করণীয়
হাট ও পশু জবাইয়ের কারণে জনদুর্ভোগ যেন না হয়

কোরবানির ঈদ সামনে রেখে দেশে এক মাসে প্রায় ৬০ হাজার কোটি টাকার বাণিজ্য হবে, এটি ভাবাই যায় না। এর মধ্যে প্রায় ৮০ লাখ গরু এবং প্রায় ৪০ লাখ ছাগল কোরবানি করা হয়ে থাকে। ঈদের সপ্তাহখানেক সময়ের মধ্যেই মূলত এ বাণিজ্যের অধিকাংশ সম্পন্ন হয়ে থাকে। শুধু এটুকু সময়ের মধ্যেই প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকা গ্রামীণ মানুষের কাছে চলে যায়। ফিরে আসে গ্রামীণ অর্থনীতিতে এক অন্য রকম প্রাণচাঞ্চল্য। যদিও ব্যবসায়িক দৃষ্টিকোণ এবং সামাজিক নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করে, কোরবানিতে আমাদের দেশে উৎপাদিত/পালিত পশু কম পড়তে পারে এমন আশঙ্কা থেকে পার্শ্ববর্তী ভারত ও মিয়ানমার থেকে বৈধ ও অবৈধপথে কিছু পশু আমদানি করার কারণে ওই সময়ে প্রায় সাড়ে সাত হাজার কোটি টাকা দেশীয় মুদ্রা বিদেশে স্থানান্তর হয়ে যায়। এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, এই ৮০ লাখ পশু প্রতিপালনের জন্য দেশের ৫০ লাখ পরিবার প্রতিবছরে/মৌসুমে কমপক্ষে ৩০ হাজার করে টাকা আয় করে থাকে। এসব পশু প্রতিপালনের জন্য একদল উপকারভোগী কৃষক, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, খামারি এক কোরবানির ঈদ শেষ হওয়ার পরই জীর্ণ-শীর্ণ পশু ক্রয় করে পরের বছরের ঈদকে ধরার জন্য পুনরায় প্রতিপালনের মাধ্যমে মোটাতাজাকরণের কাজ করা শুরু করে দেন।
পালিত পশু বিক্রি করার পর আবার সেখানে কোরবানির পশুর চামড়ার মৌসুমি ব্যবসা, ঈদের দিন দলবেঁধে কসাইয়ের কাজ করা, পশুর হাটের ফড়িয়া, পাইকার, মধ্যস্বত্বভোগী ইত্যাদি কাজ করে গ্রামীণ খেটে খাওয়া মানুষের বাড়তি আয়-রোজগারের ব্যবস্থা হয়ে থাকে। কোরবানির পশুর চামড়ার মূল্যের শতভাগ দাবিদার হলো দরিদ্র জনগোষ্ঠী, একে গরিবের হকও বলা হয়ে থাকে। ইসলামী বিধানমতে, কোরবানি করা পশুর তিন ভাগের দুই ভাগ এবং এর চামড়ার মূল্যে পুরোটা বিলি-বণ্টন করার পর সে সময় গ্রামীণ অর্থনীতিতে এক অন্য রকম প্রাণচাঞ্চল্য ও আর্থসামাজিক চাকা সচল হয়ে ঘুরতে থাকে। মানুষ ভুলে যায় ধনী-গরিবের ব্যবধান। আর এ কাজে ধারাবাহিক কার্যক্রম হিসেবে কোরবানি ঈদের কমপক্ষে এক মাস আগে থেকেই এর জন্য পশুর হাটবাজার ও জবাইখানা নির্ধারণসহ অন্যান্য আনুষঙ্গিক প্রয়োজনীয় কার্যক্রম একটার পর একটা ক্রমানুসারে চলতে থাকে।
এটি আসলে নাগরিক সুবিধার্থে কর্তৃপক্ষীয় উদ্যোগেরই অংশ। কিন্তু সে জন্য অবশ্যই সুষ্ঠু পরিকল্পনা ও তদানুযায়ী সঠিক পদক্ষেপ থাকা বাঞ্ছনীয়। সময়ের হিসাবে কোরবানি ঈদ পরশু দিন। সে জন্য দেশের সরকারসহ বিভিন্ন নগর-মহানগরীয় সিটি করপোরেশন, পৌরসভা এমনকি কোথাও কোথাও ইউনিয়ন পরিষদকেও তাদের তৎপরতা শুরু করতে দেখা যাচ্ছে। আর তারই অংশ হিসেবে রমজানের ঈদের কিছুদিন পরই সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে মাঠপর্যায়ের বিভিন্ন দপ্তরে অফিস আদেশ/প্রজ্ঞাপন জারি করে কোথায় কোথায় কোরবানির পশুর হাটবাজার বসানো যাবে, আবার কোথায় কোথায় যাবে না, তা জানিয়ে দিয়েছে। কিন্তু চিঠির মাধ্যমে আদেশ দেওয়াই কি যথেষ্ট?
