খোলা চিঠি
‘প্রিয় মুক্তিযোদ্ধা দাদা’
![](https://ntvbd.com/sites/default/files/styles/big_3/public/images/2017/12/22/photo-1513927536.jpg)
ত্রিশ লাখ শহীদের রক্তে রঞ্জিত রাজপথ আর আমাদের কাঙ্ক্ষিত মহান বিজয়। রক্তে ভেজা সেই সোনার বাংলার বিজয়ী লাল-সবুজের শুভেচ্ছা নিও। তোমাদেরই হাতে জন্ম নেওয়া বাংলাদেশের মানুষের অকৃত্রিম ভালোবাসা আর শ্রদ্ধায় ভালো আছো নিশ্চয় তোমরা। তোমরা ভালো আছো ভেবে আমিও ভালো আছি।
পর সমাচার, ২০ ডিসেম্বর আমার জন্মদিন ছিল। ঠিক গত বছর ২০ ডিসেম্বর তোমাদেরকে চিঠি লিখেছিলাম। আজ আবার লিখতে বসেছি কিছু আক্ষেপ আর ভারাক্রান্ত হৃদয়ের কথা জানাতে। আমার আব্বাজানের আব্বা, মানে আমার দাদা একজন শহীদ মুক্তিযোদ্ধা। শহীদ মনিরউদ্দীন মণ্ডল। এই পৃথিবীতে আমি তাঁকে লালন করি এবং তাঁর আদর্শের কথাই রক্তে মেশাই।
যাই হোক, যেহেতু আমার দাদা একজন মুক্তিযোদ্ধা, তাই সব জীবিত কিংবা শহীদ মুক্তিযোদ্ধাকে দাদা বলে সম্বোধন করলাম। ভুল হলে ক্ষমা করে দিও।
আজ খুব দুঃখ-ভারাক্রান্ত মন নিয়ে লিখতে বসেছি। কিছু প্রশ্নের উত্তর চাই আমার। আর কোথাও প্রশ্নগুলোর উত্তর পাইনি। তাই তোমাদের কাছে এসেছি। আচ্ছা দাদা, তোমরা কী কারণে জীবন দিলে মুক্তিযুদ্ধে? শোষণ, বঞ্চনা, লাঞ্ছনা থেকে মুক্তি আর স্বাধীনতা পেতেই কি তোমরা ৩০ লাখ মুক্তিকামী দামাল সন্তান অকাতরে উৎসর্গ করলে নিজেদের জীবন?
আচ্ছা দাদা, তোমরা কি দেশকে খুব ভালোবাসতে? দেশপ্রেমিকের বেশে সব সময় বাংলাদেশের মা, মাটি এবং বাংলার প্রকৃতিকে বুকে আগলে রাখতে চাইতে? তা না হলে কীভাবে সম্ভব এভাবে জীবন বাজি রেখে অধিকার আদায়ের সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়া? আচ্ছা, তোমরা কি খুব সাহসী ছিলে? নিশ্চিত মৃত্যু জেনেও কীভাবে তোমরা রক্ত দিয়ে পুরো দেশটাকেই পাকিস্তানিদের হাত থেকে মুক্ত করলে। আমরা তো তোমাদেরই রক্ত। ভয়াবহ কোনো পরিস্থিতিতে তোমাদের রেখে যাওয়া ওই রক্ত কি পারবে কখনো সত্যিকারের বাংলাদেশ গড়তে? সাহস দিও, শক্তি দিও।
আচ্ছা দাদা, কার মুক্তি চেয়েছিলে তোমরা? তোমাদের নাকি আমাদের? তোমরা তো ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ সন্তান হয়ে মরে গিয়েই মুক্তি পেয়েছ। কিন্তু আমরা কি মুক্তি পেয়েছি? আমরা কি প্রকৃত স্বাধীনতা পেয়েছি? আমরা কি তোমাদের রেখে যাওয়া এই দেশে স্বাধীনভাবে কথা বলতে পারি? হে স্বাধীন দেশের নির্মাতারা, তোমরা কি শুনতে পাও এই চিৎকার?
