কেজরিওয়ালের রাজনৈতিক ভাবমূর্তি ও সম্মোহনশক্তি
দিল্লিতে আম আদমি পার্টির টানা তৃতীয় দফা বিজয় কেবল চমক তৈরি করেনি, নরেন্দ্র মোদির অপ্রতিরোধ্য বিজয়রথকেও থামিয়ে দিয়েছে। ইদানীং ধারণা করা হচ্ছিল, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও ক্ষমতাসীন বিজেপি দলের সভাপতি অমিত শাহর জুটি কেবল বিজয় লাভ করেই যাবে। তাঁদের পরাজিত করার মতো কোনো ব্যক্তিত্ব ভারতের রাজনীতিতে নেই।
কিন্তু দেখা গেল, এক নেতানির্ভর দল আম আদমি পার্টি তাদের সাদামাটা নেতা অরবিন্দ কেজরিওয়ালকে সামনে রেখে সহজেই বিজেপিকে পরাস্ত করেছে। নির্বাচনে প্রাণান্ত চেষ্টার পরও নিজেদের পরাজয় রুখতে পারেনি বিজেপি। অথচ এই ভোটে জিততে ক্ষমতাসীন দলের প্রভাবশালী নেতা ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ আয়োজন করেছিলেন পাঁচ হাজারের বেশি সভা। এমনকি অমিত শাহের পক্ষে শত শত বিজেপি নেতা ছুটেছেন দিল্লির অলিগলিতে। তবুও ফল অনুকূলে না আসার নেপথ্যের কারণ সাধারণের কাছে এখন পরিষ্কার হয়ে উঠেছে। ভোটের ফল প্রকাশের পর নীরব থেকে তিন দিনের মাথায় মুখ খুলেছেন অমিত শাহ। তাঁর বক্তব্য থেকেও কিছুটা পরিষ্কার হওয়া গেছে তাঁদের পরাজয় রহস্য।
অমিত শাহ ভারতের দিল্লির বিধানসভা ভোটে বিজেপির শোচনীয় ফলের দায় নিজের দলের নেতাদের কাঁধেই চাপিয়েছেন। সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন ইস্যুতে চলা আন্দোলন নিয়েও অমিত শাহর শঙ্কাসূচক বক্তব্য পাওয়া যায়। তিনি বলেন, শান্তিপূর্ণভাবে আন্দোলন করার অধিকার সবার আছে। তাঁর বক্তব্যে, বিজেপির বর্তমান হিন্দু জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক অবস্থানও পরাজয়ের অন্যতম ইস্যু হিসেবে সামনে এসেছে।
অন্যদিকে বিজেপির সাবেক সর্বভারতীয় সভাপতির মতে, দলের নেতাদের একাধিক উসকানিমূলক মন্তব্যের জন্যই দিল্লিবাসী হয়তো বিজেপি থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন। বিজেপিকে উড়িয়ে দিয়ে পরপর তিনবার দিল্লির মসনদে বসেছেন অরবিন্দ কেজরিওয়াল। প্রসঙ্গ উঠেছে, কেজরিওয়ালের হাতে আর কী ম্যাজিক আছে এই বিজয়ের নেপথ্যে। দিল্লি বিধানসভা নির্বাচনকে কেন্দ্র করে গোটা ভারতবর্ষের মানুষের ভেতর যে আগ্রহ ও উত্তেজনা তৈরি হয়েছিল, তেমনটা সাম্প্রতিক ভারতের কোনো বিধানসভা নির্বাচনকে ঘিরে তৈরি হতে দেখা যায়নি। এ রকম একটি পরিস্থিতির ভেতর ভারতের সংবিধানের ৩৭০ নম্বর ধারা, ৩৫-এর ‘এ’ ধারার অবলুপ্তির পর কেবল ধর্মীয় মেরুকরণকে সম্বল করে নাগরিকপঞ্জির নামে, নাগরিকত্ব আইন সংশোধনের নামে মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষকে ভারতের নাগরিকত্ব থেকে বঞ্চিত করার যে ষড়যন্ত্র চলছে, সে পরিপ্রেক্ষিতে দিল্লি বিধানসভা নির্বাচনটি ছিল গোটা ধর্মনিরপেক্ষ শিবিরের কাছে অগ্নিপরীক্ষা। সেই পরীক্ষার ফল এখন জনগণের হাতে।
এই ফলাফলের নেপথ্য কার্ড হিসেবে উন্নয়ন ইস্যুকেই অন্যতম হিসেবে ধরা যায়। বিনামূল্যে বিদ্যুৎ ও জল দেওয়া। রাস্তা নির্মাণ। হাসপাতালের পরিষেবা। স্কুল নির্মাণ। নারীর জন্য বাসে যাতায়াতের ফ্রি পরিষেবা। এ ছাড়া সব ক্ষেত্রে নাগরিকদের সামাজিক জীবনের উন্নয়ন, নিরাপত্তা ও সেবা কর্মসূচির প্রাপ্তিকে গুরুত্ব দিয়েছেন তিনি। এই উন্নয়ন অস্ত্রে কেজরিওয়াল এতটাই জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন যে তাঁকে কোনোভাবেই হার মানানো সম্ভব হয়নি।
অথচ কয়েক মাস আগে অনুষ্ঠিত জাতীয় নির্বাচনে দিল্লির সব আসন বিজেপি কুক্ষিগত রাখতে পেরেছে। এতে দেখা যাচ্ছে, জাতীয় রাজনীতির হিসাব ও স্থানীয় রাজনীতি বিবেচনার মধ্যে পার্থক্য করছেন ভোটাররা। এখন দেখার বিষয় হলো, নাগরিক চেতনা ধর্মীয় চেতনার চেয়ে কতটা গুরুত্ববহ হয়ে উঠতে পারে। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার উন্নয়নের জন্য এটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সামগ্রিক বিবেচনায় বিজেপির উত্থান ও মোদি-অমিত শাহর অপ্রতিদ্বন্দ্বী ক্ষমতার জেরে ভারতবর্ষে গণতন্ত্রের ঐতিহ্য নষ্ট হতে চলেছে। এই ধারা প্রতিরোধ করে পুনরায় বহুত্ববাদী, ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক রাজনীতির বার্তা ফিরিয়ে আনতে হলে রাজনীতির মাঠে কেজরিওয়ালের মতো আম আদমির নেতার ক্যারিশম্যাটিক সাফল্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। রাজনীতিতে যখন ক্ষমতার দাপট ও ঔদ্ধত্যের পরাক্রম চলে, তখন কোনো নেতার সাদামাটা চালচলন ও বিনয়সুলভ কথাবার্তা একটি ভিন্নধারার প্রবণতা তৈরি করেছে। যেকোনো রাজনৈতিক ব্যবস্থাতেই কেজরিওয়ালের এমন রাজনৈতিক ভাবমূর্তি এবং সম্মোহনী গুণ উদাহরণ হিসেবে বিবেচিত হতে পারে।
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়