আন্তর্জাতিক
যে কারণে অভিশংসন ট্রাম্পের জন্য শুভ হতে পারে
গণমাধ্যমের শিরোনাম দেখে অনেকেই মনে করছেন, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প হয়তো বা ক্ষমতাচ্যুত হয়েছেন। সাধারণভাবে আমরা সেটিই জানি যে পার্লামেন্টে অভিশংসিত হলে প্রেসিডেন্ট ক্ষমতাচ্যুত হন। আর সে কারণেই মনে করাটা স্বাভাবিক যে ডোনাল্ড ট্রাম্প অভিশংসিত হয়েছেন, বিধায় তিনি ক্ষমতাচ্যুতও হয়েছেন। কিন্তু মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে অভিশংসিত করেছে মার্কিন পার্লামেন্ট তথা কংগ্রেসের নিম্নকক্ষ প্রতিনিধি পরিষদ। তবে ক্ষমতাচ্যুত হননি তিনি। কারণ সংবিধান অনুযায়ী, এখন তাঁকে উচ্চকক্ষ সিনেটে তাঁর অভিশংসন নিয়ে বিচারকাজ শুরু হবে। সেখানে তাঁর অভিশংসন নিয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে হবে। সেখানে তিনি দোষী সাব্যস্ত না হলে অভিশংসন প্রক্রিয়ায় প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বিজয়ী হবেন। রিপাবলিকান পার্টি থেকে নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ইউক্রেনকে দেওয়া যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় ৪০ লাখ ডলার সামরিক সহায়তা আটকে রেখেছিলেন। এ ছাড়া তিনি ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির জেলেনস্কিকে হোয়াইট হাউসে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। এ দুটি ঘটনায় তিনি তাঁর রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী ডেমোক্র্যাট, সাবেক প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের বিরুদ্ধে দুর্নীতির তদন্ত করতে ইউক্রেনকে চাপ দিয়েছিলেন। এ বিষয়ে ডেমোক্র্যাটদের অভিযোগ, এর মধ্য দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে সামরিক সহায়তা ব্যবহার করে প্রেসিডেন্ট তাঁর ক্ষমতার অপব্যবহার করেছেন।
ট্রাম্পের অভিশংসন নিয়ে অভিবাসী ও ডেমোক্র্যাটদের মধ্যে একধরনের উল্লাসভাব দেখা দিলেও শ্বেতাঙ্গ আমেরিকানদের অনেকেই মনে করছেন, সবই রাজনৈতিক বৈরিতা। ট্রাম্পের সমর্থকরা তাঁর প্রতি আরো উৎসাহী হয়ে উঠেছেন। প্রতিনিধি পরিষদে ১৮ ডিসেম্বর অভিশংসন প্রস্তাব পাস হয়েছে। ১৯ ডিসেম্বর মার্কিন সংবাদমাধ্যম সিএনএনের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ট্রাম্পকে অভিশংসিত করার পর বিরোধী ডেমোক্র্যাটরাই ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে। ওই বিশ্লেষণে আরো বলা হয়, ‘ক্ষমতার অপব্যবহার ও কংগ্রেসের কাজে বাধা দেওয়ার কারণে ট্রাম্পকে অভিশংসিত করা হয়েছে। কিন্তু বিভিন্ন সাক্ষ্য-প্রমাণে দেখা যাচ্ছে—প্রকৃতপক্ষে এই অভিশংসন প্রক্রিয়া রাজনৈতিকভাবে ট্রাম্পকেই সাহায্য করতে পারে।’ সিনেটে অভিশংসনের বিষয়টি নিয়ে কার্যক্রম শুরু হতে পারে আগামী বছরের শুরুতে, সেখানে সিনেটররা সিদ্ধান্ত নেবেন ট্রাম্পের ভবিষ্যৎ কী হবে। এরই মধ্যে অনেক সিনেটর ট্রাম্পের প্রতি নিজেদের আনুগত্যের বিষয়টি স্পষ্ট করেছেন।