আন্তর্জাতিক
ট্রাম্প বনাম কিম ও কুড়াল যুদ্ধের কাহিনী

বিশ্বে বর্তমানে কমপক্ষে দুজন রসিক প্রেসিডেন্ট রয়েছেন। তাঁদের একজন হলেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প আর অন্যজন হলেন আমাদের এতদঞ্চলের উত্তর কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট কিম জং-উন । তাঁরা দুজনেই প্রায় প্রতিদিন হাসি-তামাশায় লিপ্ত হচ্ছেন। পরমাণু বোমা দিয়ে প্রায় প্রতিদিনই একে অন্যকে ধ্বংস করার কথা বলছেন।
এরই মধ্যে কিম একের পর এক ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা চালিয়ে যাচ্ছেন। গত ২৯ জুলাই কিম ঘোষণা করেছেন, বর্তমানে পরীক্ষিত আইসিবিএম দিয়ে উত্তর কোরিয়া যুক্তরাষ্ট্রের যেকোনো স্থানে আঘাত হানতে সক্ষম।
অন্যদিকে, উত্তর কোরিয়ার এই বেপরোয়া ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা ঝুঁকিপূর্ণ ও বিপজ্জনক বলে আখ্যায়িত করেছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। তাঁর মতে, এ ধরনের অপ্রয়োজনীয় পরীক্ষা উত্তর কোরিয়াকে—১. একঘরে করে দেবে, ২. অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল করে দেবে, ৩. দেশটির জনগণকে অন্যান্য সুবিধা থেকে বঞ্চিত করবে।
ট্রাম্প সাহেব মেক্সিকো, ইরান, সিরিয়া কিংবা অভিবাসী সমস্যা নিয়ে যত না গালভরা কঠিন কঠিন ইংরেজি শব্দ ব্যবহার করেন, তত কঠিন শব্দ তিনি চীন, রাশিয়া কিংবা উত্তর কোরিয়ার বিপক্ষে ব্যবহার করতে পারেন না। এ ক্ষেত্রে তিনি উত্তর কোরিয়ার জনগণের জন্য খুব ‘ফিল’ করেন। কিন্তু ইয়েমেনের শিশুদের গণডায়রিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার খবর, সিরিয়া কিংবা ফিলিস্তিনের জনগণের দুর্দশার খবর, আফ্রিকার হাড্ডিসার শিশুদের নিয়ে ট্রাম্প কিংবা তার দেশ যুক্তরাষ্ট্র ততটা চিন্তা করে না।
আর অন্যদিকে কিম সাহেব? ১৯৮৪ সালে জন্ম নেওয়া কিম মাত্র ২৭ বছর বয়সে বনে যান উত্তর কোরিয়ার শীর্ষ নেতা। একাধারে মাত্র কয়েক মিনিটেই তিনি বনে যান চেয়ারম্যান অব দ্য ওয়ার্কার্স পার্টি অব কোরিয়া, চেয়ারম্যান অব সেন্ট্রাল মিলিটারি কমিশন, চেয়ারম্যান অব স্টেট অ্যাফেয়ার্স কমিশন এবং সুপ্রিম কমান্ডার অব কোরিয়ান পিপলস আর্মি। ১৮ জুলাই ২০১২ সালে মাত্র ২৮ বছর বয়সে তিনি নিজেই নিজেকে মার্শাল পদবিতে ভূষিত করেন।
ক্ষমতা গ্রহণ করেই অনেকটা বাসর রাতে বিড়াল মারার মতো তিনি কিছু কর্মকাণ্ড ঘটিয়ে দিলেন। প্রথমটি হলো ১২ ডিসেম্বর ২০১৩ সালে তথাকথিত বিশ্বাসঘাতকতার জন্য তিনি তাঁর আপন চাচা জেং সং-থেককে প্রাণদণ্ড দিয়ে দেন। শুধু তাই নয়, ২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে তিনি তাঁর ভাই কিম জং-নামকে বিষ প্রয়োগে হত্যা করেন।
এবার দেখে আসি, কী হালচাল উত্তর কোরিয়ার আপামর জনসাধারণের। কিম তাঁর জনগণকে যেখানে মানুষ বলেই মনে করেন না, সেখানে তাদের মানবাধিকার নিয়ে চিৎকার করা বাতুলতা মাত্র। উত্তর কোরিয়ার বর্তমান জনসংখ্যা দুই কোটি ৫৪ লাখের একটু বেশি। সেখানে রয়েছে বলপূর্বক শ্রম, কথায় কথায় মৃত্যুদণ্ড এবং ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ। কিন্তু তারই মধ্যে রয়েছে প্রেসিডেন্ট অবিশ্বাস্য বিলাসবহুল জীবন। তাঁর ফুর্তির জন্য তো রয়েছে কিপ্পুমযো বা ‘প্লেজার স্কোয়াড’।
