আন্তর্জাতিক
তুরস্কে রাজনীতির ভবিষ্যৎ
তুরস্কের সংবিধান সংশোধনের জন্য জরুরি অবস্থার মধ্যে অনুষ্ঠিত গণভোটে তুমুল প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়যুক্ত হয়েছে ‘হ্যাঁ’ ভোট। জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান বলেন, ‘তুর্কি জনগণের এ সিদ্ধান্ত গ্রহণ আমাদের দেশের একটি ঐতিহাসিক মুহূর্ত।’ তবে রিপাবলিকান পিপলস পার্টিসহ (সিএইচপি) প্রধান দুই বিরোধী দল এ ফল মানতে নারাজ। তারা এ ফলকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে ৬০ শতাংশ ভোট পুনর্গণনার দাবি তুলেছে। এই ভোটের ফলে তুরস্কের প্রধানমন্ত্রীর পদ বিলুপ্ত হবে এবং ভাইস প্রেসিডেন্টের পদ সৃষ্টি হবে। মূলত প্রেসিডেন্টের হাতে চলে যাবে দেশটির গোটা শাসনব্যবস্থা। আর এটি কার্যকর হবে ২০১৯ সালের নভেম্বরের নির্বাচনের পর। তখন প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান পাঁচ বছর করে আরো দুই মেয়াদে নির্বাচিত হতে পারবেন। সব মিলিয়ে আগামী এক যুগ, অর্থাৎ ২০২৯ সাল পর্যন্ত তুরস্কের প্রেসিডেন্ট থাকতে পারবেন এরদোয়ান—এমনটিই নিশ্চিত হতে যাচ্ছে।
গণভোটের ফলাফলে স্পষ্ট যে, প্রেসিডেন্ট এরদোয়ানের নির্বাহী ক্ষমতা বাড়ানোই ছিল সংবিধান সংশোনীর মূল উদ্দেশ্য। এখন একচ্ছত্র ক্ষমতার অধিকারী হওয়া এরদোয়ানের সময়ের ব্যাপার মাত্র। এর মধ্যে যেগুলো ঘটতে যাচ্ছে সেগুলো হলো, মন্ত্রিসভার সদস্যসহ দেশটির শীর্ষ সরকারি কর্মকর্তাদের নিয়োগ, জ্যেষ্ঠ বিচারকদের বাছাই, নির্বাচন আহ্বান, পার্লামেন্ট বিলুপ্তি, জরুরি অবস্থা এবং বিদ্যমান প্রধানমন্ত্রীর পদ বিলুপ্ত ঘোষণা করা ইত্যাদি।
ধারণা করা যায়, এরদোয়ান প্রভূত ক্ষমতার অধিকারী হলে তিনি আরো কর্তৃত্বপরায়ণ হয়ে উঠবেন। বিশেষ করে এ মুহূর্তে শঙ্কা দেখা দিয়েছে যে ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) সঙ্গে তুরস্কের সম্পর্ক আরো ক্ষতিগ্রস্ত হবে। ইইউর সঙ্গে এক চুক্তির পর তুরস্ক সিরিয়া ও ইরাক থেকে ইউরোপ অভিমুখী অভিবাসনপ্রত্যাশীদের স্রোতের লাগাম টেনে ধরে। সম্প্রতি গণভোটের প্রচারণা নিয়ে ইউরোপের কয়েকটি দেশের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক নাজুক হওয়ার পর ওই চুক্তি পুনর্বিবেচনার হুমকি দিয়েছেন প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান। তিনি এখন ওই হুমকি বাস্তবায়ন করবেন বলে মনে হচ্ছে।
গত বছরের জুলাইয়ে এক ব্যর্থ অভ্যুত্থানের পর থেকে এ পর্যন্ত দেশটিতে প্রায় ৪০ হাজার ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করা হয় এবং এক লাখ ২০ হাজার ব্যক্তিকে চাকরিচ্যুত করা হয়। এরদোয়ান সরকারের এই দমননীতির কড়া সমালোচনা করেছে পশ্চিমা দেশগুলো ও অধিকার গোষ্ঠীগুলো। প্রায় এক শতাব্দী আগে তুরস্ক প্রজাতন্ত্র হওয়ার পর থেকে এর সংবিধানে আমূল পরিবর্তন ঘটতে যাচ্ছে। এরদোয়ান বলছেন, অভ্যুত্থান প্রচেষ্টার নয় মাস পর তুরস্কের নিরাপত্তায় চ্যালেঞ্জের বিষয়টি আমলে নেওয়া এবং অতীতের নাজুক পরিস্থিতি এড়ানোর প্রয়োজনেই এ পরিবর্তনগুলো দরকার।
গণভোটের প্রচারের সর্বশেষ একটি সমাবেশে এরদোয়ান বলেছিলেন, গণভোটে ‘হ্যাঁ’ ভোট বলিষ্ঠভাবে জয়ী হলে পশ্চিমারা একটি শিক্ষা পাবে। কাজেই তাঁর বক্তব্যে পরিষ্কার, পশ্চিমাদের সঙ্গে তুরস্কেও লড়াই অনিবার্য হয়ে যাচ্ছে। অনেক বিশ্লেষকের ধারণা, আধুনিক তুরস্কের ইতিহাসে এত বিভাজন আর কখনোই চোখে পড়েনি। এই ভোটে ‘হ্যাঁ’ জয়যুক্ত হলেও তুরস্ক অর্ধেক পরাজিত হয়েছে।
যদিও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে পরপর সন্ত্রাসী হামলা এবং সিরিয়া থেকে আসা লাখ লাখ উদ্বাস্তুর কারণে অশান্ত হয়ে উঠেছে তুরস্ক। পাশাপাশি মধ্যবিত্ত শ্রেণির ক্রমবর্ধমান অবস্থান, অবকাঠামোর উন্নয়নও হয়েছে চোখে পড়ার মতো। কাজেই এই ভালো-মন্দের মাঝখানে দেশটির ভবিষ্যৎ কোনদিকে যাচ্ছে, তা নিয়ে এখন ভাবার সময় এসেছে। তবে গণভোটের ফল প্রেসিডেন্টের ক্ষমতাকে পাকাপোক্ত কিংবা কর্তৃত্বপরায়ণ যা-ই করুক না কেন, বিশ্বশান্তি ও স্থিতিশীল পরিবেশ বজায় রাখতে এরদোয়ান এবং অন্য বিশ্বনেতাদের যথেষ্ট আন্তরিক হতে হবে। দ্বন্দ্ব কিংবা বিবাদ নয়, গঠনমূলক পরিবেশ তৈরির স্বার্থে আন্তরিক অবস্থানের কোনো বিকল্প নেই।
লেখক : সহকারী অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।