শিক্ষায় ভ্যাট
ভ্যাট আসলে কে দেবে?
গণমাধ্যম থেকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম কিংবা রাজপথ থেকে ফুটপাত—সবখানেই ইস্যু এখন শিক্ষা ভ্যাট। আলোচনা-সমালোচনা আর প্রতিবাদ যেমন ফেসবুক, টুইটার আর ব্লগের সাইবার ঝড়ে প্রকাশ পাচ্ছে, তেমনি অরাজনৈতিক এবং ছাত্ররাজনীতিমুক্ত শান্ত ক্যাম্পাসগুলোর শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে উত্তাল এখন ১৬৪টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় ১০০টিতে। আপাতদৃষ্টিতে পরিস্থিতির খানিকটা উন্নতি চোখে পড়লেও এখানেই শেষ বলাটা বোধ হয় ঠিক হবে না। কেননা, সাড়ে ৭ শতাংশ শিক্ষা ভ্যাট প্রত্যাহার হয়নি। সিদ্ধান্ত অপরিবর্তিত রেখেই বাস্তবায়নের কৌশল বদলেছে মাত্র।
ঝামেলার শুরুটা হয় তখনই, যখন শিক্ষাকে পণ্যের পর্যায় এনে ২০১৫-১৬ অর্থবছরের বাজেট প্রস্তাব উত্থাপন করা হয় সংসদে। গত জুনে অর্থমন্ত্রী তাঁর বাজেট প্রস্তাবে বলেছিলেন, ‘বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল ও ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের ওপর বর্তমানে মূল্য সংযোজন কর (মূসক) আরোপিত নেই। খাতগুলোকে মূসকের আওতায় আনার প্রস্তাব করছি। তবে করভার সহনীয় পর্যায়ে রাখার লক্ষ্যে এ ক্ষেত্রে সংকুচিত মূল্যভিত্তিতে ১০ শতাংশ মূসক নির্ধারণের প্রস্তাব করছি।’
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা তখন থেকেই এর প্রতিবাদে সোচ্চার হলে বাজেট পাস হওয়ার সময় ওই হার কমিয়ে ৭ দশমিক ৫ শতাংশ ভ্যাট আরোপ করা হয়।
জুলাইয়ের শুরুতে এনবিআর এ বিষয়ে যে এসআরও জারি করে তাতে বলা হয়, ‘সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান কর্তৃক সেবার বিনিময়ে প্রাপ্ত সমুদয় অর্থের শতকরা ৫০ ভাগের ওপর সাড়ে ৭ শতাংশ হারে এই কর প্রযোজ্য হবে।’
আর সাড়ে ৭ শতাংশ হারে এই ভ্যাট আরোপ করে আদেশ জারির পর ওই প্রতিষ্ঠানগুলো তা কার্যকর করতে গেলে আরেক ধাপ প্রতিবাদ হয়। গত বুধবার শিক্ষা ভ্যাট প্রত্যাহারের দাবিতে আন্দোলনের শুরুটা দৃশ্যমান হয় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটি থেকে। তাঁদের ওই আন্দোলন নিয়ন্ত্রণে আনতে পুলিশ গুলি চালালে ত্বরান্বিত হয় আন্দোলনের গতি-প্রকৃতি। পরদিন বৃহস্পতিবার সকালেই তা ছড়িয়ে পড়ে রামপুরা, ফার্মগেট, কারওয়ান বাজার, বনানী, ধানমণ্ডি, উত্তরাসহ রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায়। রাজপথে নেমে আসা শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে অচল হয়ে পড়ে ঢাকার প্রধান সড়কগুলো। অসহনীয় যানজটে চরম ভোগান্তিতে পড়ে নগরবাসী। মুহূর্তেই রাজধানীর গণ্ডি পেরিয়ে সাভার ছাপিয়ে চট্টগ্রাম, সিলেটসহ দেশজুড়ে শুরু হয় তীব্র আন্দোলন।
খানিকটা বিপাকে পড়ে পরিস্থিতি সামাল দিতে কৌশল পাল্টাতে বাধ্য হয় সরকার। বৃহস্পতিবার দুপুরেই রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, “শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে আদায় করার জন্য নতুন করে ভ্যাট আরোপ করা হয়নি। বিদ্যমান টিউশন ফির মধ্যে ভ্যাট অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। ভ্যাট বাবদ অর্থ পরিশোধ করার দায়িত্ব সম্পূর্ণরূপে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের, কোনোক্রমেই শিক্ষার্থীদের নয়। বিদ্যমান টিউশন ফির মধ্যে ভ্যাট ‘অন্তর্ভুক্ত থাকায়’ টিউশন ফি বাড়ার কোনো সুযোগ নেই বলেও এতে উল্লেখ করা হয়।”
এনবিআরের বরাত দিয়ে মোবাইল ফোনে এসএমএস দিয়েও একই তথ্য প্রচার করা হয়। পরিস্থিতি শান্ত করার চেষ্টা হয়। বিকেলে সিলেটে জরুরি সংবাদ সম্মেলনে প্রায় একই সুরে কথা বলেন অর্থমন্ত্রী, ‘যে ভ্যাট আরোপ করা হয়েছে, তা প্রত্যাহার করা হবে না, এই ভ্যাট শিক্ষার্থীদের নয়।’ আর রাতে জাতীয় সংসদে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘ভ্যাট তো ছাত্রদের দিতে হবে না। এটা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে দিতে হবে। এটা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ স্বীকার করেছে।’
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, যদি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষই দেবে, তাহলে এটার নাম ভ্যাট কেন? ভ্যাট কে দেয়—ক্রেতা, নাকি বিক্রেতা? ভ্যাট বা মূল্য সংযোজন কর এবং ইনকাম ট্যাক্স বা আয়করের মধ্যে তাহলে পার্থক্যটা কী? বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় যে টাকা দেবে, সেটা কি ভ্যাট নাকি ইনকাম ট্যাক্স? এতদিন কি এই টাকা বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ট্যাক্স দেয়নি? না দিলে তখন কেন তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি? এখন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে ভিন্ন কোনো পন্থায় এই টাকা কৌশলে আদায় করে নেবে না, তার নিশ্চয়তা কী?
