সমসাময়িক
টাকা দিয়ে ইজ্জতের মাপ ও নতুন পে স্কেলে বৈষম্য
সরকারঘোষিত নতুন পে স্কেল পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও আমলাদের মধ্যে একটি বিশাল বিতর্কের জন্ম দিয়েছে, সহজ কথায় বিতর্কের সারাংশ হলো—আমলা বড়, না অধ্যাপক? আর এর মাপকাঠি হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে টাকার অঙ্ক। খুবই যৌক্তিক কারণে সম্মানকে টাকার সমানুপাতিক হিসেবে আমরা ভাবতে শিখেছি, প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছি। এটি ভোক্তা সমাজে আমাদের অগ্রগতির স্মারক। বারবারা ত্রুগ্যারের একটি বিখ্যাত শিল্পকর্মের মতোই আমাদের অবস্থা ‘আই শপ দেয়ারফর আই এম’। আমার ক্রয়ক্ষমতাই আমার ক্ষমতার স্মারক। অন্য কোনো ক্ষমতায় আমরা বিশ্বাসী নই। ফ্রান্সিস বেকনের যুগ অনেক আগেই তামাদি হয়ে গেছে। আমরা বৈধ অথবা অবৈধ পথে অর্থ উপার্জনের এক অশেষ প্রতিযোগিতায় নিজেদের ছুড়ে দিয়েছি। ফলত আমাদের দেশের প্রায় প্রতিটি সেক্টর কমবেশি দুর্নীতিগ্রস্ত, কারণ প্রত্যেকেই টাকা চিনেছি, টাকার প্রয়োজনীয়তা বুঝতে শিখেছি। এর পেছনে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার অবদান আছে এবং শিক্ষকদের অবদান সবচেয়ে বেশি, বিশেষত বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের অবদান অনেকটা প্রত্যক্ষ, কারণ স্কুল-কলেজ লেভেলে ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে টাকা-পয়সার সম্পর্কটা ঠিকঠাকমতো গড়েই ওঠে না।
আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো শাসন করে এখন বাণিজ্য অনুষদ। কলা অনুষদের পশ্চাৎপদতা সম্পর্কে সবাই ওয়াকিবহাল (যদিও মানুষের নাকি দুটি সত্তা—শরীর ও মন এবং এ দুই সত্তারই সুস্থতার প্রয়োজনে বাণিজ্য-কলা-বিজ্ঞানে যে দ্বৈতাদ্বৈত একীভবন সৌহার্দ্যের জরুরত ছিল, তা বিগত হয়েছে)। স্নাতক ছাত্রছাত্রীদের প্রথম পছন্দ বিসিএস এবং বিসিএসে প্রথম পছন্দ পুলিশ ও কাস্টমস। মেধাবী শিক্ষার্থীদের প্রথম পছন্দ পুলিশ ও কাস্টমস হওয়ার কারণ সম্পর্কে নতুন করে কিছু বলার নেই। এরা বিশ্ববিদ্যালয়ের চৌহদ্দিতে শিখেছে টাকাই সারকথা, বাকিসব ভাঁওতাবাজি। শিক্ষকদের দেখেছে সমিতির নামে ক্ষমতা চর্চার মাধ্যমে প্রতিপত্তি অর্জনে ব্যস্ত। বেতনের বাইরে বাড়তি অর্থ উপার্জনে শিক্ষক সমাজের প্রাণান্ত প্রচেষ্টা থেকে ছাত্রছাত্রীরা বুঝতে শিখেছে, অর্থই সকল সুখের মূল। নিয়মিত ক্লাসে অনিয়মিত হয়ে সান্ধ্যকালীন কোর্সের বিষয়ে শিক্ষকমহলের নিষ্ঠা ছাত্রছাত্রীদের মনে শিক্ষাগুরু সম্পর্কে অশ্রদ্ধার জন্ম দিয়েছে, দিয়ে যাচ্ছে। এরাই কেউ আমলা হয়ে শিক্ষক সমাজের টুঁটি চেপে ধরেছে, এটা আমাদের অর্জন (একজন নিম্নপদস্থ শিক্ষক হিসেবে আমিও এর অংশ)।
বিশ্ববিদ্যালয়ের সবচেয়ে মেধাবী ছাত্রছাত্রীরাই শিক্ষক হওয়ার সৌভাগ্য অর্জন করেন, তাঁরা অন্য যেকোনো পেশায় সবার চেয়ে আগে যাওয়ার যোগ্যতা রাখেন। এবং শিক্ষকতাকে একটি মহান পেশা মনে করেন বলেই অন্য অনেক আকর্ষণীয় পেশা বাদ দিয়ে নিজেকে শিক্ষা বিস্তারে নিয়োজিত করেন। শিক্ষকদের সম্মান যদি টাকার অঙ্কে নির্ধারিত হয়, সেটি নিশ্চিতভাবেই লজ্জাজনক, শিক্ষক-সমাজ-রাষ্ট্র সবার জন্য। শিক্ষকমহল তাদের সম্মান ফিরিয়ে দিতে বিবিধ কৌশলে সরকারের ওপর চাপ প্রয়োগের প্রচেষ্টায় আছে। সম্মান কি ফিরিয়ে দেওয়া যাবে? উত্থাপিত দাবিগুলো পূরণ হয়ে গেলেই কি সম্মান ফিরে আসবে? আজকে যাঁরা শিক্ষকদের অসম্মান করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, তাঁরা কি কোনো শিক্ষকেরই শিষ্য নন? এবং যাঁরা অবমাননার কথা বলছেন, তাঁরা ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্সি অথবা টাইমস্কেল ও সিলেকশন গ্রেডের মাধ্যমে কি সম্মানিত হতে পারবেন? এভাবে কি সম্মানিত হওয়া যায়?