ওই দিকে আধুনিক ক্ষেপণাস্ত্র আঘাতের এত বড় কথা বলা হলেও ১৯৭৬ সালে মাত্র একটি গাছের মাথা কাটা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও উত্তর কোরিয়ার সৈন্যদের মাঝে কুড়াল, গেতি, বেলচা দিয়ে হাতাহাতির যুদ্ধ হয়েছিল। ঘটনাটি ঘটেছিল ১৮ আগস্ট ১৯৭৬ সালে। ইতিহাসে এটাকে অভিহিত করা হয় ‘এক্স মার্ডার ইনসিডেন্ট’ বা ‘হ্যাচেট মার্ডার ইনসিডেন্ট’ নামে।
কোরীয় উপদ্বীপ পূর্ব এশিয়ায় অবস্থিত, যা পূর্বে জাপান সাগর এবং পশ্চিমে পীতসাগর দ্বারা বেষ্টিত। এই উপদ্বীপের ঠিক মাঝামাঝি কোরীয় বেসামরিকীকৃত অঞ্চল বা ডিএমজেড অবস্থিত। এই ডিএমজেড বর্তমানে উত্তর কোরিয়া ও দক্ষিণ কোরিয়ার মধ্যে বাফার জোন হিসেবে কাজ করছে। ডিএমজেডের দৈর্ঘ্য ২৫০ কিলোমিটার এবং প্রস্থ ৪ কিলোমিটার। যদিও জোনটি উভয় পক্ষের পৃথক বেসামরিকীকৃত এলাকা হিসেবে বিবেচিত, তবুও এটা বিশ্বের সবচেয়ে ব্যাপক সামরিক উপস্থিতির এলাকা হিসেবে পরিগণিত। এই ডিএমজেডের পশ্চিম অংশে দুই দেশের নিরাপত্তা বাহিনীর প্রয়োজনে আলাপ-আলোচনার জন্য একটি জয়েন্ট সিকিউরিটি এরিয়া বা জেএসএ আছে।
জেএসএতে একটি পুল রয়েছে, যাকে বলা হয় ‘ব্রিজ অব নো রিটার্ন’। এই পুলটি ১৯৫৩ সালে কোরিয়ান যুদ্ধের পর নির্মাণ করা হয়, এই পুল দিয়ে যুদ্ধবন্দি বিনিময় হতো। বন্দিবিনিময়ের সময় তাকে সুযোগ দেওয়া হতো যে সে যেকোনো দেশেই বসবাস করতে পারে। কিন্তু একবার ব্রিজ পার হলে আর ফেরত আসা যাবে না। আর সে জন্যই এই ব্রিজের নামকরণ করা হয় ‘ব্রিজ অব নো রিটার্ন’।
এই ব্রিজের পাশেই ১০০ ফুট লম্বা একটি গাছ ছিল। এই গাছের ফলে জাতিসংঘ কমান্ড চেক পয়েন্ট ৩ থেকে পর্যবেক্ষণ পোস্ট ৫-কে দেখা যেত না। এই তুচ্ছ কারণে ১৯৭৬ সালের ১৮ আগস্ট যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনীর ক্যাপ্টেন আর্থার বনিফাস, প্লাটুন লিডার লেফটেন্যান্ট মার্ক ব্যারেট ও দক্ষিণ কোরীয় সেনাবাহিনীর ক্যাপ্টেন কিমের নেতৃত্বে ১১ সদস্যের সৈন্যবাহিনী কুড়াল নিয়ে ওই গাছটি কাটতে যায়।
আর তখনই সেখানে উপস্থিত হন উত্তর কোরীয় সেনাবাহিনীর অফিসার লেফটেন্যান্ট পাক চুল। সঙ্গে ১৫ জন সৈন্য। পাক চুলের মতে, এটা তাঁর নেতা কিম ওও সাং এই গাছ লাগিয়েছেন, প্রতিদিন পানি দিচ্ছেন এবং তার তত্ত্বাবধানেই এটা বড় হচ্ছে। একপর্যায়ে লেফটেন্যান্ট পাক চুল হঠাৎ করে বলে ওঠেন, ‘মার শালাদের।’ শুরু হয় গেতি, বেলচা ও কুড়াল দিয়ে হাতাহাতি, মারামারি। ফলে সংঘর্ষে দুজন যুক্তরাষ্ট্রের অফিসার নিহত হন। এই কর্মকাণ্ডের প্রতিশোধ হিসেবে আমেরিকানরা ২১ আগস্ট ১৯৭৯ সালে ‘অপারেশন পাউল বুনইয়ান’ পরিচালনা করে। পুরো দক্ষিণ কোরিয়া, জাপান ও প্রশান্ত মহাসাগরের সকল আর্মি যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হয়। মানে মশা মারতে কামান দাগানোর মতো। প্রায় ১০০ জন দক্ষিণ কোরীয় সৈন্য একযোগে গাছের মাথাটি কেটে ফেলে। জয়ের হাসি হেসে ভি চিহ্ন দেখিয়ে ব্যারাকে ফিরে আসে। তারপরই যুদ্ধ শেষ হয়ে যায়। আর এমনি করেই এতদঅঞ্চলে পরাশক্তিগুলো কাণ্ডজ্ঞানহীন কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হয়, যা তারা এখনো করছে।
লেখক : সাবেক সেনা কর্মকর্তা। বর্তমানে এআইবিএ, সিলেটে কর্মরত।