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে কোনো প্রেসিডেন্টই বাস্তবে অভিশংসিত হননি; ট্রাম্পের হওয়ারও সম্ভাবনা নেই। অনেকেই ধারণা করছেন, অভিশংসনের পুরো প্রক্রিয়া ট্রাম্পের জনপ্রিয়তা আরো বাড়াবে। এর আগে গত শতকে সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট অ্যান্ড্রু জনসন ও বিল ক্লিনটনও নিম্নকক্ষে অভিশংসিত হয়েছিলেন। তবে দুজনেই সিনেটে পার পেয়ে যান। ফলে ধারণা করা হচ্ছে, ট্রাম্পের ক্ষেত্রেও একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটতে পারে। কারণ, সিনেটের নিয়ন্ত্রণ রয়েছে তাঁর নিজ দল রিপাবলিকান পার্টির হাতে। এ কারণে খুব ন্যায্যভাবেই মনে করা হচ্ছে, এই ট্রাম্পই আগামী নির্বাচনে ব্যাপকভাবে বিজয়ী হয়ে আসবেন। এমনকি অনেক বিশ্লেষক ও গবেষক মন্তব্য করেছেন, এই প্রক্রিয়ার ফলে তাঁর জনপ্রিয়তা আরো বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
সিনেটে অভিশংসন প্রক্রিয়া নিয়ে সাধারণ নিয়ম আছে। হাউস প্রসিকিউটর এবং হোয়াইট হাউসের কাউন্সিল এবং কোনো প্রত্যক্ষদর্শীসহ উভয় দলের আইনপ্রণেতাদের বক্তব্য শোনার পরে পুরো একটি দিন নির্ধারণ করা হয় বিতর্কের জন্য। তারপর অভিযোগের ওপর ভোট হয়। যদি তাতে দুই-তৃতীয়াংশ আইনপ্রণেতা প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দেন, তাহলে প্রেসিডেন্ট অভিযুক্ত হবেন এবং ক্ষমতা হারাবেন। যুক্তরাষ্ট্রের সিনেট ১০০ আসনবিশিষ্ট। এতে বর্তমানে রিপাবলিকানদের আসন আছে ৫৩টি। ডেমোক্র্যাটদের আসন আছে ৪৭টি। ফলে স্পষ্ট ধারণা করা যায়, সিনেটে রিপাবলিকানদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকায় রেহাই পাবেন ট্রাম্প। আর এখান থেকে রেহাই পেলে তাঁর পরবর্তী প্রেসিডেন্ট হওয়ার পথটি অধিকতর আলোকিত হয়ে উঠতে পারে। উল্লেখ্য, এরই মধ্যে সিনেটের সংখ্যাগরিষ্ঠ রিপাবলিকান দলের নেতা মিচ ম্যাককনেল আশ্বস্ত করেছেন, সিনেটের ভোটাভুটি ট্রাম্পকে ক্ষমতা থেকে সরানোর পক্ষে যাবে না। এমনকি তিনি স্পষ্ট ইঙ্গিত দিয়েছেন যে, এর ‘প্রতিশোধ’ তিনি ২০২০ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে নেবেন।
প্রকৃতপক্ষে ট্রাম্পের আমলে যতই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ঘটুক না কেন, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে বেকায়দায় ফেলতে তাঁর ক্ষমতা অপব্যবহারের এই বদনাম মার্কিন প্রেসিডেন্টের উত্তরসূরিদেরও বইতে হবে। আগামী দিনগুলোতে মার্কিন রাজনীতিতে যা-ই ঘটুক না কেন, ট্রাম্পের নাম লেখা থাকবে অভিশংসিত হওয়া অ্যান্ড্রু জনসন ও বিল ক্লিনটনের নামের পাশে। তবে ট্রাম্পের জন্য এমন অভিশংসনের মুখোমুখি হওয়ার বিষয়টি তাঁর নিজের জন্যই শুভ হিসেবে দেখা যেতে পারে। কারণ তাঁর মতো বিতর্কিত ও বহুল আলোচিত প্রেসিডেন্টের রাজনৈতিক জীবনে অভিশংসনের প্রক্রিয়ায় উত্তীর্ণ হয়ে নিজের অবস্থানকে দৃঢ় করার মাধ্যমে নিজেকে নির্দোষ সাব্যস্ত করার একটা সুযোগ পাচ্ছেন তিনি। আর সেই সুযোগটি তিনি কাজে লাগাতে পারবেন আগামী ২০২০ সালের নির্বাচনে।
কংগ্রেসের উচ্চকক্ষ সিনেটে অভিসংশন প্রক্রিয়ায় ট্রাম্প মুক্ত হওয়ার পর ২০২০ সালের নির্বাচন তাঁর জন্য বিশেষ সমর্থন হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। কারণ অভিশংসন বিতর্ক ওঠার আগে ২০২০ সালের নির্বাচনে একপ্রকার হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হওয়ার সম্ভাবনা ছিল। সে লড়াইটা আরো ট্রাম্পের পক্ষে যাওয়ার সুযোগ রয়েছে অভিশংসন প্রক্রিয়ায় ট্রাম্পের বিজয়ের মধ্য দিয়ে। এ প্রক্রিয়া না হলে হয়তো ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে তিনি ২০২০ সালের নির্বাচনকে ঘিরে এমন কিছু সিদ্ধান্ত নিতেন, যা ডেমোক্র্যাটদের আরো ক্ষতিগ্রস্ত করে তুলত।
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়