শিক্ষায় ভ্যাট
শিক্ষার্থীদের আন্দোলন যে কারণে যৌক্তিক
নগরব্যাপী গতকাল ছিল তীব্র যানজট, কারণ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের আন্দোলন। শিক্ষার্থীরা জমায়েত হয় ইস্ট ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে। সেখানকার যানজটের ধাক্কায় নগরীর অপরপ্রান্ত পর্যন্ত স্থবির হয়ে ছিল। তবু গতকাল বহু সহানুভূতিশীল কণ্ঠে শুনলাম ছাত্রদের আন্দোলনের প্রতি সমর্থন। অধিকাংশ মানুষ সব সময়ই নিজের সাময়িক অসুবিধার পরও ন্যায্য দাবিকে মেনে নেয়। রাজপথে যারা নেমেছে, সেই শিক্ষার্থীরা তো তাদেরই কারো ভাই, কারো বোন, কারো না কারো সন্তান।
শিক্ষার্থীদের ওপর বেপরোয়া বুলেট, লাঠিপেটা, কাঁদুনে গ্যাস প্রয়োগ করে সরকারও বুঝিয়ে দিয়েছে তারা কারো আত্মীয় নয়, বরং নিংড়ে টাকা বের করার ব্যাপারে তারা কতটা বেপরোয়া। নতুন প্রজন্মের শিক্ষার্থীরাও কাঁদুনে গ্যাসের ঝাঁজে চিনে নিচ্ছে রাষ্ট্রের চেহারা। বলা যায়, সাম্প্রতিককালে এই পরিচয়টা একটু ঘনঘনই হচ্ছে। এই পরিচয়পর্বের মধ্য দিয়েই হয়তো আসছে প্রজন্মের মোহভঙ্গ আর নতুন স্বপ্নের নির্মাণ পর্বের সূচনা ঘটবে।
২.
‘ভ্যাট দেব না, গুলি করো’ সস্তা কাগজে মোটা কালিতে লেখা এই সোজাসাপ্টা সংক্ষিপ্ত হুংকার তাদের নৈতিক শক্তির চূড়ান্ত বহিঃপ্রকাশ। পুলিশও গুলি করল! কিন্তু পারল কি ছেলেমেয়েগুলোকে পিছু হটাতে? বরং আজও তারা কর্মসূচি ঘোষণা করেছে। অন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও সেই অস্থিরতার ছোঁয়া লেগেছে। তারাও প্রস্তুতি নিচ্ছে নেমে পড়ার। আজ আরো বেশ কটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলেমেয়েরা রাস্তায় নেমেছে।
কেউ বলছেন, টাকাওয়ালার ছেলেমেয়েরাই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে যান। সরকার কিছু বাড়তি কর পেলে ক্ষতি কি?
এর উত্তরে আর কী বলা যায়; শঙ্খ ঘোষ যেমন বলেছিলেন, হেঁটে দেখতে শিখুন! একটা-দুটো ব্যতিক্রম বাদ দিলে অনেক বেশি অভাবী আর দুস্থ জীবন-যাপন করে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। তাদের থাকার জন্য ছাত্রাবাস নেই, বাড়ি ভাড়া গুনতে হয়। বিপুল অঙ্কের বেতনও গুনতে হয়। ডাইনিং-ক্যান্টিন নেই বলে খাবার খরচ বহুগুণ বেশি গুনতে হয়। অথচ এদের সংখ্যাগরিষ্ঠের পারিবারিক আয় সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মতোই। রাষ্ট্রের শিক্ষাব্যবস্থা করার অক্ষমতার অভাবে তারা একদফা কষ্ট এরই মধ্যে করছে- পয়সা দিয়ে কিনে উচ্চশিক্ষা অর্জনের চেষ্টা করে। এই অভাবী শিক্ষার্থীদের ওপর সাড়ে সাত ভাগ করের বোঝা চাপানোর মতো অন্যায় এবং অমানবিক কাজ আর কী হতে পারে!
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় বলে কেউ কেউ আন্দোলনে সমর্থন দিতে দ্বিধাগ্রস্ত। একদল বলছে, বিষয়টা আদর্শিক। শিক্ষাকে পণ্য মেনেই তারা ভর্তি হয়েছে। তাদেরকে বলি, এই শিক্ষার্থীরা শিক্ষার আরো পণ্যীকরণকেই প্রতিহত করার লড়াইয়ে নেমেছে। আপনাদের আদর্শবাদ সকল শিক্ষার্থীর জন্য শিক্ষার সুযোগ করে দিলে এদের তো বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তিই হতে হতো না। প্রাপ্যতার অভাবই শিক্ষাকে পণ্য করেছে। প্রাপ্যতার অভাবে পানিও পণ্য হয়, তার নাগালের বাইরে যাওয়া ঠেকাতে কি আপনি মাঠে নামবেন না?
