শিক্ষকদের বেতনভাতা
মর্যাদা আপেক্ষিক হয়ে উঠছে কেন?
শিক্ষকের মর্যাদা, সম্মান- বিষয়টি নিয়ে সর্বত্র তুমুল বিতর্ক হচ্ছে। বিষয়টি আপেক্ষিক। কিন্তু যাদের নির্দেশনায় জীবনের ভালো-মন্দ বোঝার, এগিয়ে চলার, মাথা উঁচু করার, সর্বোপরি মানুষ হওয়ার প্রেরণা জুটবে সেই শিক্ষকের মর্যাদাটাও কি আপেক্ষিক? সেখানেও বিতর্ক? এ কেমন কথা? বিশেষ করে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষকের মর্যাদা কার ওপরে, কার নিচে এ নিয়ে বিতর্কের মাঝে অর্থমন্ত্রী আরেক কাঠি সরেস হলেন। বলে বসলেন, জ্ঞানের অভাবে শিক্ষকরা নানা দাবির আন্দোলন তুলেছেন। সব রাবিশ অবশ্য বলেননি। কিন্তু যা বলেছেন তা নিয়ে কিন্তু তার সমর্থনেও ফিসফাস চলছে। তাই সেটা আজ আপেক্ষিক হয়ে উঠেছে। কিন্তু কেন?
রাষ্ট্র অনেককেই অযাচিত উপাচার্য, উপ-উপাচার্য, প্রক্টর, সহকারী প্রক্টর, প্রভোস্ট, ভর্তি কমিটির হর্তা-কর্তা, আবাসিক শিক্ষক, নানা সংস্থার চেয়ারম্যান, কমিশনের সদস্য, সিনেটর করে লোভ জাগিয়ে দিয়েছে। রাষ্ট্র অনেকের চোখের ওপর পর্দা নামিয়েছে। রাষ্ট্র অনেকেরই উঁচু মাথা নামিয়ে দিয়েছে নানা কায়দায়। এমনকি, যে মানুষের শিক্ষক হওয়ার কথাই ছিল না, মেধাতালিকার কিনারা থেকে তুলে এনে রাষ্ট্র তাঁকে শিক্ষকও বানিয়ে ছেড়েছে।
আসলে এই কায়দা চলছে, দশকের ওপর দশক ধরে। সেই ফাঁদে, সেই লোভে পা দিয়ে মর্যাদা চলে গেছে। সম্মানিত কয়েকজন প্রিয় শিক্ষকের জন্য আমার কষ্ট হয়, বিশেষ করে যখন অর্থমন্ত্রী এমন কথা বলার পরও তা নিয়ে খুব বেশি প্রতিবাদ নয় বরং চারপাশে সমর্থনের ফিসফাস হয়। তবু এর তীব্র প্রতিবাদ এবং অধ্যাপকের মর্যাদা ফিরে পাওয়াটাই কাম্য।
গত দুদিন এটা নিয়ে লেখালেখি ও টেলিভিশন টকশোর আলোচকদের উত্তাপ অনুভব করেছি। টকশোতে শিক্ষক বাদে প্রায় সবার চোখ মুখে অর্থমন্ত্রীর মন্তব্যের ও মর্যাদার প্রশ্নটি এড়িয়ে যাওয়ার স্পষ্ট দর্শন!
আমার প্রথম পছন্দের একজন, সাংবাদিক আফসান চৌধুরী। কদিন আগেই এক টিভি চ্যানেলে তিনি বললেন, ‘পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা, ধরুন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের যত অর্জন সবই রাজনৈতিক। কিছু হলেই বলি, ৫২, ৬৯, ৭০, ৭১ ও এরশাদবিরোধী আন্দোলন। কিন্তু এই বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক অর্জন কতটুকু। কী আলোচনা আছে সেটা নিয়ে? কী করেছেন শিক্ষকরা?’
