শিক্ষা
আন্দোলন শেষ, সরকারের দায়ও কি শেষ?
‘তোমার দাড়ি কই মিয়া?’- সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর লাল সালু উপন্যাসে ভণ্ড পীর মজিদ স্কুল খোলার তোড়জোড় করতে আসা যুবককে গ্রামের সালিসে এমন প্রশ্ন করে বিব্রত এবং হতবাক করে দিয়েছিল। গ্রামে স্কুল খুললে শিক্ষিত হবে সবাই, সত্য-মিথ্যার বিভেদ বুঝতে পারবে এই চিন্তা ভণ্ড মজিদকে তার অস্তিত্ব নিয়ে সংকটে ফেলে দিয়েছিল, আর গ্রামের অবুঝ মানুষগুলোও ভেবে কূল পাচ্ছিল না গ্রামে স্কুল খোলাটা ঠিক হচ্ছে নাকি বেঠিক। তাই গ্রামের মুরুব্বিরা মজিদের সঙ্গে আলোচনা করে সালিস বসানোর সিদ্ধান্ত নেয়। সবাই যখন ভাবছে পীর আর শিক্ষকের মধ্যে আলোচনায় ঠিক হবে কোনটা সঠিক। মজিদ তখন চিরাচরিত ধর্মের বর্মে মানুষকে দুর্বল করার সবচেয়ে প্রাচীন পদ্ধতিটাকে তার রক্ষাকবচ বানায়, কেন স্কুল খুলতে হবে তার ধারেপাশে না ঘেঁষেই সে তরুণটির ধর্মের প্রতি উদাসীনতার স্মারক দাড়ি না রাখাটাকে সবার চোখের সামনে বড় করে তোলে। স্কুল খোলার পরিবর্তে সে মসজিদের জন্য সবার কাছে টাকা চায়। হঠাৎ লাল সালুর প্রসঙ্গ টানছি কারণ বারবার কেন জানি লাল সালুই আমাদের রাষ্ট্রজীবনে নানাভাবে ঘুরেফিরে আসে।
আমরা এরই মধ্যে জানি, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের টিউশন ফির ওপর মূল্য সংযোজন কর প্রত্যাহারের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। এই সিদ্ধান্তের মধ্য দিয়ে একদিনের ছাত্র আন্দোলন সফল হয়েছে। এতদিন তাদের আন্দোলন সফল হবে কি হবে না, তা নিয়ে ছিল ব্যাপক আলোচনা, বলা যেতে পারে টক অব দ্য কান্ট্রি। স্বাভাবিকভাবেই আন্দোলনটি যৌক্তিক ছিল কি ছিল না সেটা নিয়েও তৈরি হয়েছিল পক্ষ-বিপক্ষ মত। সেই মত অমতে আমরা যাব না। আমরা কথা বলব আন্দোলনের ধরন, আন্দোলনের ফল, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমতি পাওয়া ও রাষ্ট্রের অন্যান্য খাত থেকে রাজস্ব আদায় নিয়ে।
আমাদের অনেকেরই একটি ধারণা ছিল, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলেমেয়েরা বড়লোকের বখে যাওয়া উড়নচণ্ডী ছেলেমেয়ে। হয় তারা সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে সুযোগ পায়নি, নয় অভিভাবকই তাদের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি করিয়ে দিয়েছেন। গণতান্ত্রিক দেশে নানা মত থাকতেই পারে কিন্তু যুক্তি খণ্ডন না করে, লাল সালুর মজিদের মতো যাঁরা নোংরামির আশ্রয় নেন, তাঁরা আসলেই জ্ঞানপাপী। বলছিলাম বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের প্ল্যাকার্ডের ভাষা নিয়ে যাঁরা নোংরামির চূড়ান্ত করছেন, তাঁদের কথা। ছেলে এবং মেয়েরা প্ল্যাকার্ডে লিখেছিলেন, ‘দেহ পাবি মন পাবি, ভ্যাট পাবি না’। কিন্তু সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে মেয়েটাকে নিয়ে যেসব অশ্রাব্য কথা চালাচালি চলছে, তাতে মনে হচ্ছে আমাদের চারপাশে ভদ্রলোকের বেশধারী মানুষগুলো আদতে নারীকে পণ্য ছাড়া আর কিছুই ভাবে না। মূল ইস্যু রেখে স্লোগানের ভুলভ্রান্তি কিংবা নারী অংশগ্রহণকারীদের নিয়ে এই সব আলাপ-প্রলাপ বিলাপ হচ্ছিল মূলত