জালনোট
ঈদ এলেই জাল টাকা বাড়ে কেন?
ঈদুল আজহা এলেই জাল টাকা প্রতিরোধে বিভিন্ন উদ্যোগের দেখা মেলে। কোরবানির হাটেও পাওয়া যায় জাল টাকা। গ্রাম থেকে আসা অনেক বেপারীকে জাল টাকা নিয়ে হাহাকারও করতে দেখা যায়। নিঃস্ব হয়ে ফিরেও যায় অনেকে। ফলে সহজেই প্রশ্ন জাগছে, জাল টাকা ও কোরবানির ঈদ কি একে অপরের পরিপূরক হয়ে উঠছে? নাকি বিভিন্ন উদ্যোগের ফলে জাল টাকা প্রতিরোধ করা যাচ্ছে?
পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই জাল টাকার খবর মেলে। তবে বাংলাদেশে শুধু কোরবানির ঈদ এলেই বেশি পাওয়া যায় এই জাল টাকা। ফলে আমরা একরকম সুখেই আছি বলা যায়।
সাংবাদিকতায় আমি ব্যাংক খাতের প্রতিবেদনের সঙ্গে যুক্ত, তাই ২০১৩ সালের দ্বিতীয় সপ্তাহে বিশ্ব মিডিয়ার একটি সংবাদ খুবই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে আমার কাছে। বাংলাদেশ ব্যাংক জাল টাকার সর্বোচ্চ শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদণ্ডকে যুক্ত করতে সরকারের কাছে সুপারিশ করে। এ খবরে জার্মানির কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাংলাদেশের একটি প্রকল্প স্থগিত করে দেয়। এ প্রকল্পের অধীনে ডুয়েসে বুন্দেস ব্যাংক বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তাদের জাল টাকা প্রতিরোধে প্রশিক্ষণ, কারিগরি সহায়তা ও পরামর্শ সেবা দেওয়ার পরিকল্পনা ছিল। ফলে বন্ধের দিন বাংলাদেশ ব্যাংক ঘটা করে জানায়, তারা সে সুপারিশ প্রত্যাহার করে নিচ্ছে। মানবিক ব্যাংকিং গড়ে তোলার চেষ্টায় এ সুপারিশ বাধা হতে পারে, তবে জাল টাকা রোধে তারা যথাযথ শাস্তি চায়। তবে শেষ পর্যন্ত জাল টাকার সর্বোচ্চ শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদণ্ডের আইন হয়নি।
এর পর থেকে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে কোরবানির ঈদ এলেই ঘটা করে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নিতে দেখা গেছে। উদ্যোগ বাস্তবায়ন যা-ই থাকুক, সংবাদ সম্মেলন ডেকে জানানো হয়, কী কী উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। যেমন এবারও বাংলাদেশ ব্যাংক জানিয়েছে, পবিত্র ঈদুল আজহার আগে জাল চক্রের সদস্যরা কোনোভাবে যেন জাল নোট ছড়াতে না পারে, এ জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক বিশেষ সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। এর অংশ হিসেবে সব বাণিজ্যিক ব্যাংক এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের শাখা অফিসকে এ বিষয়ে তৎপর থাকতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। সংবাদ সম্মেলনে ডেপুটি গভর্নর নাজনীন সুলতানা জানিয়েছেন, বিভিন্ন উৎসব সামনে রেখে বাজারে জাল নোটের ঘটনা বাড়ে। তাই ঈদ সামনে রেখে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোয় জাল নোট প্রতিরোধ-সংক্রান্ত কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিদর্শন কার্যক্রম জোরদার করা হয়েছে। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে সাতটি, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে ১০টি এবং সিটি করপোরেশনের বাইরের তিনটি হাটসহ মোট ২০টি হাটে জাল নোট শনাক্তকরণ বুথ স্থাপনের মাধ্যমে পশু ব্যবসায়ীদের হাট শুরুর দিন থেকে ঈদের পূর্বরাত পর্যন্ত নোট যাচাই-সংক্রান্ত সেবা প্রদানের জন্য ৩৯টি ব্যাংককে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।
