কোরবানির পশু
ভারতের গরু পাচার বন্ধে লাভবান কে
২০১৩ সালে সীমান্তের অবৈধ অর্থনীতি, বিশেষ করে কোরবানির ঈদের আগে অবৈধ গরুর বাজার দেখতে চাঁপাইনবাবগঞ্জের কয়েকটি সীমান্ত ঘোরার সুযোগ হয়েছিল। ফিরে এসে রিপোর্ট করেছিলাম, ‘৫০০ টাকায় বৈধ হচ্ছে ভারতীয় গরু।’ রিপোর্টটি ছিল এ রকম—চোরাচালানের গরুগুলো মালিকবিহীন অবস্থায় সীমান্তরেখার আশপাশ থেকে আটক করা হয়। এতে বৈধভাবে আমদানি না হওয়ায় কাস্টমস, বৈদেশিক মুদ্রা নিয়ন্ত্রণ ও আমদানি-রপ্তানি নিয়ন্ত্রণ আইন লঙ্ঘন হয়েছে। কাস্টমসের সংক্ষিপ্ত বিচারাদেশে এমন তথ্যই উপস্থাপন করা হয় রাষ্ট্রের অনুকূলে বাজেয়াপ্ত করা ভারতীয় গরু প্রসঙ্গে। অতঃপর নিলাম ডাকে মাত্র ৫০০ টাকায় বৈধতার ছাপ মেরে দেওয়া হয় প্রতিটি গরুর গায়ে।
এভাবেই চলছে সীমান্তে বাজেয়াপ্ত সম্পদের অর্থনীতি। ধর্মীয় বিধিনিষেধ ও রপ্তানি নিষিদ্ধ থাকলেও মূলত মুনাফার টানে ভারতের কৃষক ও চোরাচালান চক্র এ তৎপরতায় যুক্ত হয়।
আর্থিক সুবিধা পাওয়ায় এতে ভারতের ব্যবসায়ী, বাংলাদেশ সরকার, গরুর ক্রেতা-বিক্রেতা সবাই খুশিই ছিল। তবে ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিংয়ের গরু পাচার বন্ধের ঘোষণায় দুদেশের সম্পর্কে যেন নতুন ইস্যু যুক্ত হয়েছে।
ঘোষণার পরই বেড়ে গেল দেশে গরুর মাংসের মূল্য, সামনের কোরবানির ঈদে আশঙ্কা করা হচ্ছে গরু সংকটের। এর পরও এতে বাংলাদেশের কিছুটা হলেও বেশি সুবিধা হয়েছে বলে মনে হয়।
কারণ ঘোষণার পর গরু আসা বন্ধ হয়নি, বরং নতুন পথ খুলেছে, গরু আসছে। এ ছাড়া ভারতের সরকার না চাইলেও গরু পালনকারীরা নিজের প্রয়োজনেই বাংলাদেশে গরু পাচার করতে আগ্রহী।
এর ফলে প্রতিবেশী অন্য দেশ, বিশেষ করে মিয়ানমার থেকে গরু আসা শুরু হয়েছে। নেপাল, ভুটান থেকেও আসার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। তা ছাড়া এখন দেশে গরু পালন করে কৃষক কিছুটা হলেও লাভবান হবেন। কারণ, বাংলাদেশ ব্যাংক গরু পালনে যে কম সুদে ঋণ পাওয়ার ব্যবস্থা করেছে, তাতে সামনে গরু পালন কিছুটা হলেও বাড়বে বলে মনে হয়।
যা হোক, ভারতের পত্রিকা ‘টাইমস অব ইন্ডিয়া’ই বলছে যে, বিএসএফ যদি বাংলাদেশে গরু পাচার পুরোপুরি বন্ধ করতে সমর্থ হয়, তাহলে ভারত সরকারকে প্রতিবছর ৩১ হাজার কোটি রুপি অতিরিক্ত খরচ করতে হবে। কারণ স্বাভাবিক নিয়ম অনুযায়ী, একটি গরু মারা যাওয়ার পাঁচ বছর আগে থেকে দুধ দেওয়া বন্ধ করে দেয়। এতদিন এই গরুগুলোই বাংলাদেশে পাচার করত। কিন্তু এখন যদি সেটি বন্ধ হয়ে যায়, তাহলে এই গরুগুলোকে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত লালনপালন করে যেতে হবে এবং সে জন্যই এত বিশাল পরিমাণ অর্থ ব্যয় হবে।