বিশ্বব্যাংকের পরামর্শে ইউজিসির ২০ বছর মেয়াদি কৌশলপত্রের অভিলাষ অনুযায়ী পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে অভ্যন্তরীণ আয় বাড়িয়ে ক্রমান্বয়ে স্বাবলম্বী হতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের আয় বাড়ানোর একমাত্র পথ বেতন-ফি বৃদ্ধি করা, বিশ্ববিদ্যালয় নিশ্চয়ই অন্য কোনো ব্যবসা-বাণিজ্যে জড়ানোর সক্ষমতা রাখে না। বর্ধিত বেতন-ফি যারা দেওয়ার ক্ষমতা রাখবে, তারাই বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারবে। এ বিষয়গুলো অধিকাংশ শিক্ষক সমর্থন করেন, এমনকি যাঁরা অতিদরিদ্র পরিবার থেকে এসে মেধার যোগ্যতায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হয়েছেন, তাঁরাও। অথচ একই পরিমাণ ফি দিয়ে ভর্তি হতে হলে আমাদের অনেকেরই লেখাপড়া বন্ধ হয়ে যেত। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে স্বল্প খরচে পড়াশোনা চালিয়ে নেওয়া যায় বলেই আমাদের সংখ্যাগরিষ্ঠ দরিদ্র জনগোষ্ঠী সমস্যা না হয়ে সম্পদে রূপান্তরিত হতে পেরেছে, পারছে। আমাদের শিক্ষকসমাজের অদূরদর্শী অর্থকামিতা সেই পথ হয়তো অচিরেই রুদ্ধ করে দেবে। বিভিন্ন ট্রেনিং ও প্রকল্পের নামে প্রচুর অর্থের ছড়াছড়ি এখন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে। সম্মান নিয়ে যুদ্ধ নয়; এখন প্রয়োজন নীতি, আদর্শ ও দেশপ্রেমকে সামনে রেখে নিজের ওপর অর্পিত দায়িত্ব নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করা। আমাদের দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে অশিক্ষিত রাখতে পারলে উন্নত বিশ্ব খুব সহজেই তাদের বিষ্ঠা পরিষ্কারের কাজ করিয়ে নিতে পারবে। শিক্ষকমহলকে যথেষ্ট পরিমাণ অপদস্থ করা গেলে মেধাবী শিক্ষার্থীরা বিকল্প পথ বেছে নেবে। টাকার অঙ্ক অথবা সম্মানবিষয়ক বাড়তি বিতর্ক শিক্ষকের অবমাননাকে আরো প্রকট করে তুলছে। শিক্ষকদের সম্মান ফিরিয়ে দেওয়ার বিষয় নয় এবং সেটি টাকার সঙ্গেও সম্পর্কিত থাকার কথা নয়। আলাদা বেতন কাঠামো সময়োচিত প্রস্তাবনা, ক্ষমতা ও প্রতিপত্তিতে অন্ধ হয়ে যাওয়া আমলাদের সঙ্গে তুলনার প্রশ্নই আত্মমর্যাদার সঙ্গে সাংঘর্ষিক।
লেখক : সহকারী অধ্যাপক, চারুকলা বিভাগ, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়, ত্রিশাল, ময়মনসিংহ।