শিক্ষার্থীরা যে রাজপথে নেমে পড়েছে, তা আকস্মিক নয়। অকারণ নয়। শিক্ষার্থীরা ময়দানে নেমেছে নিজেদের স্বার্থ আদায়ে, এমন মুহূর্তগুলোই আমাদের ইতিহাসের অন্য দিকগুলোতেও সুবর্ণ কাল নিয়ে এসেছে। কারণটা খুব পরিষ্কার। এই সব আন্দোলনেই শিক্ষার্থীরা ভাবতে শিখবে শিক্ষা কেন পণ্য হয়, কীভাবে হয়, শিক্ষা-স্বাস্থ্যের পণ্যীকরণের বিকল্প কী হতে পারে,! শুধু ভাবনা না, তাদের মাঝে নেতৃত্বগুণ বিকশিত হয়, নেতৃত্ব গড়ে ওঠে।
৩.
এই আন্দোলনের মাঝে সবচেয়ে সম্ভাবনাময় বৈশিষ্ট্যটি হলো বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের কিংবা দল-লীগের অনুপস্থিতি। ছাত্রাবাস দখলে রেখে, উপাচার্যদের-প্রক্টরদের ঘনিষ্ঠ বানিয়ে এবং প্রশাসনের ওপর সর্বত্র হুকুমদারি করে, টেন্ডারবাজি করে সারা দেশে সরকারি শিক্ষাঙ্গনগুলোকে দখলদারিত্বে রাখার যে প্রথা চালু আছে, সেটাই শিক্ষাঙ্গনে কোনো ইতিবাচক সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক তৎপরতা গড়ে ওঠার সবচেয়ে বড় প্রতিন্ধক। নানা কারণেই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সেই দায় থেকে মুক্ত। এর ফলে আমরা যেমন দেখেছি ঢাকা, রাজশাহী, জগন্নাথসহ নানা সর্বজনের বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র আন্দোলন দমনে শিক্ষার্থীদেরই একাংশকে ব্যবহার করা হয়, আর সেজন্যই সারা বছর রুটি-মাখন ছিটিয়ে সন্ত্রাসী বাহিনী পোষাও হয়। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের দমনে তাই সরাসরি ব্যবহার করতে হচ্ছে পুলিশ বাহিনীকে, সংগঠিত কোনো পঞ্চম বাহিনীর সহায়তা তারা এখানে খুব কমই পাচ্ছে।
৪.
এই বছরে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন বাড়ল। সর্বোচ্চ বেতনধারী পাবেন ৭৮ হাজার টাকা, সব মিলে পাবেন দেড় লাখের কাছাকাছি। পুরোপুরি কার্যকর হলে সর্বনিম্ন বেতনধারী পাবেন পাবেন আট হাজার ২৫০ টাকা, সব মিলে ১৫ হাজার টাকার কিছু কম! এই সংখ্যাগুলোর মাঝে যেমন একটা ভয়াবহ বৈষম্য আছে, সর্বনিম্ন পদধারীদের বেলায় এটা বড়জোর মুদ্রাস্ফীতি আর বাজারের সঙ্গে কোনোক্রমেই তাল মেলেনি, সর্বোচ্চ পদধারীরা পাচ্ছেন বিপুল পুরস্কার। তাঁদের সঞ্চয় আগের চেয়েও বাড়বে।
সেটা বাড়ুক। আমাদের খুব আপত্তি নেই। কিন্তু এর জন্য এ বছর যে ১৫ হাজার কোটি টাকা লাগবে, আগামী বছর লাগবে আরো প্রায় ২৪ হাজার কোটি টাকা, তা কোত্থেকে আসবে?