ঢাকার বাইরের জেলাগুলোয়, যেখানে বাংলাদেশ ব্যাংক রয়েছে, সেসব স্থানে বাংলাদেশ ব্যাংক এবং অন্যান্য স্থানে সোনালী ব্যাংক জেলা প্রশাসকের সঙ্গে আলোচনাক্রমে সব জেলা-উপজেলা পর্যায়ে পশুর হাটগুলোতে বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষে ব্যাংকগুলোর দায়িত্ব বণ্টন করে, বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট অফিসকে অবহিত করবে। সম্মেলনে জানানো হয়, কোরবানির পশুর হাটগুলোয় ব্যবহারের জন্য আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোয় (ডিএমপি, বিজিবি ও র্যাব) চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে ৪৫০টি জাল নোট শনাক্তকারী মেশিন সরবরাহ করা হয়েছে।
এ ছাড়া জাল নোট প্রতিরোধে জনগণকে সচেতন করার অংশ হিসেবে আসল নোটের নিরাপত্তা বৈশিষ্ট্যসংবলিত ভিডিওচিত্র প্রচারের জন্য তথ্য মন্ত্রণালয়কে অনুরোধ করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। কোরবানির হাটে ক্রেতা-বিক্রেতা সবাইকে লেনদেনের সময় মেশিনের সাহায্যে নোট পরীক্ষা করে নেওয়ার জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষ থেকে অনুরোধ জানানো হয়েছে।
তবে এতসব উদ্যোগের পরও জাল টাকা কিন্তু থেমে থাকছে না। এর কারণ একটিই বলে মনে হয়, জাল টাকার সঙ্গে জড়িত কারো দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হয়নি। বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবেই বলছে, ১০০০ টাকার নোটই বেশি জাল হচ্ছে। প্রতি সপ্তাহে ১০০০, ৫০০ ও ১০০ টাকার নোট জাল হচ্ছে প্রায় ৫০টি। ঈদের আগে এই প্রবণতা আরো বেড়ে যায়। তবে জাল টাকা নিয়ে বাংলাদেশ সরকারের চেয়ে ভারতের সরকারের মাথাব্যথা বেশি বলে মনে হয়। কারণ, ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সফরে যেসব চুক্তি হয়েছে, এর মধ্যে একটি বাংলাদেশের ভূমি যেন ভারতের জাল টাকা তৈরি অথবা ট্রানজিট হিসেবে ব্যবহার না হয়। তবে ভারতে বাংলাদেশের জাল টাকা তৈরি বন্ধে কোনো উদ্যোগ এখনো চোখে পড়েনি।
জাল টাকা যে দেশ, সমাজ, গোষ্ঠী কারো জন্য ভালো নয়, সেটা সহজেই বোধযোগ্য। তবে বাংলাদেশের জাল টাকা প্রতিরোধে সরকারকেই বড় উদ্যোগ নিতে হবে। জড়িতদের শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। আর বাংলাদেশ ব্যাংককে টাকার নিরাপত্তা বৈশিষ্ট্য আরো শক্তিশালী করতে হবে। জনগণকেও সচেতন করে গড়ে তুলতে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ নিতে হবে। সরকার, বাংলাদেশ ব্যাংক, জনগণ সবাই মিলে জাল টাকা প্রতিরোধে সচেতন হলেই সম্ভব এটা রোধ করা। তবে যেভাবে জাল টাকার বিস্তারের খবর মিলছে, ধরা পড়ছে, তাতে জাল টাকা আর কোরবানির ঈদ এক হয়ে যাচ্ছে। প্রতিরোধে ব্যবস্থাও যথেষ্ট মনে হচ্ছে না। এটা রোধ করার প্রকৃত সময় এখনই।
লেখক : স্টাফ রিপোর্টার, ডেইলি বণিক বার্তা।