জানো দাদা, সবাই শুধু ক্ষমতার লোভে মুক্তিযুদ্ধের লেবাস লাগায়। মুখে মুক্তিযুদ্ধের কথা বললেও চিন্তা-চেতনায় লালন করে কীভাবে শোষণ করা যায়। কীভাবে সব ক্ষমতার মালিক হওয়া যায়। সবাই খচ্চর, মুখোশধারী। হোক আওয়ামীপন্থী, হোক সে বিএনপিপন্থী কিংবা অন্য মত-পথের ।
পৃথিবীর কোনো স্বৈরশাসক সম্ভবত আর বেঁচে নেই। কিন্তু ইতিহাস সৃষ্টি করে এ দেশের স্বৈরশাসক সাহেব এখনো বেঁচে আছেন এবং গলা লম্বা করে রাজনীতি করছেন।
সবাই ব্যক্তিকেন্দ্রিক বা দলগত সুবিধা নিতে ব্যস্ত থেকেছে। কাদা ছোড়াছুড়ি করে রাজনীতি করেছে। শাষণ করেছে, শোষণ করেছে। তবে এটাও কিন্তু সত্য, ১৯৭১ সালের পর থেকে এই পর্যন্ত যতগুলো ক্ষমতাসীন দল ক্ষমতার অপব্যবহার করেছে, সবারই কিন্তু চরম পতন হয়েছে। আগামীতেও হয়তো সেসব ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি হতে দেখা যাবে।
আচ্ছা দাদু, তোমরা তো গণতন্ত্রের জন্য জীবন দিয়েছিলে। আসলে কি গণতন্ত্রের অর্থে গণতন্ত্র আছে বাংলাদেশে? ছিল কখনো? সবাই শুধু গণতন্ত্র গণতন্ত্র করে চিল্লায়। কিন্তু আমি বলি, বাংলাদেশ তো এখনো পরিবারতন্ত্র থেকেই বের হতে পারেনি।
সেই স্বাধীন বাংলাদেশের সূচনালগ্ন থেকে এ পর্যন্ত যতগুলো রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় এসেছে, সবাই একই পরিবার থেকে বারবার ক্ষমতাসীন প্রধান হয়েছে। তাদের প্রত্যেকের ভেতরে যেমনভাবে ছিল পরিবারতন্ত্র, ঠিক তেমনিভাবে স্বৈরতন্ত্র বিদ্যমান। আগামী ৫০ বছরেও এই পরিবারতন্ত্র আর স্বৈরতন্ত্র থেকে বাংলাদেশ মুক্তি পাবে, এটা এখনই ভাবা মুশকিল।
তাহলে কি বাংলাদেশ পরিবারতন্ত্রের যন্ত্রণা থেকে মুক্ত হতে পেরেছে? না, পারেনি। পারবে কি কখনো? বাংলাদেশ কি আর কোনো গ্রহণযোগ্য ব্যক্তির জন্ম দিতে পারেনি? পেরেছে হয়তো, কিন্তু তাদের টিকতে দেওয়া হয়নি। আর গণতন্ত্র! সে তো বহুত পরের কথা। আর ভালো লাগছে না দাদা, থাক এসব রাজনৈতিক বয়ান! সব মিলিয়ে আমরা ভালো নেই দাদা। আমরা কখনো ভালো থাকব না দাদা? তোমাদের সব অর্জন বৃথা যাবে?
জানো দাদা, আজকাল মুক্তিযোদ্ধাদের প্রসঙ্গ এলেই সবাই সার্টিফিকেটের কথা জানতে চায়। সেটাকে কাজে লাগিয়ে সব সুযোগ-সুবিধার কথা বলে। আমি খুবই বিব্রত হই। কিন্তু তাদের কীভাবে বোঝাব যে আমার শহীদ মুক্তিযোদ্ধা দাদার কথা মনে হলেই শিহরিত পরশে শরীরের লোমগুলো খাড়া হয়ে যায়। আমার কাছে যে সার্টিফিকেট শুধু একটা কাগজের মতো, আর কিচ্ছু না। তাঁদের কে জানাবে এই অনুভূতির কথা?
আমাদের রক্ত দিয়ে গড়ে উঠেছে জাতীয় পতাকা, পতাকার লাল অংশে আমাদেরই রক্তের ঢেউ খেলা করে। এর থেকে বড় পাওয়া আর কী হতে পারে বলো দাদা? এই ভালো লাগা আর ভালোবাসার কথা কে বোঝাবে এই প্রজন্মকে?
আর লিখতে পারছি না দাদা। চোখ টলমল করছে। এবার শুধু আমার শহীদ মুক্তিযোদ্ধা দাদাকে নিয়ে লিখতে চাই। ও দাদা, দাদাগো। কোথায় তুমি? শুনতে পাও তোমার ছেলে এবং তোমারদের পরবর্তী প্রজন্মের বুকফাটা চিৎকার? আচ্ছা মনিরউদ্দীন মণ্ডল তুমি কি জানো, তোমার একমাত্র সন্তান আর তোমার পরিবার কেমন আছে? কোনো দিন খোঁজ নিয়েছ? ১৯৭১ সালে যখন খানসেনারা তোমাকে যখন বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে মেরেছিল, তখন তোমার ছেলে মজনুর রহমানের বয়স মাত্র নয় মাস। তার কিছুদিন পরেই তোমার ছেলের মা ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে মারা যায়।
একজন শিশুর যদি মাত্র তিন বছর বয়সে তার রক্তের বলতে পৃথিবীতে আর কেউ না থাকে, তাহলে তার অবস্থা কী হতে পারে, এটা কল্পনা করতে পারো তুমি? তুমি চলে গেলে পৃথিবী ছেড়ে আর সবকিছু চলে যেতে শুরু করল তোমার ছেলের জীবন থেকে।
তুমি যখন বেঁচে ছিলে, তখন প্রায় দুইশ বিঘা জমি ছিল মনে আছে তোমার? তোমার শিশুসন্তান কিছু বুঝে ওঠার আগেই গ্রামের মানুষ সব ভাগবাটোয়ারা করে নিয়েছে তোমার ধন-সম্পত্তি, নিঃস্ব করেছে আমার আব্বাজানকে। আজও আমরা তাকিয়ে তাকিয়ে দেখি তোমার সব সম্পত্তি মানুষজনে ভোগদখল করছে।
যা গেছে যাক। আরো সব শেষ হয়ে যাক। এসব নিয়ে আমার কোনো আক্ষেপ নেই। বরং আমি গর্বিত, তুমি শহীদ মুক্তিযোদ্ধা বলে। জানো দাদা, তোমার একমাত্র এতিম সন্তানের আমি আর আমার ছোট ভাই ছাড়া এই পৃথিবীতে আজও তাঁর রক্তের বলতে কেউ নেই। কিছু না করো, কিছু না পারো অন্তত তোমার ছেলের খোঁজটা নিও।
অনেক অনেক ভালোবাসি তোমাদের। আজ রাখছি, কথা হবে এই বাংলার আকাশে-বাতাসে, পথ প্রান্তরে ।
ইতি
তোমাদের নাম-না-জানা এক দাদা!
লেখক : সাংবাদিক