প্রেয়সীকে বিয়ের প্রস্তাব দিতে না পেরে মন খারাপ আকাশের
গোধূলি পেরিয়ে রাত ভারী হতে চলেছে। আকাশীর খুব অস্থির লাগছে। ঘরের কোথাও মন বসছে না। একটু পরপর চোখ রাখছেন মুঠোফোনের পর্দায়। কখনও মেসেঞ্জারে ঢুঁ মারেন, কখনও মুঠোফোনের বার্তাকক্ষে। অভিমানের সুরে আকাশী ভাবতে থাকেন—কী এমন হয়, একবার খোঁজ নিলে? ফোনটিই বা বন্ধ রাখতে হবে কেন? আকাশের জন্য খুব চিন্তা হচ্ছে আকাশীর। বড্ড মন খারাপ তাঁর।
সে বেশ আগের কথা, হঠাৎ এক বৃষ্টিভেজা দুপুরে মুখোমুখি দেখা ওঁদের। শুভ দৃষ্টিটা তখনই সেরে নেন দুজন। কমিউনিটি সেন্টারের সামনে গিয়ে দাঁড়ান আকাশী। চুল গড়িয়ে বৃষ্টির জল ঝরছিল তাঁর। আকাশ অপলক দৃষ্টিতে এ দৃশ্য উপভোগ করছিলেন। বৃষ্টিতে পাঞ্জাবি ভিজে যাচ্ছিল, কিন্তু সেদিকে নজর ছিল না আকাশের। একে একে দুজনই প্রবেশ করেন ধানমণ্ডি লেকের পাশের কমিউনিটি সেন্টারে। স্পর্শী আর হৃদয়ের বিয়ের অনুষ্ঠানের অতিথি দুজনই।
ছলে-বলে-কৌশলে আকাশ বারবার তাকাচ্ছিলেন আকাশীর দিকে। নীল শাড়িতে আকাশীর ছিল লাজমাখা হাসি। ছেড়ে দেওয়া লম্বা চুলের বাহার। মুগ্ধতায় ভাসছিলেন আকাশ। বেশ খানিকটা সময় এভাবেই চলতে থাকে। একবার কথা বলতে খুব মন চাচ্ছিল আকাশের। কিন্তু, ইতস্তত বোধ হচ্ছিল। আকাশী যদি কিছু মনে করেন, তা নিয়ে চিন্তিত আকাশ। তবে, এসব নিয়ে যত চিন্তা করছিলেন; কথা বলার আগ্রহ ততই বাড়ছিল। বিয়ের আয়োজনে মন ছিল না আকাশের। সব নজর ওই নীল শাড়িওয়ালির দিকে!
এবার আর সাত-পাঁচ না ভেবে আকাশীর পাশে দাঁড়িয়ে আকাশ বলে ওঠেন, ‘এই যে হ্যালো, শুনছেন?’ মিষ্টি হাসিতে আকাশীর উত্তর, ‘আমাকে বলছেন?’ অনেকক্ষণ চোখাচোখির পর এই প্রথম কথা তাঁদের। পরিচয়পর্বের মধ্য দিয়ে আরও কিছু কথা হয় ওঁদের। আকাশ চাকরি করেন। আকাশী বিশ্ববিদ্যালয়-পড়ুয়া। এভাবে কথার ছলে গল্প জমে, জন্ম হয় ভালো লাগার। এভাবে গল্পসল্পের ভেতরে তাঁরা একই টেবিলে মুখোমুখি হয়ে খেতে বসেন। মনে হচ্ছিল, দুজনই বেশ রোমাঞ্চিত। চোখে হাসি ঝরছে। নজরকাড়া দৃষ্টি যাকে বলে! এভাবে খাওয়াপর্ব শেষ করেন তাঁরা।
খাওয়া শেষে আনুষ্ঠানিকতা সেরে বিকেলে ধানমণ্ডি লেকে গিয়ে বসেন তাঁরা। বাদাম, চা, ফুসকার সঙ্গে জমে গল্পও। এর ফাঁকে ফেসবুকে বন্ধুত্বের সূত্রপাত। বিকেল গড়িয়ে তখন প্রায় সন্ধ্যা। এবার বিদায়ের পালা। আকাশীর ফিরতে হবে, এ কথা শুনে মন ভারী হয়ে ওঠে আকাশের। যাওয়ার সময় আকাশী বলেন, ‘ঘড়ির কাঁটা আজ বড্ড উদাসীন!’ এরপর নরম দৃষ্টিতে দুজন দুদিকে যাত্রা শুরু করেন।
বাসায় ফিরেই মেসেঞ্জারে আকাশের বার্তা, ‘যাঁর নীল শাড়িতে আমার চোখ আটকে আছে, তিনি কি নিজ কক্ষে পৌঁছেছেন?’ মিহি হাসির ইমো দিয়ে আকাশীর ফিরতি বার্তা, ‘লেকের শাপলা ফুলটি খুব আদুরে। আকাশী তার নিজ কক্ষে বসে একজনের ফেসবুকের সময়ক্রম ঘাঁটছে।’ এভাবে কথার পিঠে কথা জমে। চলতে থাকে কথোপকথন। ভোরের মিষ্টি আলো দেখে ঘুমাতে যান দুজন। এভাবে সময় গড়াতে থাকে, বাড়তে থাকে কথা; বাড়ে আন্তরিকতা।
