ্বংসকরণ বা সোর্স রিডাকশনের পাশাপাশি এই সময়ে লার্ভিসাইডিং (লার্ভার ধ্বংসকরণ) কার্যক্রমে মূল নজর দিতে হবে। যেখানেই লার্ভা জন্মাবে, সেখানেই লার্ভিসাইডিং কার্যক্রম চালাতে হবে। লার্ভিসাইডিং হচ্ছে মশা দমনের মূল অস্ত্র। তাই লার্ভিসাইডিং কার্যক্রমে কার্যকর লার্ভিসাইড ব্যবহার অপরিহার্য। গত বছর লার্ভার ধ্বংসকরণ কার্যক্রমে ভালো সফলতা আসেনি। সম্ভবত সঠিক ও সময়োপযোগী লার্ভিসাইড প্রয়োগ করা হয়নি। করলেও এর সঠিক মাত্রা ও ব্যবহারবিধি নিশ্চিত করতে হবে। প্রচলিত বা ব্যবহৃত লার্ভিসাইডগুলো কতটা কার্যকর তা যাচাই করতে হবে। আন্তর্জাতিক বাজারে এখন খুব কার্যকর লার্ভিসাইড (বিটিআই, স্পাইনোসাদ ইত্যাদি) পাওয়া যাচ্ছে, প্রয়োজনে এগুলো যাচাইপূর্বক প্রয়োগ করতে হবে। অকার্যকর লার্ভিসাইডের প্রয়োগ বাদ দিতে হবে। মনে রাখা প্রয়োজন, লার্ভার উৎস ধ্বংসকরণ ও লার্ভিসাইডিং কার্যক্রম ওতপ্রোতভাবে জড়িত। মশা নিয়ন্ত্রণ সফল করতে চাইলে সবদিকেই সমান নজর দিতে হবে। তা ছাড়া লার্ভা বা মশা উৎপাদনের কমন জায়গাগুলো চিহ্নিত করাও জরুরি। এ জন্য এরিয়াভিত্তিক ম্যাপিং করতে হবে এবং সে অনুযায়ী লার্ভিসাইডিং করতে হবে। যত্রতত্র লার্ভিসাইডিং করা যাবে না।
এখন পূর্ণাঙ্গ মশার উপস্থিতি সব জায়গায় থাকলেও এরা এলাকাভিত্তিক (শুধু আক্রান্ত এলাকায়) ডেঙ্গু ভাইরাস বহন করছে। তাই এসব এলাকার পূর্ণাঙ্গ মশা মারতে বিশেষ এডাল্টিসাইডিং কার্যক্রম চালাতে হবে। তা ছাড়া সারা দেশে মশার উৎপাত বন্ধ করতে রুটিনমাফিক এডাল্টিসাইডিং করতে হবে। এগ লেইং মশা চিহ্নিত করে কীটনাশক প্রয়োগ করতে হবে। ফগিংয়ে কার্যকর কীটনাশক ব্যাবহার করতে হবে। শুধু লোকদেখানো যত্রতত্র ফগিং করলেই চলবে না। মশা মরছে কি না বা কমছে কি না তা মনিটরিং করতে হবে। ফগিং ছাড়াও এখন অনেক উন্নত স্প্রেয়ার মেশিন রয়েছে (ইউএলবি স্প্রেয়ার), প্রয়োজনে তা ব্যবহার করা যেতে পারে। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, লার্ভিসাইডিং ও এডাল্টিসাইডিং কার্যক্রম সফল করতে হলে মশার জীবনচক্রের সঙ্গে মিল রেখে কীটনাশক প্রয়োগ করতে হবে।
করোনাকালে দেশ এখন অনেকটা লকডাউন অবস্থায় আছে। সরকারি-বেসরকারি প্রায় সব প্রতিষ্ঠান, অফিস, বিল্ডিং, স্থাপনা বা পরিত্যক্ত স্থানগুলো বন্ধ রয়েছে। হাজার হাজার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এখন তালাবদ্ধ। তাই এসব জায়গায় এখন লার্ভা জন্ম নেওয়ার সুযোগ বেশি থাকবে। আর এসব জায়গায় এবার বিশেষ নজর দিতে হবে। সিটি করপোরেশন বা পৌরসভার পরিছন্নকর্মীরা এখন এই কাজটা করতে