ঈদ যতই এগিয়ে আসছে, ততই অবশ্য সরকারের সংশ্লিষ্ট মহল, বিশেষত রাজধানী ঢাকা এবং বন্দরনগরী চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের তৎপরতা লক্ষণীয় হচ্ছে। আর এ তৎপরতার অংশ হিসেবে রাজধানী ঢাকায় উত্তর ও দক্ষিণ দুটি সিটি করপোরেশনে ১৫টি কোরবানির পশুর হাটবাজার জমানোর জন্য স্থান ঠিক করা হয়েছে। গত বছর অবশ্য ১৮টি স্থানে হাট বসেছিল। এসব অত্যাধুনিক সুযোগ-সুবিধাসম্পন্ন হাটে চুরি, রাহাজানি, ছিনতাই, মলম পার্টির দৌরাত্ম্য, জালিয়াতিসহ অন্য যেকোনো ধরনের অনিয়ম শনাক্তকরণের জন্য কর্তৃপক্ষ কর্তৃক সিসিটিভি ক্যামেরা স্থাপনের পরিকল্পনার কথা শোনা যাচ্ছে। এসব আয়োজন সঠিকভাবে কাজ করলে অপরাধ অনেকাংশে কমানো সম্ভব হবে। আবার ঢাকায় দুটি সিটি করপোরেশনের ভেতরে বিভিন্ন স্থানে স্বাস্থ্যসম্মতভাবে পশু কোরবানি করার জন্য মোট ৫৩৫টি স্থান নির্ধারণ করা হয়েছে, যার মধ্যে দক্ষিণ সিটিতে ৩২৭টি ও উত্তরে ২০৮টি স্থান। অন্যদিকে চট্টগ্রামে সিটি করপোরেশনের ভেতরে ২০টি পশুর হাট বসানোর জন্য স্থান ঠিক করা হয়েছে। ঈদের আগে এমনিতেই সড়ক-মহাসড়কে যানবাহনের বাড়তি চাপ থাকে, তার ওপর যত্রতত্র পশুর হাট যানজট সৃষ্টি করে জনদুর্ভোগ তৈরি হয়ে থাকে। সে জন্য সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের এরই মধ্যে সড়ক-মহাসড়কের আশপাশে কোনো ধরনের কোরবানির পশুর হাট বসাতে মানা করে দিয়েছেন।
আবার কোরবানির পশুর হাটের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে স্থানীয়ভাবে প্রভাবশালীদের মধ্যে দলাদলি ও ভাগাভাগির জেরে মৃত্যুর ঘটনাও ঘটতে দেখা গেছে। কাজেই এগুলোর বিচার-বিবেচনায় কোরবানির পশুর হাটগুলো সারা দেশে একটি নির্দিষ্ট সম-নীতিমালার ভিত্তিতে চালানো উচিত। পাশাপশি একই এলাকায় ওয়ার্ড, ইউনিয়ন, পৌরসভা, উপজেলা, জেলায় স্থানে স্থানে স্থাপিত হাটের দিন ও সময়ের সমন্বয় করে নিতে হবে, যাতে একই সময়ে পাশাপাশি জায়গায় হাটবাজার না জমে। স্থান নির্বাচনের জন্য সড়ক-মহাসড়কের পাশে নয়, কিন্তু অদূরবর্তী স্থানকে বেছে নিতে হবে, যাতে ক্রেতা-বিক্রেতার যাতায়াতের কোনো অসুবিধা না হয়। উন্মুক্ত ও খোলামেলা স্থান হিসেবে বিভিন্ন স্কুল-কলেজ কিংবা মাদ্রাসার মাঠকে গুরুত্ব দিয়ে বেছে নিতে হবে। খেয়াল রাখতে হবে, যেন কোনো অবস্থাতেই দু-একজন ব্যক্তি তাদের অনৈতিক ও অবৈধ স্বার্থ উদ্ধারের জন্য সরকার ও ঈদ প্রক্রিয়াকে বিতর্কিত করে না ফেলে। কোরবানির পশুর হাট সম্পর্কে ঢাকা-চট্টগ্রামসহ বড় বড় শহরের বিষয়ে যেভাবে সব মহল কিছুটা হলেও সচেতন থাকে, কিন্তু সারা দেশের আনাচে-কানাচে, অলিগলি সম্পর্কে কোনো পূর্বপরিকল্পনা তেমনভাবে চোখে পড়ছে না, যাতে জনদুর্ভোগ বেড়ে সমস্যা তৈরি হতে পারে।
দেশের সব পশুর হাটেই সাধ্যমতো নিরাপত্তা ব্যবস্থা, ক্ষতিকর রাসায়নিক ওষুধ ব্যবহৃত কোনো পশু বাজারে এসেছে কি না, তা পরীক্ষার জন্য সংশ্লিষ্ট বিষয়ে বিশেষজ্ঞ সমন্বয়ে একটি করে পশু মেডিকেল টিম থাকা দরকার। কৃষক, বেপারী, ব্যবসায়ীসহ ক্রেতা-বিক্রেতাদের জালিয়াতচক্র, অজ্ঞান পার্টি-মলম পার্টি, দালালচক্র, চাঁদাবাজ, জাল টাকার নোট ছড়ানো চক্রের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য এবং সময়মতো পাকড়াও করার জন্য রাস্তায় রাস্তায় পর্যাপ্ত