ভারত সরকার কখনই চাইবে না, শুধু গরুর পেছনে অযথা এত ব্যয় করতে। এর চেয়ে পাচার করাই ভালো, নগদ লাভ, পাশাপাশি ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা। এর প্রভাবও এরই মধ্যে শুরু হয়েছে।
বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ জানিয়েছেন, আসন্ন ঈদে ভারত থেকে গরু না এলেও কোরবানির পশুর কোনো সংকট হবে না। তিনি জানান, দেশে কৃষকের ঘরে বিক্রির উপযোগী ৩৪ লাখ গরু-মহিষ ও ৭৯ লাখ ভেড়া-ছাগল রয়েছে, যা প্রস্তুত আছে কোরবানির জন্য। অন্যদিকে বাণিজ্য সচিব হেদায়েতুল্লাহ আল মামুন বলেছেন, ‘আসন্ন কোরবানির ঈদে পশু সংকটের কোনো আশঙ্কা নেই। চাহিদা অনুযায়ী ঘাটতি থাকা ১০ লাখ পশু আনা হবে অনানুষ্ঠানিক বাণিজ্যের মাধ্যমে।’
জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) ও বিজিবির হিসাব অনুসারে, ২০১৪ সালে গরু এসেছে ২০ লাখ ৩২ হাজার। ২০১৩ সালে আসে ২৩ লাখ ৭৪ হাজার। অর্থাৎ বাণিজ্য সচিব ১০ লাখ বললেও গরু শেষ পর্যন্ত অন্য দেশ থেকে ২০ লাখের বেশিই আসবে বলে মনে হয়। যদিও সরকারি হিসাবে প্রতিবছর কোরবানির গরুর চাহিদা তৈরি হয় সর্বোচ্চ ৪০ লাখ। বাকি চাহিদা ছাগল-ভেড়া ও মহিষের।
ভারতের গরু পাচার বন্ধের সিদ্ধান্তের ফলে বাংলাদেশই লাভবান হবে, কারণ নতুন দেশ থেকে গরু আসার সুযোগ তৈরি হয়েছে। গরুর সংকট হলেও সহসাই তা কেটে গেছে। গরুর জন্য ভারতের ওপর একক নির্ভরশীলতা কমে এসেছে।
তার পরও কি থেমে আছে ভারত থেকে গরু আসা? থেমে নেই। ঘোষণার পরও এই পাচার বন্ধ না হওয়ার পেছনে মূল কারণ ব্যবসা ও অর্থ। ঘোষণাটা রাজনৈতিক বক্তব্যের মতোই। অবশ্য এ ঘোষণার ফলে অবৈধ অর্থনীতির পরিবর্তে বৈধ ব্যবসা চালু হওয়ারও সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে।
বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের বাণিজ্য ঘাটতি মোকাবিলায় যে সীমান্ত হাটগুলোতে চালু হয়েছে, এসব হাটে গরু কেনাবেচা যুক্ত করার সুযোগ রয়েছে। বাংলাদেশ সরকার এ নিয়ে এরই মধ্যে কাজ শুরু করেছে বলে খবর পাওয়া যায়। এমন সিদ্ধান্ত হলে বৈধভাবে গরু দেশে প্রবেশের সুযোগ তৈরি হবে। সব মিলিয়ে বলা যায়, বাংলাদেশ ও ভারতের গরু রাজনীতিতে বাংলাদেশই লাভবান হচ্ছে।
লেখক : সংবাদকর্মী