ঈদে বাড়ি ফেরা
প্রাণের টানে শেকড় পানে

‘নীলগাঙ নামে একটা নদী আছে, তার তীরে একটা গ্রাম—সেই গ্রামের নাম নীলাঞ্জনা। সেই গ্রামে গোলাম মুস্তফা সরকার নামে একজন শিক্ষক আছেন। তার একটা স্কুল আছে, সেই স্কুলের নাম গণমুক্তি। গোলাম মুস্তফা সরকার সেই স্কুলে আমাকে একটা চাকরি দিয়ে গেছেন। তার স্কুলে বিজ্ঞান পড়ানো। থাকা-খাওয়া ফ্রি। বেতন কত শুনবে?—কত? থাক শুনে কাজ নেই। তুমি হাসতে হাসতে পেট ফেটে মরেও যাবে।’
মুহম্মদ জাফর ইকবালের লেখা ‘বিবর্ণ তুষার’ উপন্যাসটি পড়েছিলাম ছোটবেলায়। তারিক নামের এক বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত বিজ্ঞানী ফিরে আসতে চান গ্রামে। লাখ ডলারের বেতন আর জীবনের প্রাচুর্যময় উপভোগের উপাদান, সব পেছনে ফেলে কোনো এক অজপাড়া গ্রামে ফিরে আসার চিন্তাটা কঠিন হলেও অবাস্তব নয়। বিশেষত, আমরা যাঁরা প্রথমত পড়ালেখা, দ্বিতীয়ত জীবন-জীবিকার তাগিদে শহুরে বাসিন্দা, তাঁদের গ্রামের প্রতি টান তাই দুর্নিবার।
প্রতিবছর দুই ঈদই আমাদের সবচেয়ে বড় সামাজিক ও ধর্মীয় উৎসব। তাই এ উৎসব ঘিরে স্বজনদের কাছে ফিরতে রাজধানী ঢাকা, বিভাগীয়সহ বিভিন্ন শহর থেকে গ্রামে ছুটে যাওয়া মানুষের ঢল নামে। প্রাণান্তকর এই চেষ্টায় বাস, ট্রেন, লঞ্চের টিকেটের জন্য লাইনে দাঁড়িয়ে রাতভর অপেক্ষা, বাড়তি ভাড়া গোনা, সড়ক-মহাসড়কের দীর্ঘ যানজট পোহাতে হয়। এই দুর্ভোগ গত কয়েক বছর ধরে যেন স্বাভাবিক ঘটনায় পরিণত হয়েছে। তবু প্রিয়জনের সঙ্গে ঈদ উৎসবের আনন্দ ভাগাভাগি করতে ঘরে ফেরার আনন্দটাই মুখ্য হয়ে ওঠে। শেষ মুহূর্তে টিকেট না পেয়ে কেউ বাসের মধ্যে ইঞ্জিন কভার কিংবা মোড়া পেতেও ফিরতে চান। ট্রেনের নির্ধারিত আসন বিশেষ কোটাতেই শেষ হয়ে যায়। সাধারণের জন্য থাকে স্ট্যান্ডিং টিকেট। সেখানেও কুলায় না। শেষ পর্যন্ত জীবনের ঝুঁকি নিয়ে অনেকেই ঈদযাত্রায় শামিল হন ট্রেনের ছাদে। যদিও এটি আইনত শাস্তিযোগ্য। ধারণক্ষমতার বাড়তি যাত্রী থাকে লঞ্চেও। সব ক্ষেত্রেই চলে জীবনবাজি রাখার নজির। একটু এদিক-ওদিক হলেই বড় ধরনের দুর্ঘটনার আশঙ্কা। সড়ক-মহাসড়ক, রেল আর পানিপথের এই বাড়তি চাপ অনেক সময়ই বড় ধরনের দুর্ঘটনার কারণ ঘটায়। ফলে আনন্দের এ আয়োজনে বিষাদের কালো ছায়া নেমে আসতে পারে মুহূর্তেই। তাই সংশ্লিষ্ট সবারই সতর্ক থাকা দরকার—চালক, যাত্রী, প্রশাসন। সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টাতেই পথের দুর্ভোগ-দুর্যোগ কমাতে পারে।
এই যে জীবনের ঝুঁকি মাথায় নিয়ে প্রিয়জনের সান্নিধ্যে ফেরার চেষ্টা, এটা বিশ্বের মাঝেই এক বিরল ব্যাপার। কেন তাঁরা ফেরেন? আমাদের কিসের টান?
