সমাজে সম্মানীয়, কিন্তু তাঁদের মানবেতর জীবন!

সাধারণ ছুটি বেড়েই চলেছে। জরুরি সেবায় নিয়োজিতরা দিনরাত অক্লান্ত পরিশ্রম করছে। অনেকে হয়তো মোটামুটি ঘরে বসেই বেতন পাবে, তবে দেশের ব্যক্তিমালিকানাধীন চাকরিজীবী-শ্রেণির একটি বিশাল অংশ আছে, যারা চাকরি হারানোর শঙ্কায় রয়েছে। ক্ষেত্রবিশেষে অনেকে চাকরি করে প্রায় দিনমজুরের মতো। প্রতিষ্ঠান খোলা থাকলে বেতন পায়, বন্ধ থাকলে পায় না। আবার অনেক প্রতিষ্ঠানে মাস্টাররোল (দিনমজুর) কর্মচারী রয়েছে, যারা প্রতিষ্ঠান খোলা না থাকলে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বেতন-ভাতা পায় না। এমন অসংখ্য বিষয় রয়েছে, যা এই লেখায় উল্লেখ করে শেষ করা যাবে না। করোনার প্রভাবে একটি বিশেষ শ্রেণির ব্যবসায়ী কিংবা কর্মজীবী ও পেশাজীবী রয়েছে, যারা কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত হলেও এখন পর্যন্ত খুব বেশি আর্থিক কষ্টে নেই। কিন্তু আমাদের দেশে এমন অনেকেই রয়েছে, যারা এখন পুরোটাই কর্মহীন হয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছে।
সারা দেশে যে ধরনের লকডাউন তৎপরতা চলছে, তাতে একটি বিষয় দৃশ্যমান এবং পরিষ্কার অনুভব করতে পারছি যে, গাড়িচালক, চায়ের দোকানদার, ফুটপাথের হকার, কৃষক-শ্রমিক, কুলি-মজুর, মিল-কারখানার কর্মী, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী; এমনকি কিছু কিছু মধ্যবিত্ত পরিবার জীবনধারণে হিমশিম খাচ্ছে। আবার আমাদের দেশে এমন মানুষও রয়েছে, যাদের জীবনযাপনের প্রকৃত ধরন সম্পর্কে প্রকৃত তথ্য সরকার কিংবা আমাদের কাছে নেই। একটু গভীরভাবে ভাবলে তাদের জীবন সম্পর্কে আমরা কিছুটা অনুভব করতে পারি। এটি নিশ্চিত যে, এমন দুর্দশাগ্রস্ত মানুষের কথা এই আকস্মিক দুর্যোগকালে সরকার যথাযথভাবে আমলে নিতে পারছে না।
বৈশ্বিক মহামারি করোনার ছোবলে দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো দীর্ঘসময় ধরে বন্ধ রাখা হয়েছে। প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকার কারণে শিক্ষার্থীদের বেতনও বন্ধ হয়েছে। বন্ধ রয়েছে এসব শিক্ষকের প্রাইভেট-টিউশন। ফলে কোনোভাবেই তারা উপার্জন করতে পারছে না। এসব প্রতিষ্ঠানে কর্মরতদের অর্থবিত্ত না থাকলেও সমাজে তারা শিক্ষক হিসেবেই সম্মানীয়। ফলে তারা না পারছে লাইনে দাঁড়িয়ে ত্রাণ নিতে, না পারছে মুখ ফুটে কাউকে কিছু বলতে। এ ছাড়া দেশের এই পরিস্থিতিতে চরম কষ্ট আর হতাশা নিয়ে সময় পার করছে শিক্ষিত বেকার যুবকরা। শিক্ষাজীবন শেষ করে তাদের টিউশনি বা পার্টটাইম চাকরি করে কোনোমতে জীবন চালালেও এখন তা বন্ধ হয়ে গেছে। এমন অবস্থায় সারা দেশে লাখ লাখ বেকার প্রায় দিশাহীন হয়ে পড়েছে। দিন পার করছে অর্ধাহারে কিংবা অনাহারে। অনেক শিক্ষিত বেকার, যারা টিউশনি করে বাড়িতে বৃদ্ধ বাবা-মা, পরিবার-পরিজনের খরচ জোগাত, তারা এখন অসহায়। এক কথায় বলা যায়, এই মুহূর্তে এসে তাদের জীবন থমকে গেছে।
একদিকে তাদের জীবনে অনিশ্চয়তা শুরু হয়েছে। অন্যদিকে চিন্তা কিংবা শঙ্কার কারণ হয়েছে এ জন্য যে দেশে বিদ্যমান এই মহামারিতে জাতীয়ভাবে যে ধরনের আর্থিক ক্ষতির সম্ভাবনা রয়েছে, তাতে কর্মসংস্থানের সংকট সৃষ্টি হলে এর প্রভাব তাদের উপরই পড়বে। ফলে বেকারদের আগামীর জীবন অনিশ্চয়তায় পড়তে পারে দীর্ঘ সময়ের জন্য।
সমাজে অনেক শিক্ষিত বেকার যুবক রয়েছে, যাদের অনেকে শিক্ষাজীবন শেষ করে কষ্ট করেও একটি চাকরি জোগাড় করতে পারেনি। আবার অনেকে সরকারি চাকরির চেষ্টা করতে করতে বয়স শেষ করে ফেলে এখন শুধু টিউশনি করে বা পার্টটাইম চাকরি করে কোনোরকমে দিন পার করে। তবে তাদের এখন চাকরি কিংবা টিউশনি কিছুই নেই। পরিবার থেকে অনেক টাকা ব্যয় করে পড়ালেখা করানোর কারণে এখন আর বাবা-মায়ের কাছে হাত পেতে কিছু নেওয়া সম্ভব নয়, সেই দরজাও বন্ধ হয়ে গেছে। বর্তমানে করোনার কারণে ঘরবন্দি হয়ে খেয়ে না খেয়ে অনেকে দিন কাটাচ্ছে। তাদের জন্য কেউ ত্রাণ দিচ্ছে না, লজ্জায় কারো কাছে হাত পেতে চাইতেও পারছে না তারা।
বিভিন্ন পরিপ্রেক্ষিতেই দেশ এখন নানাবিধ কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। একদিকে মানুষের জীবন বাঁচানো, অন্যদিকে অর্থনীতিকে টিকিয়ে রাখা। এই নানামুখী চ্যালেঞ্জের মধ্যে সমাজে শিক্ষিত, সম্মানীয় অথচ বেকার, এমন শ্রেণির মানবেতর জীবনের দিকে লক্ষ রেখে সরকারের উচিত প্রয়োজনীয় ও কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা, যাতে তাদের জীবনও রক্ষা পায়।
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়