তাই তো। মনে মনে শিক্ষক খুঁজি। ভালো শিক্ষক। এখনকার ভালো শিক্ষক। পুরোনো কিছু নামই মনে হয় বারবার। আর মনে হয়, নীল, সাদা, গোলাপি রঙের কথা। আরো মনে হয়, প্রতিবছর গবেষণা খাতে বাজেটে বরাদ্দ কমে যাওয়ার পরিসংখ্যান। মনে হয়, বিশ্ববিদ্যালয় জার্নালে অন্তত গত ২০ বছরে যাঁরা যা লিখেছেন, তাঁর কতজন মন থেকে লিখেছেন আসলে। আর কতজন লিখেছেন পদোন্নতির পয়েন্ট পাওয়ার আশায়। মনে মনে গুনতে গুনতে, অবাক হই। আচ্ছা গত ১০ বছরে আমারই পরিচিত কমপক্ষে নয়জন শিক্ষক, প্রভাষকের, সহকারী অধ্যাপকের দেখা পাই না, যাঁরা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হওয়ার পর, বিদেশে চলে গেছেন, আর আসেন না। পরিসংখ্যান বলছে, ৩৭ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের এক হাজারের মতো শিক্ষকই বাইরে। তাঁদের কাছে মর্যাদা মানে ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হওয়ার কিছু কাগজপত্রই।
সাংবাদিক নাঈমুল ইসলাম খানের কথাও শুনলাম টিভিতে। তাঁর বক্তব্য- মর্যাদা কি আদায় করে নিতে হয়, নাকি সেটা এমনি এমনি চলে আসে। তিনি বললেন, সম্পাদকের মর্যাদা কী। কোন গ্রেডে আসবেন তাঁরা। আরেকজন প্রিয় সাংবাদিক বলেই ফেললেন অপ্রিয় কিছু কথা, শিক্ষকরা বাইরে গিয়ে যে টাকা কামান, যে ফাঁকি দেন তার হিসাব কোথাও পাওয়া যায় না। মর্যাদাটা এমনি এমনি আসে না। সজ্জন এই মানুষটির মনের ক্ষোভ বুঝি, কারণ উনি এভাবে কথা বলেন না।
মনে হয়, তাই তো শামসুন্নাহার হলে গভীর রাতে পুলিশ ঢুকে ছাত্রীদের ওপর নির্যাতন এবং ১৮ জন ছাত্রকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যাওয়ার পর কতজন শিক্ষক তাঁদের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। একজন সবেধন নীলমণি, অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদ। ওই রাতে হলের গেটে দাঁড়িয়ে দেখেছি, নীল ও সাদা শিক্ষকরা ঝগড়া করে চোখের সামনেই কীভাবে পুলিশ ডেকে এনেছিলেন। কীভাবে ঠিক হবে সেই মর্যাদা? শামসুন্নাহার হলের ঘটনার সময় যে শত শত সাদা শিক্ষক আনোয়ারউল্লাহ চৌধুরীকে আগলে রেখেছিলেন, তাঁদের মর্যাদা কীভাবে নির্ধারিত হবে? আশা করি তাঁরা সবাই এখন অধ্যাপকই। আবার ’৯৯ সালে যৌন নিপীড়নবিরোধী আন্দোলনের সময় জামালউদ্দিনের মতো নীল দলের শিক্ষকরা যেভাবে ছাত্রলীগকে লেলিয়ে দিয়েছিলেন সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর, তাঁরাও এখন সবাই অধ্যাপক।
কিন্তু মুদ্রার উল্টোপিঠেও অনেক কথা থাকে। শিক্ষক হিসেবে কি এসব মানুষের আলাদাভাবে বেড়ে ওঠার সুযোগ, ভাবনার জায়গা করে দিয়েছে রাষ্ট্র? রাষ্ট্র বরং তাঁকে বাধ্য করেছে গবেষণার বদলে দলাদলি করতে, যাতে তিনি কলোনিতে একটা বাসা পায়। রাষ্ট্র তাঁকে যুক্ত করেছে ভর্তি পরীক্ষা কমিটির সদস্য হতে, পরীক্ষকের তালিকায় নাম ওঠাতে, কারণ এ ছাড়া তাঁর সংসার চালানো সত্যিই কঠিন হয়ে পড়েছিল। এই কঠিন পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে রাষ্ট্র তাঁদের বাধ্য করেছে- একবার শেখ হাসিনার আবার খালেদা জিয়ার দলের পক্ষে বিবৃতিতে সই করতে। রাষ্ট্র কীভাবে গত ২০ বছরে লুডুর বোর্ডের সাপের মতো করে প্রভাষক থেকে হাজারো জনকে অধ্যাপক বানিয়ে দিয়েছে তা বুঝতে এখন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর টেলিফোন গাইডই যথেষ্ট। আবার রাষ্ট্র তাঁকে বিক্ষুব্ধ করেছে, অপ্রাপ্তি দিয়ে হতাশ করেছে, বাজারের হিসাব আর ব্যাগের বোঝা টানতে টানতে কষ্ট দিয়েছে। রাষ্ট্র একসময় তাঁকে দলাদলিতে লেলিয়ে দিয়েছিল বলে রাষ্ট্র এখন তাঁর মর্যাদা দিতে চাইছে না। অতএব পুরো বিষয়টি এখন আপেক্ষিক হয়ে পড়েছে।
তারপরও মর্যাদা প্রয়োজন। কারণ শিক্ষকের মর্যাদা যদি এভাবে ছেঁটে ফেলা শুরু হয়, তারপর এই রাষ্ট্রের অনাচারে যুক্ত হবে নতুন অধ্যায়, যেখান থেকে জাতি শুধু পেছনের দিকেই যেতে পারে। সামনে, ডানে, বায়ে আর কোথাও নয়। বাজি ধরেই বলা যায়, এখনো কিছু শিক্ষক আছেন, চোখের সামনে, যাঁরা কে কোন গ্রেডের কোনোদিন ভাবা হয়নি, এখনো তাঁদের সামনে গেলে দুই হাত একসঙ্গ নিয়ে মাথা নামায় অনেক রাঘব বোয়াল। রাষ্ট্রের উচিত এ ধরনের শিক্ষকের সহযোগিতায় আন্দোলনরত শিক্ষকদের কীভাবে ক্লাস রুমে ফেরানো যায়, কীভাবে সত্যিকারের শিক্ষক নিয়োগ হতে পারে উচ্চশিক্ষায়, কীভাবে শিক্ষক ফিরে পেতে পারেন মর্যাদা তার কাজ শুরু করা। এমনিতেই অনেক দেরি হয়ে গেল।
লেখক : সাংবাদিক