দৃষ্টি ঘোরানোর জন্য। গণজাগরণের সময়ও এই অপচেষ্টা চালানো হয়েছে। সবচেয়ে সহজ অস্ত্র তো মেয়েদের চরিত্রের ওপর আঘাত হানা। রাজপথে স্লোগানের জন্ম হয় আন্দোলনের মেজাজ অনুযায়ী। কোনো স্লোগানই ভেবেচিন্তে গবেষণার ঘর থেকে আসে না। ’৬৯, ৭০-এর আন্দোলনে কত স্লোগানের জন্ম হয়েছে, তাঁর কিছু জনপ্রিয়তা পেয়েছে কিছু পায়নি। স্লোগান মানেই স্যাটায়ার, তাতে আক্ষরিক সুখানুভূতি নিয়ে যাঁরা নিজেরা সুড়সুড়ি গায়ে নিচ্ছেন, সেটা তাঁদের একান্তই নিজস্ব সমস্যা। আর তা ছাড়া শিক্ষার্থীদের আন্দোলন নানা সময়ে নানা মাত্রা নেবে, এটাই তো স্বাভাবিক। কেউ আক্রমণাত্মক, কেউ বা সাম্যের গান গাইবে। রামপুরায় ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটির সামনে আমি নিজে দেখেছি সকালে যে ছেলেমেয়েরা একটা রিকশা গেলেও মারমুখী হয়ে ছুটে এসেছে, তারাই আবার কিছুক্ষণ পর আলাপ-আলোচনা করে শিক্ষার্থীদের রিকশা যেতে দিচ্ছে, পুলিশের টিফিন ক্যারিয়ার নিজেরা বহন করে দিচ্ছে, এমনকি রাস্তার অবরোধ তুলে দিয়ে যানজট সরাতে নিজেরাই ট্রাফিকগিরি করছে।
তারুণ্যের এই সুন্দর সময়ে ওরা ভুল করবে, অনুতপ্ত হবে, আবার নতুন করে শিখবে। ওদের আন্দোলন ঠিক না বেঠিক, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মালিকরা তাঁদের স্বার্থে ওদের মাঠে ফেলে রেখেছেন কি না, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের মনিটরিংয়ের অভাবে ছাতার মতো অলাভজনকের মোড়কে সবচেয়ে লাভজনক ব্যবসা হয়ে ওঠা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে সরকার কেন শুরু থেকেই কঠোর নজরদারি করেনি ইত্যাদি যখন বার্নিং ইস্যু হওয়ার কথা, তখন সেখানে সহি হাদিস খোঁজা হচ্ছে। আসলে স্লোগানের ভুলত্রুটি নিয়ে এসব কথা বলে আন্দোলনকে অন্যদিকে ঘুরিয়ে দেওয়ার চেষ্টাই যেন করা হচ্ছিল। ভাগ্যিস আন্দোলনের দাবিদাওয়া শেষ পর্যন্ত সরকার মেনে নিয়েছে। এই দাবি না মেনে নিলে ক্ষতি হতো শিক্ষাব্যবস্থার, সরকারের ও দেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের।
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো অলাভজনক প্রতিষ্ঠান হিসেবে দাবি করেও দিনের পর দিন লাভজনক ব্যবসায় পরিণত হয়েছে বেশ কয়েক বছর আগে থেকেই। কিন্তু এ নিয়ে তেমন উচ্চবাচ্য নেই। সুশীলসমাজও কথা বলে না। সন্তানকে উচ্চশিক্ষা দেওয়ার আশায় ব্যাঙের ছাতার মতো দ্রুত গজিয়ে ওঠা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মনোমুগ্ধকর প্রলোভনে চিহ্নিত হলেও এই নিয়ে কিছুই করতে পারেনি কোনো সরকার। বরং যে যখন ক্ষমতায় থাকে তার দলের লোকদের খুশি করতে একটা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদন পুরস্কার হিসেবে দেওয়া হয়। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনও বিশ্ববিদ্যালয় হওয়ার যোগ্যতা আছে কি নেই তা না দেখেই অনুমোদন দিচ্ছেন আবার পরে নিজেদের অসহায়ত্ব প্রচার করে বেড়াচ্ছেন এসব বিশ্ববিদ্যালয় নামের ‘কলঙ্ক’ প্রতিষ্ঠানগুলোর লাগাম টেনে ধরতে না পারায়।