হয়তো দেখা যায়, অনেকে নিজেরাই শুধু শহরে থাকেন না, বৃদ্ধ বাবা-মাকেও নিয়ে এসেছেন। তবু ঈদ করতে ফিরে যান জন্মভিটায়। কিন্তু কেন?
এই প্রবণতার শুরু হয়েছে নব্বই দশকের গোড়ায়, গ্রাম ছেড়ে শহরকেন্দ্রিক জীবন-জীবিকার কারণে। গ্রামের স্কুলে পড়তে পড়তে একটু ভালো করা ছেলেটি পড়ালেখার স্বার্থেই শহরের ভালো কোনো প্রতিষ্ঠানে সুযোগ করে নেয়। এর পর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখা শেষে চলে জীবিকার সন্ধান। অদ্ভুত কারণে আমাদের দেশের ওই অর্থে বিকেন্দ্রীকরণ হয়নি। ফলে সবকিছুই যেন ঢাকাকেন্দ্রিক। বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে ঢাকাকেন্দ্রিক। নাগরিক সুবিধাও। তাই জীবনধারণে শহর অপরিহার্য হলেও আমাদের শেকড় থাকে গ্রামে। হৃদয়ের টান শহুরে ব্যস্ততায় নিত্যসঙ্গী হলেও তা অন্য সময় বাস্তবে পরিণত করা যায় না। ঈদ আমাদের সে সুযোগ করে দেয়। তাই আমরা ফিরি। ফিরতে চাই। সব ঝক্কি-ঝামেলা-দুর্ভোগ উপেক্ষা করে। আমরা ছুটি আমাদের একটুকরো শৈশবকে ফিরিয়ে আনতে। সেই ফেলে আসা স্কুল, পথঘাট, মাঠ, দামাল ছেলের হৈ-হুল্লোড়—হয়তো সেই সব দিন আর ফিরিয়ে আনা যায় না। তবু শৈশব-কৈশোরের স্মৃতির আঁতুড়ঘরে ফিরতে আকুতি থাকে সবার। নাগরিক জীবনের প্রাত্যহিক ব্যস্ততা আর সূচিবদ্ধ রোবটিক জীবন, এর বাইরে মা, মাটির নিবিড় সান্নিধ্যে স্বস্তির কটা দিন, যেন সারা বছরের জন্য রিচার্জ করে দেয় আমাদের। তবে এই টান কিছু ক্ষেত্রে বিপদ তৈরি করছে। শুধু ঈদে ঘরে ফেরা শুরু হওয়ার পর থেকে সড়ক দুর্ঘটনা বেড়ে যায় কয়েক গুণ। তাই সাবধান হওয়া জরুরি।
‘দ্যাখো, জয়নুলের ছবির মত ঘরবাড়ি, নারী
উঠোনে ঝাড়ছে ধান, ধানের ধুলোয় ম্লান শাড়ি
গতর উদোম করে হাতে লেপা মাটির চত্বরে
লাঞ্ছিত নিশেন হয়ে পড়ে আছে যেন অনাদরে।’
আল মাহমুদের ‘কালের কলস’ কাব্যের প্রত্যাবর্তন কবিতায় এভাবে যে গ্রামীণ জীবনের চিত্র উঠে এসেছে, সেটিই আমাদের ফেলে আসা জীবন। সেই আদি আসল বাংলার রূপে ফিরতে তাই মরিয়া সবাই। তবু জীবন-জীবিকা আমাদের টেনে আনে কাঠ-পাথরের এই শহরে।
লেখক : ব্রডকাস্ট জার্নালিস্ট, চ্যানেল টোয়েন্টিফোর।