এসব প্রশ্নের স্পষ্ট সমাধান না হলে এই আন্দোলন একেবারেই থেমে যাবে বলে মনে হয় না। কারণ, আন্দোলনকারীরা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী, ফলে তারা একদিকে যেমন শিক্ষিত, অন্যদিকে রক্ত খানিকটা গরমও বটে। তাই এই ইস্যুতে স্থায়ী সমাধান না হলে আবারো এই আন্দোলন জমাট বাঁধলে তখন পরিস্থিতি শান্ত করাটা আরো কঠিন হয়ে পড়বে। সে ক্ষেত্রে ওই আন্দোলন রূপ পাল্টে ভিন্ন দিকে গেলে হিতে বিপরীতও হতে পারে। তাই কৌশল পরিবর্তন নয়, প্রয়োজন নীতি পরিবর্তন।
শিক্ষা ভ্যাটের পক্ষে কেউ কেউ আবার বলার চেষ্টা করছেন, পৃথিবীর অন্যান্য দেশে পড়ালেখার খরচ আমাদের দেশের চেয়ে অনেক বেশি। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখার খরচ বেশি জেনেই তারা পড়তে এসেছে। এ কথাও শুনেছি, টাকা না থাকলে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুক, মেধা আর যোগ্যতা থাকলে তো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় চান্স পেত।
যাঁরা এইচএসসি পরীক্ষায় পাস করেছেন, তাঁরা সবাই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার যোগ্য। আর এই যোগ্যতার সার্টিফিকেটের নামই হচ্ছে এইচএসসি। সুতরাং এঁদের সবার জন্য সমান সুযোগ করে দেওয়াও সরকারের নৈতিক দায়িত্ব। কিন্তু পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে আসনসংখ্যা সীমিত হওয়ায় অনেকেই জাতীয় এবং বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে বাধ্য হয়। এ ক্ষেত্রে সরকার, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো না হলেও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের জন্য খানিকটা হলেও ভর্তুকি দেবে, এটাই প্রত্যাশিত। কিন্তু উল্টো যদি তাঁদের টিউশন ফির ওপর সাড়ে ৭ শতাংশ ভ্যাট, এটা কতটা যৌক্তিক।
‘পৃথিবীর অন্যান্য দেশের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখার খরচ বাংলাদেশের চেয়ে অনেক বেশি’—এমন তথ্য অনেকাংশেই অসত্য। কেননা, পৃথিবীর অধিকাংশ দেশে প্রায় সব বিশ্ববিদ্যালয়ের টিউশন ফি বাংলাদেশের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের চেয়ে কম। আর দৃশমান যে বেশি খরচ, সেটা বাইরে থেকে পড়তে আসা ভিনদেশি শিক্ষার্থীদের জন্য। বহির্বিশ্বে অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয় তাদের নাগরিকদের টিউশন ফি রাখলেও তা নামে মাত্র; বরং তারা তাদের নাগরিকদের জন্য বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা প্রদান করে। আর যারা বাইরে থেকে পড়তে আসে, তাদের জন্য অনেক ক্ষেত্রেই স্কলারশিপের ব্যবস্থা থাকে।
সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে, শিক্ষা কোনো পণ্য নয় যে তার ওপর ভ্যাট বসানো সমীচীন হবে। কেননা, শিক্ষা যেমন পণ্য নয়, তেমনি সুযোগও নয়। প্রকৃত অর্থে শিক্ষা যেহেতু এক ধরনের নাগরিক অধিকার, তাই এ অধিকার সুরক্ষার দায়িত্ব খোদ রাষ্ট্রেরই। আর সুরক্ষা না করে উল্টো বাধাগ্রস্ত করা অনেকটাই দুঃখজনক। তাই এই সাড়ে ৭ শতাংশ শিক্ষা ভ্যাট প্রত্যাহার না করলে ছলে-বলে-কৌশলে শেষ পর্যন্ত তা শিক্ষার্থীদের ঘাড়ে এসেই চাপবে। এ ক্ষেত্রে স্থায়ী সমাধানে এই ভ্যাট প্রত্যাহার করলে খুব একটা মান-সম্মানের অবনতি ঘটবে না সরকারের; বরং সরকার যদি তার ভুল বুঝতে পেরে সমাধানের পথে হাঁটে, তবে তা সবার জন্যই হবে ইতিবাচক ও সম্মানজনক।
লেখক : পিএইচডি গবেষক ও গণমাধ্যমকর্মী।