ভারতের নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন ও কিছু কথা
পুরো ভারতে নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনের (সিএএ) বিরুদ্ধে তুমুল আন্দোলন শুরু হয়েছে। এই আন্দোলনে শুধু মুসলমানরা নয়, বরং শিখ এমনকি হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকেরাও অংশ নিয়েছে। ভারতের স্বাধীনতা এনে দেওয়া সবচেয়ে বড় দল কংগ্রেস এ আইনের সম্পূর্ণ বিরোধিতা করেছে। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী ও তৃণমূল কংগ্রেসনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পদযাত্রা মিছিলের সঙ্গে দিল্লিতে কংগ্রেসের সোনিয়া ও প্রিয়াঙ্কা গান্ধীর চরম প্রতিরোধ জানান দিচ্ছে, মোদির এই আইন কতটা জনস্বার্থের কথা মাথায় রেখে করা।
সম্প্রতি আন্দোলনে অংশ নেওয়া মুসলিম ছাত্ররা যখন নামাজ পড়ছিলেন, তখন হিন্দু ও শিখ ছাত্ররা প্রতিরক্ষা ব্যুহ তৈরি করে তাঁদের আগলে রাখলেন। এই হচ্ছে বিগত শতাব্দীর ভারতের উদার সাম্প্রদায়িকতার প্রকৃত চিত্র। হিন্দু ধর্মাবলম্বী ছাত্রদের পাহারা দেওয়ার এ ঘটনা সমগ্র বিশ্বে আলোড়ন তুলেছে। মোদি ও অমিত শাহর শাসনের জনপ্রিয়তার ওপর এটি বিশাল আঘাতও বটে।
ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদকে মোদি-পূর্ব যুগে ভারতীয়তাবাদ বললে হয়তো খুব বেশি ব্যাকরণগত ভুল হবে না। কারণ, বিশ্বের সবচেয়ে বড় গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের তকমা নিয়ে ভারত সত্যিই উদার গণতন্ত্রের চর্চা করেছে দীর্ঘকাল। সে সময় ২৯টি রাজ্য আর ২২টি সাংবিধানিক ভাষার ওই দেশে কয়েক হাজার ছোট-বড় নৃগোষ্ঠী থাকলেও কেউ কারো ধর্ম বা মতামতের ওপর বড় ধরনের সহিংসতা চালাতে চায়নি বা পারেনি। যে কয়েকটি সংঘাত হয়েছে, তা-ও হিন্দুত্ববাদী দল বিজেপির ইন্ধনেই। বহু যুগের প্রচেষ্টার ফসল হিসেবে ভারত যে গণতান্ত্রিক শাসনে এসেছে, নরেন্দ্র মোদি তাতে সাম্প্রদায়িকতা দিয়ে ঢেকে দিচ্ছেন।
সিন্ধু সভ্যতা ধ্বংসের পর বৈদিকরা হিন্দুকুশ পর্বত পেরিয়ে এশিয়া মাইনর থেকে ভারতে এসে নিজেদের ঘাঁটি গেঁড়েছিলেন খ্রিস্টজন্মের আনুমানিক দেড়-দুই হাজার বছর আগে। বেদের অনুসারী এই সেমেটিক আর্য গোষ্ঠী ব্রাহ্মণ, ক্ষৈত্রিয়, বৈশ্য ও শুদ্র নামে মানবসমাজকে চার ভাগে বিভক্ত করে শ্রেণিবৈষম্যের সৃষ্টি করে। সেখান থেকে ভারত দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়েই একবিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে বড় উদার গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের মর্যাদায় আসীন হয়। কিন্তু পপুলিজমের ঘোড়ায় চড়ে নরেন্দ্র মোদি ভারতের ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যেভাবে হিলারি ক্লিনটনকে বাদ দিয়ে ডোনাল্ড ট্রাম্পকে বেছে নেয়, তেমনি ভারতে মোদির অবস্থানও শক্ত হয়। পপুলিজমের এই জয়জয়কার বিশ্বজুড়ে নতুন সংঘাতের বার্তা দিচ্ছে।
আম আদমি পার্টির নেতা ও দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়াল এবারের লোকসভা ভোটের আগেই ভারতকে সাবধান করেছিলেন। বলেছিলেন, ‘এবার মোদি যদি প্রধানমন্ত্রী হন, তবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পদে আসবেন অমিত শাহ। তাহলে ভারত কী ভয়ংকর হবে, তা আপনারা কল্পনাও করতে পারবেন না।’ বাস্তবতা প্রমাণ করছে কেজরিওয়ালের বক্তব্যের সত্যতা। কিন্তু ভুলে গেলে চলবে না যে ভারত শুধু হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের দেশ নয়। প্রায় ২০ শতাংশ মুসলমান সে দেশে বাস করে। গড়ে যাঁদের হিন্দু হিসেবে ধরা হয়, তাঁরাও সবাই হিন্দু ধর্মাবলম্বী নন। এঁদের অনেকাংশ শিখ, জৈন বা প্রকৃতি-ধর্মের অনুসারী। হিন্দুদের মধ্যে বিরাট অংশ কংগ্রেস দলকে সমর্থন করেন, এঁদের অনেকেই আবার গান্ধীর অহিংস মতে বিশ্বাসী।
১০ ডিসেম্বর ২০১৯ নাগরিকত্ব সংশোধনী বিলটি সংসদের নিম্নকক্ষ লোকসভায় পাস হয়। আর ১১ ডিসেম্বর সংসদের উচ্চকক্ষ রাজ্যসভায়ও পাস হয়। ১২ ডিসেম্বর রাষ্ট্রপতি বিলটিতে স্বাক্ষর করলে সেটি আইনে পরিণত হয়। নতুন নাগরিকত্ব আইন অনুসারে ২০১৪ সালের ৩১ ডিসেম্বরের আগে প্রতিবেশী তিন দেশ বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও আফগানিস্তান থেকে আসা নির্যাতিত হিন্দু, শিখ, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান শরণার্থীরা টানা পাঁচ বছর ভারতে বসবাস করলেই তাঁরা নাগরিকত্ব পাওয়ার অধিকার রাখবেন। কিন্তু মুসলিমদের নাগরিকত্ব দেওয়া নিয়ে কোনো কথা বলা হয়নি। রাজ্যভিত্তিক পঞ্জি, জেলা পঞ্জি, উপজেলা বা মহকুমা পঞ্জি ও স্থানীয় পঞ্জি নামে চারটি স্তরে ভারতীয় এনআরসি বিভক্ত। এ আইন ১৯৪৮ সালে জাতিসংঘের সর্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণা এবং ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। একই সঙ্গে ১৯৭৩ সালের আন্তর্জাতিক বর্ণবৈষম্য কনভেনশনের সঙ্গে চূড়ান্ত সাংঘর্ষিক। ২০১৯ সালে এসে মোদি সরকার আবার ১৯৪৭ সালের দ্বিজাতিতত্ত্বের মতোর ধর্মীয় বিভাজন রেখে আইন প্রণয়ন করবে; সেটি আধুনিক ভারতে কী করে সম্ভব।
লেখক : প্রাবন্ধিক