র্যাব, পুলিশ, বিজিবি, আনসার, কমিউনিটি পুলিশকে সশস্ত্র টহলরত রাখার ব্যবস্থা করতে হবে। পশু কোরবানি করার স্থান হিসেবে প্রতি এলাকার জন্য ক্লাস্টারে একেকটি স্থান নির্ধারণ করা দরকার। গ্রামাঞ্চলে বেশি সমস্যা না হলেও শহরের জন্য কোরবানির স্থানটি স্বাস্থ্যসম্মত হওয়া খুবই প্রয়োজন। কারণ, জবাইকৃত পশুর নাড়িভুঁড়ি, রক্তসহ অন্যান্য বর্জ্য পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক সমস্যা তৈরি করে থাকে। সে জন্য এলাকায় এলাকায়, মহল্লায় মহল্লায়, পাড়ায় পাড়ায় কোনো স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা ইত্যাদি প্রতিষ্ঠানের মাঠকে জবাইয়ের স্পট হিসেবে ব্যবহারের জন্য ঘোষণা করা যেতে পারে। সে সঙ্গে পশু জবাইয়ের পরপর যাতে সিটি করপোরেশন, পৌরসভা, ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা পরিষদ ও উপজেলা প্রশাসন এবং জেলা পরিষদ ও জেলা প্রশাসন প্রশিক্ষিত পরিচ্ছন্নতাকর্মীর মাধ্যমে জবাইকৃত স্থানের উচ্ছিষ্টাংশ দুর্গন্ধ ছড়ানোর আগেই দ্রুত সরিয়ে ফেলার ব্যবস্থা নিতে হবে। এর জন্য উপরোক্ত সংস্থাগুলোকে ব্যাপক প্রচারের ব্যবস্থা নিতে হবে।
সবার প্রচেষ্টায় স্বেচ্ছাশ্রমের মাধ্যমে সে জন্য লিফলেট বিতরণ, মসজিদে মসজিদে মাইকিং, প্রতিটি মসজিদের ইমাম সাহেবদের দ্বারা জুমাবারসহ প্রতি ওয়াক্ত নামাজের সময় মুসল্লিদের জানিয়ে দিতে সংশ্লিষ্ট জেলা, উপজেলা ও ইসলামিক ফাউন্ডেশন কর্তৃক পত্র ইস্যু করা যেতে পারে। যেহেতু কোরবানির পশুর চামড়া একটি জাতীয় সম্পদ ও অন্যতম রপ্তানিপণ্য এবং ওই চামড়া বা এর মূল্যের সম্পূর্ণ ভাগিদার হলো গরিব-দুঃখী, এতিম ও নিম্ন-আয়ের মানুষ, সে জন্য তাদের হক সেই চামড়া যাতে কোনো মূল্য সিন্ডিকেশনের আওতায় না আসে, সেটিও আগে থেকেই লক্ষ রাখতে হবে। ঈদ মৌসুমে কোরবানির পশুর হাট প্রতিদিনই কোনো না কোনো স্থানে হবেই বিধায় এবং হাটবাজারে সেখানকার আশপাশের এলাকা থেকে পশু নিয়ে আসার কারণে সড়ক-মহাসড়কের দুই পাশে যত্রতত্র পশুসমেত মানুষের হাঁটাচলা লক্ষ করা যাবে। ক্রেতা-বিক্রেতারা তখন পশু কিনে আবেগতাড়িত হয়ে বিজয়ীর বেশে উৎফুল্ল মনে হাঁটিয়ে হাঁটিয়ে তাদের নিজ নিজ বাড়িতে নিয়ে যেতে দেখা যাবে। সে জন্য ওই সময়কার সড়ক দুর্ঘটনা এড়ানোর জন্য রাস্তায় গাড়ি চলাচল যাতে ধীরগতিতে হয়, সে জন্য ট্রাফিকিং করতে হবে। রাজধানী ঢাকায় প্রতিটি পশু কোরবানির স্পটে জবাইয়ের জন্য প্রশিক্ষিত ইমাম রাখার যে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, তা সারা দেশে কীভাবে সম্প্রসারিত করা যায় তা খতিয়ে দেখতে হবে।
সর্বোপরি নগর-মহানগরের সড়ক-মহাসড়কের যান চলাচল বন্ধ করে কোনো অবস্থাতেই যাতে পশুর হাট এবং ঈদের দিন কোরবানি জবাইয়ের স্পট নির্ধারিত না হয়। এসব কাজে সড়ক পরিবহন, স্থানীয় সরকার, ধর্ম, স্বরাষ্ট্র, মৎস্য ও পশুসম্পদ, জনপ্রশাসনসহ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোকে সদা তৎপর হতে হবে। এভাবে সম্মিলিত ও সমন্বিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে আসন্ন কোরবানি ঈদ নির্বিঘ্ন করা সম্ভব। সবার প্রত্যাশাও তাই।
লেখক : কৃষিবিদ ও ডেপুটি রেজিস্ট্রার, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়, ত্রিশাল, ময়মনসিংহ।