পারেন। অন্যদিকে ব্যক্তিগত স্থাপনা বা বাসাবাড়ি পরিষ্কার-পরিছন্ন রাখার দায়িত্ব স্ব-স্ব মালিককে বাধ্যতামূলক করে দিতে হবে। যেহেতেু আমরা এখন বাসাতেই বেশি সময় ধরে থাকছি, তাই আমাদের প্রত্যেককে নিজ দায়িত্বে যার যার বাসা পরিষ্কার-পরিছন্ন রাখতে হবে। মশার লার্ভা যাতে আমাদের বাসায় বা আঙিনায় জন্ম নিতে না পারে, সেদিকে লক্ষ রাখতে হবে। শুধু সিটি করপোরেশন বা পৌরসভার ওপর নির্ভর করলে মারাত্মক ক্ষতি হয়ে যেতে পারে। মনে রাখতে হবে আমরা এখন কঠিন সময় পার করছি। ব্যক্তিগত প্রোটেকশন নেওয়া এখন খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং প্রাসঙ্গিকও বটে। আমরা আমাদের নিজেদের এবং আমাদের বাসাবাড়িগুলোকে নিজেরাই মশা থেকে সুরক্ষিত রাখতে আরো সতর্ক ও যত্নবান হতে পারি। বাসাবাড়িতে বেশি সময় থাকার কারণে এডিস মশা দ্বারা আমাদের আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেশি। করোনাকাল দীর্ঘ হলে এই সুযোগ আরো বাড়বে এবং ডেঙ্গুর ঝুঁকিও বাড়বে। মশা করোনাভাইরাস না ছড়ালেও ডেঙ্গু ঠিকই ছড়াবে। তাই আমাদের মশা থেকে সুরক্ষিত রাখতে বিশেষ ব্যবস্থা নেওয়া দরকার। তাই এ সময় ফুল-স্লিভস জামা পরিধান, ঘুমানোর সময় মশারি টানানো, দরজা-জানালায় নেট স্থাপন বা অপ্রয়োজনে না খোলা, বাজারের অপেক্ষাকৃত নিরাপদ রিপেলেন্ট ক্রিম, স্প্রে বা কয়েল ব্যবহার করা যেতে পারে।
মশার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে সরকার এ বছর আগাম ভাবতে শুরু করেছে। নিঃসন্দেহে এটা ভালো সংবাদ। প্রচার মাধ্যমগুলোকে যথারীতি সোচ্চার হতে দেখা যাচ্ছে। গত বছর প্রেস মিডিয়া ডেঙ্গু নিয়ে ব্যাপক কাভারেজ দিয়েছিল। তবে মশাকে সফলভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হলে মিডিয়াগুলোকে এখন থেকে আরো সোচ্চার হতে হবে। বিশেষ করে বৃষ্টির পানি জমতে না দেওয়া বা লার্ভা না জন্মানোর বিষয়ে জনগণকে অবিহিত করতে হবে এবং এ সংক্রান্ত খবর বেশি প্রচার করতে হবে। ডেঙ্গু পরিস্থিতি যেন ২০১৯ সালের মতো পুনরায় ভয়ানক হতে না পারে সে জন্য সবাইকে ঐক্যবদ্ধভাবে প্রচেষ্টা চালাতে হবে। সরকারের পাশাপাশি সাধারণ জনগণকেও একসঙ্গে মশাকে প্রতিরোধ করতে হবে। ডেঙ্গু ভাইরাস যেন এ বছর আগ্রাসী ভূমিকায় অবতীর্ণ না হতে পারে, এ জন্য আগাম মশা দমন ব্যবস্থাপনা জোরদার করতে হবে। করোনাকালে মশার সফল নিয়ন্ত্রণই পারে ডেঙ্গুকে প্রতিরোধ করতে।
লেখক : মশা গবেষক ও সহযোগী অধ্যাপক (কীটতত্ত্ব), পবিপ্রবি, বাংলাদেশ এবং ভিজিটিং সায়েনটিস্ট, এনাসটাশিয়া মসকিটো কন্ট্রোল, ফ্লোরিডা, যুক্তরাষ্ট্র