নিয়মিত খোঁজখবর নেওয়া তাঁদের নিত্য কাজ হয়ে ওঠে। কে কোথায় যাচ্ছেন, কী করছেন; সবই তাঁরা একে অপরকে জানান। প্রেম-প্রেম ভাব! এভাবেই চলছে মাস আটেক। একে অন্যকে তাঁরা আপনি সম্বোধন করেন। কিন্তু, আন্তরিকতায় ঘাটতি নেই। খুব কাছের বন্ধুর মতো। দেখা-সাক্ষাৎ আর আড্ডাও চলে নিয়মিত।
আকাশ অনেকবার ভেবেছেন, তিনি আকাশীকে প্রেমের প্রস্তাব দেবেন। কখনও-সখনও বিয়ের প্রস্তাব দেওয়ার কথাও ভেবেছেন। কিন্তু, সাহস হয়ে ওঠে না তাঁর। অথচ, আকাশ কথাবার্তায় কিংবা আচার-আচরণে বেশ স্মার্ট ও সপ্রতিভ। কিন্তু, আকাশীকে বলতে গিয়েও ফিরে আসেন। যেন কথা জড়িয়ে আসে। গলা শুকিয়ে যায়। বুক দুরুদুরু করতে থাকে। আকাশী যদি রাজি না হন? এটাই যদি শেষ কথা হয়! কয়েকদিন আকাশীকে তিনি বলেছেন, ‘গুরুত্বপূর্ণ’ কথা আছে। আকাশীও গুরুত্বপূর্ণ কথা শুনতে উদগ্রীব। কিন্তু, আকাশ কোথায় যেন আটকে যায়। বলতে পারেন না। আকাশীও কী যেন বলতে চান, কিন্তু ‘না থাক, পরে বলব’ বলে কাটিয়ে নেন। হয়তো প্রেমের সেরা সৌন্দর্য এখানেই!
এমন পরিস্থিতিতে আজ আকাশীর মন খারাপ। দেখা হওয়ার কথা থাকলেও দেখা হয়নি। বিকেল থেকে আকাশের ফোন বন্ধ। খুব অস্থির লাগছে তাঁর। এখানে-সেখানে পাঁয়তারা করছেন আর মুঠোফোনের পর্দায় নজর রাখছেন। ২০ মার্চের দিবাগত রাত ১২টা পার হয়েছে। খোঁজ মিলছে না আকাশের। অথচ, আকাশী আজ অনেক আশায় ছিলেন, আকাশ তাঁকে বলেই বসবেন, ‘ভালোবাসি’। ঠিক রাত সাড়ে ১২টার দিকে ঘুম ভাঙে আকাশের। সারা দিনের ক্লান্তি নিয়ে সন্ধ্যায় ঘুমিয়ে পড়েন তিনি। মুঠোফোনেও চার্জ ছিল না। ছিল না বিদ্যুৎও। বিকেল থেকে ফোনটি বন্ধ।
ঘুম থেকে উঠেই জিভে কামড় খান আকাশ। ২০ মার্চ যে চলে গেছে! অথচ, আজ আকাশীকে বিয়ের প্রস্তাব দেবেন বলে ভেবে রেখেছিলেন। কিন্তু, ঘুমই তো ভাঙেনি! এসব ভেবে আকাশের খুব মন খারাপ হচ্ছে। আকাশের চোখ ছলছল করছে। হওয়ারই কথা, কত দিনের পরিকল্পনা ভেস্তে গেল তাঁর। রাতে আকাশীর সঙ্গে আকাশের কথা হলেও কাঙ্ক্ষিত সেই কথাটি আর বলা হয়ে ওঠেনি। সাহস হয়নি। শুধু আকাশ নয়, এমন পরিস্থিতিতে হয়তো অনেকেই পড়েছেন। জানাতে পারেননি মনের কথাটি। আর এ কারণেই হয়তো, দুজনার দুটি পথ দুটি দিকে গেছে বেঁকে!
ঠিক এমনই এক বাস্তবতা খুব কাছ থেকে দেখেছিলেন মার্কিন সাংবাদিক-সাহিত্যিক জন মাইকেল ও’লফলিন। হয়তো অনুভব করেছিলেন এই অনুভূতির গুরুত্ব। প্রেম বা বিয়ের প্রস্তাব দিতে দেরি হয়ে যেন অনন্তকাল একসঙ্গে পথচলার সম্ভাবনা নষ্ট না হয়ে যায়, তাই প্রপোজাল ডে বা প্রস্তাব দিবস নামে একটি দিবসের যাত্রা শুরু করেন। গতকাল ছিল ২০ মার্চ, ছিল প্রস্তাব দেওয়ার দিন। যাঁরা ঠিক আকাশের মতো দিনটি দ্বিধা ও বেভুলে হারিয়েছেন, তাঁদের জন্যই হয়তো কবি নির্মলেন্দু গুণের এই পঙ্ক্তি, ‘আবার যখনই দেখা হবে, আমি প্রথম সুযোগেই বলে দেব স্ট্রেটকাট : ‘ভালোবাসি’।
লেখক : সাংবাদিক