এই রাষ্ট্রে জর্দার মতো অগুরুত্বপূর্ণ শিল্পের মালিক এ বছর সবচেয়ে বেশি করদাতা। এর মাঝে হাসির কিছু নেই, আছে একটা নির্মম বাস্তবতা। এখানকার বড়লোকরা, ব্যবসায়ী-শিল্পপতিরা নামমাত্র কর দেন। বোঝাটা তাই যথাসম্ভব চাপিয়ে দেওয়া চলছে সাধারণ মানুষের ওপর। যে কারণে বিশ্ববাজারে তেলের দাম কমে অর্ধেক হলেও সরকার দ্বিগুণ দামে তেল বিক্রি করছে, সেই একই কারণে শিক্ষার ওপর বসানো হচ্ছে মূল্য সংযোজন কর। সচিবদের মোট বেতন দেড় লাখে পৌঁছাবে, তার ব্যয়টা কি জোগাতে হবে আমাদেরই? হলমার্ক আর্থিক কেলেঙ্কারিতে জড়াবে, তার পয়সাটাও আমরাই জোগাব, না কি? নির্মাণ উপকরণের ব্যয় প্রতিবছর কমছে, অথচ নানা প্রকল্পে ব্যয় দ্বিগুণ-তিনগুণ হচ্ছে, আসলে দিনেদুপুরে ডাকাতি হচ্ছে। সেই ডাকাতির ভর্তুকি তো কেউ না কেউ যোগাবে। শিক্ষার্থীরা বুঝতে শিখুক, রাষ্ট্রের প্রতিটা লুণ্ঠন আসলে তারই সম্পদ লুট, কোনোটা থেকেই সে নিজেকে শেষ পর্যন্ত রক্ষা করতে পারবে না। রাষ্ট্রের এই মৌলিক নীতিগত অবস্থানটা কী করে আগামীর তরুণরা চিনতে শিখবে, নিজেদের গায়ে আগুনের আঁচ না নিলে?
৫.
এমনকি সর্বজনের বিশ্ববিদ্যলয়গুলোতেও বেতন-ফি বাড়লে হাতেগোনা কিছু শিক্ষককে প্রতিবাদে শামিল হতে দেখা যেতো। এবার কিন্তু এই আড়মোড়া ভেঙেছে। শিক্ষকরা নিজেরাই তাঁদের মর্যাদা ও বেতনের দিক দিয়ে হুমকির সম্মুখীন হয়ে এসব বিষয়ে সোচ্চার হয়েছেন। তুলনামূলকভাবে বলা যায়, শিক্ষকদের দাবির প্রতি শিক্ষার্থীরা অনেক বেশি সহানুভূতিশীল, যেটা শিক্ষার্থীরা নিজেদের আন্দোলনে শিক্ষকদের দিক থেকে ততটা দেখেননি। তারপরও, দেশের বহু শ্রেণি-পেশার মানুষের রাস্তায় নামার এবং পরস্পরের প্রতি সহানুভূতিতে সিক্ত হওয়ার যে লক্ষণ দেখা দিয়েছে, সেটাই আগামী বাংলাদেশের পাথেয়। আমরা বহু দশক ধরে দেখেছি জনগণের ছত্রভঙ্গ দশা, শাসকরা একাট্টা। এবার বঞ্চনাই জনগণের বাকি অংশগুলোর মাঝে একাট্টা হওয়ার একটা নতুন সম্ভাবনা তৈরি করেছে। প্রশাসনিক আমলাদের বাইরেও এমনকি শিক্ষা-স্বাস্থ্যসহ অন্যান্য পেশার সরকারি কর্মকর্তারাও টের পাচ্ছেন একটা বিশেষ অংশের হাতে রাষ্ট্রের সবকিছু কুক্ষিগত করারই আয়োজন সম্পন্ন হতে চলেছে। এই বঞ্চনার বোধ সঞ্চারিত হয়ে জনগণের সকল অংশে, বিশেষ করে এ দেশের সবচেয়ে বঞ্চিত পো
মাক শ্রমিকদের বেঁচে থাকার আন্দোলনেও ছড়িয়ে পড়ুক, কেননা ইতিহাসে চেতনার এই রূপান্তর, নিদ্রাভঙ্গের এই দৃশ্য বহুবার দেখা গেছে অতীতে।
রাষ্ট্র-অর্থনীতি-দর্শন আর মানবিক মূল্যবোধ বিষয়ে নতুন চিন্তার সূতিকাগার এই সব অভিজ্ঞতা। সেই অভিজ্ঞতায় রাঙিয়ে উঠুক আজকের তরুণ। পরিবর্তন যে সম্ভব, তার কল্পনা এই সব আন্দোলনের মধ্য দিয়েই মূর্ত হতে থাকে। ভাবনার পরিবর্তনই বাকি সব বদলের জননী। সেই বদলের সূচনা হোক, পরিচয় ঘটুকু মিছিলে-স্লোগানে। কামনা করি, সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও শরিক হোক তাদেরই ভাইদের, বোনদের মিছিলের কাতারে।
লেখক : সাবেক সভাপতি, বাংলাদেশ ছাত্র ফেডারেশন। কেন্দ্রীয় সমন্বয় কমিটির সদস্য, গণসংহতি আন্দোলন।