প্রতিক্রিয়া
কালিহাতী বনাম আইনের শাসন
বলা হয়, ‘আইন হচ্ছে সুবোধ বালক যে তার বাবার হাত ধরে চলে’- এখানে বাবা কে, তা সবাই জানেন।বাংলাদেশের সংবিধানের চার মূলনীতির অন্যতম গণতন্ত্র, যে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার প্রধান শর্তই হলো আইনের শাসন। কিন্ত বাস্তবতা হলো, বাংলাদেশে আইন ও শাসন দুটিই আছে। আইন তার নিজস্ব গতিতে চলে। আর শাসনও চলে তার নিজস্ব প্রক্রিয়ায়। ফলে এ দুয়ের মধ্যে কোনো সম্পর্ক গড়ে ওঠে না।
টাঙ্গাইলের কালিহাতীতে ছেলের সামনে মায়ের শ্লীলতাহানির যে পৈশাচিক ঘটনা ঘটল এবং যার প্রতিবাদে এলাকার নারী-পুরুষ নির্বিশেষে রাস্তায় নেমে আসার পর পুলিশের সাথে সংঘর্ষ হলো এবং সেই পুলিশের গুলিতে তিনজন সাধারণ মানুষের মৃত্যু হলো, সেই ঘটনার পর দেশের মানুষ দেখল, বাংলাদেশে কী দুর্দান্ত আইনের শাসন চলছে।
পুলিশের গুলিতে তিনজন সাধারণ মানুষ নিহত হলো, উল্টো পুলিশ বাদি হয়ে এলাকাবাসীর বিরুদ্ধে মামলা দিল। অভিযোগ, পুলিশের ওপর হামলা। যদিও জনরোষের মুখে কয়েকজন পুলিশ সদস্যকে ক্লোজড করা হয়েছে। কিন্তু পুলিশ বাহিনীতে ক্লোজড শব্দের কী অর্থ, এটি আসলে কী ধরনের শাস্তি তা সাধারণ মানুষ জানে। এই পুলিশ সদস্যরা শেষমেশ দায়মুক্তি পাবেন। সবচেয়ে বড় কথা, কোনো পুলিশ সদস্য তাঁর ঊর্ধ্বতনের নির্দেশ ছাড়া গুলি ছোড়ে না। আবার গুলি ছোড়ার জন্য যে ম্যাজিস্ট্রেটের অনুমতি নিতে হয়,সেই নিয়মও যে পুলিশ বেশির ভাগ সময় মানে না, তাও দেশের মানুষের অজানা নয়।ট্র্যাজেডি হলো, এই পুলিশ বাহিনীর বেতন-ভাতা হয় সেসব নিরীহ মানুষের কর ও ভ্যাটের পয়সায়, যারা পুলিশের গুলিতেই নিহত হয়।
দেখা যাক আইনের শাসন বিষয়টা আসলে কী? ইংরেজিতে একে বলে Rule of Law অর্থাৎ রাষ্ট্র পরিচালিত হবে আইনের দ্বারা, ব্যক্তির দ্বারা নয়।আর সব ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান আইনের কাছে সমান। এরিস্টটল বলেছেন, আইনই শাসন করবে, আর যারা ক্ষমতায় থাকবে তারা হবে Servents of Law অর্থাৎ আইনের সেবক। তিনি বলেন, আইনে শাসন না থাকলে গণতন্ত্র কার্যকর হয় না। আইনের শাসনের বৈশিষ্ট্য হলো, ব্যক্তির ইচ্ছা অনুযায়ী সরকার চলবে না। বরং সরকার চলবে পূর্ব নির্ধারিত ও অনুমোদিত আইন দ্বারা।
কিন্তু বাংলাদেশে আমরা দেখি সরকার চলে আসলে ব্যক্তির ইচ্ছায়। সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোও চলে ব্যক্তিবর্গের ইচ্ছায়। ফলে আইন প্রয়োগ হয় সরকারের ইচ্ছায়।একই অপরাধে একই আইনের প্রয়োগ ভিন্ন ভিন্ন ব্যক্তির ওপর ভিন্ন ভিন্নরূপে প্রয়োগ হয়।
কালিহাতীতে যে ঘটনা ঘটছে, সেটি বাংলাদেশের জন্য নতুন কিছু নয়। বিভিন্ন ইস্যুতে বিভিন্ন জায়গায় সাধারণ মানুষ রাস্তায় নেমে আসার পর পুলিশের সাথে সংঘর্ষ হলে সাধারণ মানুষের বিরুদ্ধেই মামলা হয়। আর এসব ক্ষেত্রে যে অভিযোগ আনা হয়, তাও গতানুগতিক, পুলিশের ওপর হামলা বা সরকারি কাজে বাধা দান।
একটি অন্যায়ের প্রতিবাদে দলমত নির্বিশেষে সব শ্রেণি-পেশার মানুষ রাস্তায় নামল। তারা দোষীদের বিচার দাবি করল। কিন্তু সেখানে গুলি চালাল পুলিশ।এর আগেও কৃষকের ন্যায্য অধিকারের দাবির মিছিলে পুলিশ গুলি চালিয়েছিল।এই গুলি চালানোরও আইন আছে। কিন্তু সেই আইনের সঙ্গে শাসনের দূরত্ব ঢের।
কিন্তু কালিহাতীতে যে মানুষগুলো রাস্তায় নেমেছিল, তাদের কোনো রাজনৈতিক ব্যানার ছিল না। তাদের দাবিও কোনো রাজনৈতিক ছিল না। তারা একটি ঘোরতর অন্যায়ের প্রতিবাদ করছিল। কিন্তু এখন সেই মানুষগুলোকেই পালিয়ে বেড়াতে হচ্ছে পুলিশের গ্রেপ্তার আতঙ্কে। যে নিরীহ গৃহবধূরা ওড়না বা চাদরে মুখ ঢেকে রাস্তায় নেমে এসেছিল, সেই গৃহবধূরাও হয়তো গ্রেপ্তার হবে। তাদের সঙ্গে তাদের শিশুসন্তানরা গ্রেপ্তার হলেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। কারণ, তারা পুলিশের ওপর হামলা চালিয়েছে। পুলিশের গুলিতে কতজন মরল সেটি বিবেচ্য নয়, পুলিশের ওপর কারা হামলা চালাল, আইনের শাসনের দৃষ্টিতে সেটিই মুখ্য।
লেখক : যুগ্ম বার্তা সম্পাদক, চ্যানেল টোয়েন্টিফোর।