প্রতিবছরই অর্থমন্ত্রী বাজেট পেশ করার পরপরই আমরা দেখি শিক্ষা খাতে বরাদ্দ নিয়ে শিক্ষামন্ত্রীর আক্ষেপ। আবার অর্থমন্ত্রী বেশ কয়েক বছর ধরেই বলে চলেছেন বিনা পয়সায় শিক্ষালাভের দিন শেষ। ২০১৪ সালের হিসাব অনুযায়ী বাংলাদেশে ৮০টির মতো বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। বেসরকারি মেডিকেল কলেজ ও প্রকৌশল কলেজেও অনেক শিক্ষার্থী লেখাপড়া করে। সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে আসন বরাদ্দ না পেয়ে অনেকে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে বাধ্য। অনেক পরিবার কষ্ট করে হলেও তাদের সন্তানকে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ায়। এসব জায়গায় পড়ার খরচ এমনিতেই বেশি। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো অযৌক্তিকভাবে নানা বাহানায় শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে প্রচুর টাকা নেয়, যা সরকারের সঠিক মনিটরিং থাকলে সম্ভব হতো না। সরকার যদি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে কড়া তদারকির মধ্যে এনে শিক্ষার্থীদের বেতন বা সেমিস্টার ব্যয় কমিয়ে আনত, তবে সরকার রাজস্বও পেত আবার শিক্ষার্থীদের সাধুবাদও পেত। কিন্তু অত্যন্ত অন্যায়ভাবে অর্থমন্ত্রী শিক্ষার্থীদের টিউশন ফির ওপর ৭.৫% মূল্য সংযোজন কর আরোপ করলেন। যাক, সেই অন্যায় ভ্যাট প্রত্যাহার করে সরকারের সুবুদ্ধির পরিচয়ই দিয়েছে।
চলতি অর্থবছরের জন্য মোট রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে দুই লাখ আট হাজার ৪৪৩ কোটি টাকা। এই লক্ষ্যমাত্রা বিশাল, যা অর্জন করা কঠিন। তাই অর্থবছরের শুরু থেকেই তৎপর সরকার। রাজস্ব বাড়াতে সরকারের নজর শিক্ষার্থীদের ওপর, এক্ষেত্রে অর্থমন্ত্রীর যুক্তি ছিল লাখ লাখ টাকা ব্যয় করে তারা যেহেতু শিক্ষা গ্রহণ করে, ভ্যাটের টাকাও (মাসে প্রায় আড়াই হাজার টাকা) তারা দিতে পারবে। তাহলে একজন চিকিৎসক এক লাফে যখন ৫০০ টাকার ভিজিট ১০০০ টাকা করে ফেলেন, তাঁর মাসিক আয় কি যথাযথভাবে খতিয়ে দেখা হয়? একজন আইনজীবী যখন একটি মামলায় লড়ে লাখ লাখ টাকা আয় করেন, তাঁর হিসাব কি যথাযথভাবে সম্পন্ন করে সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগ? অনেক ব্যবসায়ীই গোপন করেন প্রকৃত আয়, তাঁদের কি ধরা হচ্ছে? না, কর ফাঁকিবাজরা আড়ালেই থাকছেন, তাঁদের ধরতে অনেক হুঁশিয়ারি উচ্চারণ হলেও ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকছে বড় বড় রুই-কাতলা। সরকার রাজস্ব বাড়ানোর কৌশলগুলো খুঁজতে এদের ওপর যদি ভ্যাট বাড়ায় এরা সাধারণ মানুষের কাছ থেকেই তা আদায় করবে যেমন করবেন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মালিকরা। তাই লক্ষ রাখতে হবে ভবিষ্যতে যেন শিক্ষার ওপর ভ্যাট না আরোপ করা হয়। সরকারের অর্থমন্ত্রী তো নিশ্চয়ই নীলকর নন যে জনগণের গলায় পাড়া দিয়ে দেশের উন্নয়নের জন্য রাজস্ব আদায় করবেন। এই বিব্রতকর অবস্থা থেকে বেরিয়ে জনবান্ধব সরকার হিসেবে মূল সমস্যা চিহ্নিত করতে হবে। তাহলে জনগণের দেহ-মন সবই পাবেন। সবশেষে বলতে চাই মানুষের মৌলিক অধিকারগুলো নিশ্চিত করুন, যাতে মানুষ স্বল্প খরচে শিক্ষা ও চিকিৎসাসেবা পায়।
লেখক : সিনিয়র রিপোর্টার, এটিএন নিউজ।